আসাদের পলায়ন, গাজায় গণহত্যা, ট্রাম্প ফের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:০০
॥ মুহাম্মদ আল্-হেলাল ॥
২০২৪ সাল বিশ্বের একটি ঘটনাবহুল বছর। বাংলাদেশের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মতো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঘটেছে বিভিন্ন ঘটনা। আল-জাজিরা, বিবিসি, ইরনা, সৌদি গেজেট, গালফ নিউজ, সিএনএন, ওয়াশিংটন পোস্ট, এএফপি, এপি, এপিপি ইত্যাদি অবলম্বনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঘটে যাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ঘটনা :
জাপানে ভূমিকম্প
১ জানুয়ারি ২০২৪। বিভিন্ন দেশ যখন বর্ষবরণের আনন্দে মেতে ওঠে, সে সময়ই প্রকৃতির রুদ্ররোষে পড়ে জাপান। বছরের প্রথম দিনেই ৭.৬ মাত্রার তীব্র ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে সূর্যোদয়ের দেশ। আঘাত হানে সুনামিও। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রাণ হারান শতাধিক মানুষ, ক্ষয়ক্ষতিও হয় বিস্তর।
ভারত-মালদ্বীপ বিরোধ
৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির লাক্ষাদ্বীপ সফরের পরেই মালদ্বীপ-ভারত উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। মোদিকে নিয়ে নানা বিতর্কিত মন্তব্য করেন দ্বীপরাষ্ট্রটির ভারত বিরোধী প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জুর দলের একাধিক নেতা। এমনকি ভারতের সমুদ্র সৈকতগুলো নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত বলেও কটাক্ষ করেন সে দেশের কয়েকজন নেতা। তারপরই নিন্দার ঝড় ওঠে। ভারতজুড়ে শুরু হয় ‘বয়কট মালদ্বীপ’।
হাইতিতে হাহাকার
২০২৪ সালে ঘটে যাওয়া হাইতির হাহাকার বিশ্বের জন্য একটি লজ্জাকর অধ্যায়। চরম অরাজকতা, লুঠতরাজে জর্জরিত ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ছোট দেশ হাইতি। মাফিয়াদের তাণ্ডবে বিপন্ন সাধারণ মানুষের জীবন। ১৫ মার্চ রাজধানী পর্তোপ্রাঁসের ৮০ শতাংশ দখল করে নেয় বিভিন্ন গ্যাং। ইস্তফা দিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়াল হেনরি। একাধিক শহরের কারাগার ভেঙে অপরাধীদের বেরও করে দেয় মাফিয়ারা। এমনকি প্রধানমন্ত্রী যাতে আর সুরক্ষিতভাবে দেশে ফিরতে না পারেন, তার জন্য হাইতির প্রধান বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণও নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছে তারা।
রাশিয়ায় নির্বাচন
১৭ মার্চ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় বিশ্বের ২য় পরাশক্তি রাশিয়ায়। ফলপ্রকাশের পর দেখা যায়, ভøাদিমির পুতিনের ঝুলিতে পড়েছে ৮৭.৮ শতাংশ ভোট। ফলে বিপুল জনসমর্থন পেয়ে আরেকবার রাশিয়ার মসনদে বসেন পুতিন। টানা পঞ্চমবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন তিনি। ইউক্রেন যুদ্ধ, বিরোধী নেতা নাভালনির মৃত্যু কোনো কিছুই প্রভাব ফেলেনি নির্বাচনে। ১৯৯৯ সাল থেকে রাশিয়ার মসনদে রয়েছেন পুতিন। এবারও রেকর্ড ভোটে জিতে ২০৩০ পর্যন্ত ক্ষমতায় রাশ ধরে রাখলেন তিনি। এ মেয়াদ যদি শেষ করতে পারেন, তাহলে রাশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে প্রেসিডেন্ট থাকার নজির গড়বেন পুতিন। টপকে যাবেন জোসেফ স্ট্যালিনকেও।
ইরানি প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যু
১৯ মে ২০২৪ ইরানি প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির হেলিকপ্টার পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের উজি গ্রামের কাছে বিধ্বস্ত হলে প্রেসিডেন্ট রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমীর-আব্দুল্লাহিয়ান এবং আরও কয়েকজন কর্মকর্তা নিহত হন। ইরানের আধাসরকারি সংবাদ সংস্থা, মেহর নিউজ, তাদের ‘দুর্ঘটনায় শহীদ’ বলে বর্ণনা করেছে। প্রিয় মাতৃভূমির জন্য এমন কোনো পদক্ষেপ নেই, যা নেননি ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। যার কারণে চিরশত্রু ইসরাইল এমনকি পশ্চিমাদের চক্ষুশূল ছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের জাঁদরেল এ নেতা। আমেরিকার কঠোর নিষেধাজ্ঞার পরও কখনো মাথা নত করেননি। রাজি হননি আপসেও।
তাই তো হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার খবরে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন মার্কিন সিনেটর রিক স্কট। পোস্টে তিনি বলেন, ‘তাকে (রাইসি) ভালোবাসা বা সম্মান নয়; এমনকি কেউ তাকে মিসও করবে না। যদি তিনি মারা যান, আমি সত্যিই আশা করি ইরানি জনগণ তাদের দেশকে খুনি স্বৈরশাসকের হাত থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবে।’ এ উচ্ছ্বাস শুধু মার্কিন সিনেটরেরই নয়, যেন ইসরাইল-আমেরিকার প্রতিচ্ছবি। তাই অনেকে প্রশ্ন তুলছেন এটি নেহাত দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কারণ গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইসরাইলের বুকে কাঁপন ধরানো একমাত্র প্লেয়ার ছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। তাকে শেষ করতে পারলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইসরাইলের দিকে মিসাইল তাক করার মতো আর কেউ নেই, তা ভালো করেই জানেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
ঋষি সুনাকের পরাজয়
৫ জুলাই ব্রিটেনের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয়। নজির গড়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন কেয়ার স্টারমার। তার দল লেবার পার্টির কাছে ভরাডুবি হয় কনজারভেটিভ পার্টির। প্রধানমন্ত্রীর গদি হারান ঋষি সুনাক। ১৪ বছর পর টোরি শাসনের অবসান ঘটে রাজার দেশে।
ইরানে নির্বাচন
ইব্রাহিম রাইসির আকস্মিক মৃত্যুর পর নির্বাচন হয় ইরানে। ৬ জুলাই নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সংস্কারপন্থী নেতা মাসুদ পেজেস্কিয়ান। জোর টক্কর দিয়ে তিনি পরাজিত করেন কট্টরপন্থী নেতা সাইদ জালিলিকে। পেজেস্কিয়ানের শপথগ্রহণে গিয়েই গুপ্তঘাতকের হাতে তেহরানে মৃত্যু হয় হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়ার। ইসরাইল এ হত্যাকাণ্ড চালায়।
হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়া হত্যা
হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়ার ছেলে, বোনসহ দশ স্বজনকে মাত্র কয়েকদিন আগেই ইসরাইলি হানাদাররা হত্যা করেছিল। হামাসপ্রধান হারিয়েছেন আরও কতশত কাছের মানুষ। তারপরও মাতৃভূমির স্বাধীনতার স্বপ্ন থেকে একচুল সরেননি তিনি। দুর্বীনিত শপথে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রাণপণে লড়ে গেছেন। শেষ পর্যন্ত সেই পুরনো ঘাতকের হাতেই প্রাণ দিতে হলো ‘আল-শাতি’ শরণার্থী শিবির, গাজা স্ট্রিপে ১৯৬২ সালে জন্ম নেওয়া হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়াকে, ৩১ জুলাই তেহরানে।
লেবাননে ইসরাইলের হামলা
১৯ সেপ্টেম্বর পেজার বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে লেবানন। সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর সদস্যসহ প্রাণ যায় অন্তত ৫০০ জনের। আহতের সংখ্যা ৪ হাজার পেরিয়ে যায়। এ ঘটনার পরদিন থেকেই লেবাননে হামলা শুরু করে ইসরাইল। ২৭ সেপ্টেম্বর ইসরাইলি সেনার অভিযানে নিহত হন হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লা। কয়েকদিনের মধ্যেই তার উত্তরসূরি হাশেম সাফেদ্দিনকেও হত্যা করে তেলআবিব। নয়া কমান্ডার হিসাবে নাইম কাসেমের নাম ঘোষণা করে হিজবুল্লাহ। এ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে ইরানও।
গাজা যুদ্ধের এক বছর
৭ অক্টোবর। ইসরাইলের বুকে নজীরবিহীন হামলা চালায় ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাস। প্রাণ হারান ১১০০ ইসরাইলি। ২৫০ জনকে অপহরণ করে গাজা ভূখণ্ডে নিয়ে যায় হামাস। তারপরই অপারেশন ‘আয়রন সোর্ড’ শুরু করে ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্সেস বা ইসরাইলের সেনা। বোমার আঘাতে কার্যত মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে গাজা। এখন পর্যন্ত গাজায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪৬ হাজার ফিলিস্তিনি। নিহত শত শত ইসরাইলি সেনাও। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়লেও সামরিক অভিযান অব্যাহত রেখেছে তেলআবিব। এক বছর পূর্ণ হলেও মেলেনি রফাসূত্র।
৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ট্রাম্প
ঘটনাবহুল ২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্যে বিশ্বের একক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন গত ৫ নভেম্বর ২০২৪ সাল বুধবারে অনুষ্ঠিত হয়। মার্কিনিরা চার বছর মেয়াদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো ডোনাল্ড জন ট্রাম্পকে (জন্ম: জুন ১৪, ১৯৪৬) ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করে হোয়াইট হাউসে ফিরিয়ে আনছেন। তিনি একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, বিশিষ্ট সামাজিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আলোচিত। এছাড়া তিনি দ্য ট্রাম্প অর্গানাইজেশনের পরিচালক এবং ট্রাম্প এন্টারটেইনম্যান্ট রিসোর্টের প্রতিষ্ঠাতাও। মার্কিন নির্বাচন বিশ্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এ নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করে পরবর্তী বিশ্বের পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সামরিক নীতি, রাজনীতি ইত্যাদি কীভাবে পরিচালিত হবে। সব ঠিক থাকলে আগামী ২০ জানুয়ারি তিনি শপথ নেবেন। তার এ মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিতে বড় পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন দেশটির প্রতিরক্ষা বিভাগের সাবেক বিশ্লেষক মাইকেল মালুফ।
আসাদের পলায়ন
২০১১ সালে ২৬ জানুয়ারি থেকে সিরিয়ায় আরব বসন্তের হাওয়া বইতে শুরু করে। সেই সময় সিরিয়ায় শুরু হওয়া দেশব্যাপী গণবিক্ষোভ এক সময় অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল রাষ্ট্রপতি বাশার আল-আসাদের পদত্যাগ, তার সরকারের ক্ষমতাচ্যুতি এবং সিরিয়া দীর্ঘ ৫ দশকের আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টি (আরবি নাম: হিয্ব আল-বা’ত আল-আরাবি আল-ইশতিরাকি- কুৎর সুরিয়া) শাসনের পতন।
তারপর থেকে সিরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, তুরস্ক, ইরান, সাউদি আরাবিয়া, ইজরাইল, আইএসআইএল, হিজবুল্লাহ, ন্যাটো; এমনকি গণচীনসহ সকল পক্ষের স্বার্থের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয়। এরই মধ্যে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমনের মাধ্যমে শুরু হয় এক নতুন যুদ্ধ। সে কারণে রাশিয়ার মনোযোগ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ থেকে কিছুটা ইউক্রেনে চলে যায়। অন্যদিকে ইসরাইল-ইরান খণ্ডযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ায় রাশিয়ার মতো বাশার আল-আসাদ ইরানের সমর্থনও কিছুটা কম পায়। আবার লেবাননের হিজবুল্লাহর ওপর ইসরাইলি হামলার ফলে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সমর্থন আরো দুর্বল হয়ে পড়ে। রাশিয়া, ইরান, হিজবুল্লাহ সিরিয়ায় যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় যে বাশার আসাদের স্বার্থ রক্ষা করেছে- এটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
এমন সময় এইচটিএস ইদলিব থেকে একের পর এক শহর দখল করে মাত্র ১২ দিনের মাথায় ৮ ডিসেম্বর ২০২৪ আসাদ পরিবারের ৫৩ বছরের শাসন আহমেদ আল-শারা আল জোলানীর নেতৃত্বে অবসান ঘটায়। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল-আসাদের শাসনভার গ্রহণের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের শাসন শুরু হয়। ২০০০ সালের ১০ জুন হাফিজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর থেকে ৮ ডিসেম্বর ২০২৪ পতনের পূর্ব পর্যন্ত হাফিজ আল-আসাদের পুত্র প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ দেশটির শাসন করছিলেন।