ফিরছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:৫৪
স্টাফ রিপোর্টার : নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় রাজপথে আন্দোলন ও দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর অবশেষে সুখবর পেল আন্দোলনকারী রাজনৈতিক ও পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের দাবিতে রিটকারী সংস্থাগুলো। গত ১৭ ডিসেম্বর মঙ্গলবার বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কয়েকটি বিষয় অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। ফলে সংবিধানে ফের প্রতিষ্ঠিত হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। পাশাপাশি সংবিধানে গণভোটের বিধান ফিরিয়ে এনেছেন উচ্চ আদালত। রিটকারীদের আইনজীবীরা পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পূর্ণ বাতিল চাইলেও আদালত পঞ্চদশ সংশোধনী পুরোটা বাতিল করা হয়নি।
গত ১৭ ডিসেম্বর উচ্চ আদালত থেকে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহালের রায় আসার পর তাৎক্ষণিক বিবৃতি দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিএনপি। এছাড়া নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধানও এ রায়ের পর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। আদালত সংবিধানে জাতির জনক, ৭ মার্চসহ কয়েকটি ধারা সংসদের জন্য ‘রেখে দিয়েছেন’। আদালত বলেছেন, বাকিগুলোর বৈধতাও দিচ্ছেন না। সেগুলো ভবিষ্যৎ সংসদের জন্য রেখে দিয়েছেন। ভবিষ্যৎ সংসদ জাতির প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলো রাখতে পারে অথবা বাতিল করতে পারে।
গত ১৭ ডিসেম্বর উচ্চ আদালতের রায়ের পর এক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপি ও জনগণের পক্ষ থেকে আমরা উচ্চ আদালতকে ধন্যবাদ জানাই। এ রায়ের মাধ্যমে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয়েছে। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, জনগণ এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনবার প্রমাণ করেছে, তারা ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করতে পারে। আমাদের নেত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করেছিলেনÑ যাতে জনগণ সঠিকভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। আমরা গত ১৫ বছর সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছি। ফলে উচ্চ আদালতের এ রায়ে আমরা খুশি, জনগণও খুশি। এ রায়ে জনগণ তাদের অধিকার ফিরে পাবেন, তারা দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি ও সাবির্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে।
দেশের উচ্চ আদালতের রায়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে উল্লেখ করে বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। গত ১৭ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে তিনি এ অভিনন্দন জানান। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের ভোট ও নির্বাচনব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছিল। এ সংশোধনীর মাধ্যমে বিনা ভোটে ক্ষমতা দখলের প্রবণতা তৈরি হয়। ফলে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে বাংলাদেশে কার্যতঃ কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। নির্বাচনের নামে তামাশা হয়েছে মাত্র।’ তিনি আরো বলেন, ‘মূলত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে। গত ১৭ ডিসেম্বর দেশের উচ্চ আদালতের রায়ে জনগণের অধিকার পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হলো। এটি জনগণের আরেকটি বিজয়। আমরা দেশবাসীকে এ আইনি লড়াইয়ে জনগণের ভোটাধিকার পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আন্তরিক অভিনন্দন ও মোবারকবাদ জানাচ্ছি।’
এদিকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের দুটি ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, এ রায়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসার একটা গুরুত্বপূর্ণ দ্বার উন্মোচিত হলো। পঞ্চদশ সংশোধনী আইন চ্যালেঞ্জ করে গত ১৮ আগস্ট সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি রিট করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট গত ১৯ আগস্ট রুল দেন। রুলে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। এ রুলে ইন্টারভেনার (আদালতকে সহায়তা করতে) হিসেবে বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, গণফোরাম, সংস্থা, ব্যক্তিসহ বেশ কয়েকজন যুক্ত হন। শুনানিতে রিট আবেদনকারী, বিএনপি, রাষ্ট্রপক্ষ, জামায়াত, গণফোরাম, ব্যক্তি ও সংস্থার পক্ষে তাদের আইনজীবীরা বক্তব্য তুলে ধরেন। প্রতিক্রিয়ায় বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমি খুব উৎফুল্ল, আনন্দিত এবং অত্যন্ত সন্তুষ্ট এ রায়ে। আমি মনে করি যে, এটা একটা ঐতিহাসিক রায়। এটা একটা সেমিনাল জাজমেন্ট।’ বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আজকে তিনি শুধু তার জন্য নয়, পুরো দেশবাসীর জন্য আনন্দিত। এই রায়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসার একটা গুরুত্বপূর্ণ দ্বার উন্মোচিত হলো। তবে এটা নির্ভর করবে ভবিষ্যতে কীভাবে আচরণ করা হয়। গণতন্ত্র ফিরে আসা, গণতান্ত্রিক উত্তরণ মানে একটা পরিবর্তন। সবাই যদি আচরণে পরিবর্তন আনে, রাজনীতিবিদরা যদি তাদের আচরণে পরিবর্তন আনেন, সবাই নিজেদের করণীয় করেন, তাহলে গণতন্ত্র ফিরে আসবে। আর তা না হলে ফিরবে না।
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, গণতন্ত্র হচ্ছে আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ। এই গণতন্ত্র বিকশিত হয় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপক্ষে এবং প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার কোনো প্রতিফলন হয়নি। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের আত্মবিশ্বাস জনগণের মধ্যে জন্ম নেয়নি। যার ফলে হয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থান। রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশে পরিণত হয়েছে। গত ১৭ ডিসেম্বর মঙ্গলবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করে এ রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে আদালত বলেন, অনুচ্ছেদ দুটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করেছে, যেটি হচ্ছে গণতন্ত্র। পঞ্চদশ সংশোধনী মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত ৭ক, ৭খ, ৪৪ (২) অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করেছেন আদালত। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫৪টি ক্ষেত্রে সংযোজন, পরিমার্জন ও প্রতিস্থাপন আনা হয়েছিল। রায়ে আদালত বলেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরোটা বাতিল করা হচ্ছে না। বাকি বিধানগুলোর বিষয়ে আগামী জাতীয় সংসদ আইন অনুসারে জনগণের মতামত নিয়ে সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করতে পারবে। এর মধ্যে জাতির পিতার স্বীকৃতির বিষয়, ৭ মার্চের ভাষণের বিষয়গুলো রয়েছে।
গণভোটের বিষয়ের রায়ে হাইকোর্ট বলেন, গণভোটের বিধান বিলুপ্ত করা হয়, যেটি সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অংশ ছিল। এ বিধান বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ৪৭ ধারা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় বাতিল ঘোষণা করা হলো। ফলে দ্বাদশ সংশোধনীর ১৪২ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হলো। হাইকোর্টের রায়ে ৭ ক, ৭ খ এবং ৪৪ (২) অনুচ্ছেদও বাতিল করা হয়েছে। ৭ ক অনুচ্ছেদে সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ, ইত্যাদি অপরাধ এবং ৭ খ সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য করার কথা বলা ছিল। এদিকে ৪৪ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ বিষয়ে বলা আছে। এ অনুচ্ছেদের ২ ধারা বলছে, ‘এই সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীন হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতার হানি না ঘটিয়ে সংসদ আইনের দ্বারা অন্য কোনো আদালতকে তার এখতিয়ারের স্থানীয় সীমার মধ্যে ওইসব বা এর যেকোনো ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষমতা দান করতে পারবেন।’ এ অনুচ্ছেদটি বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে রায়ে।
এদিন সকাল ১০টা ৫২ মিনিটে রায় ঘোষণা শুরু হয়। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ফারাহ মাহবুব পৌনে দুই ঘণ্টাব্যাপী এ রায় ঘোষণা করেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদ উদ্দিন। রিটকারী প্রতিষ্ঠান সুজনের বদিউল আলমের পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী ড. শরিফ ভূঁইয়া। বিএনপির পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল। জামায়াতের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির, ব্যারিস্টার এহসান সিদ্দিকী। ইনসানিয়াত বিপ্লবের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান। চার আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার জুনায়েদ আহমেদ চৌধুরী, ব্যারিস্টার নিশাত মাহমুদ, ইন্টারভেনর হিসেবে ছিলেন ব্যারিস্টার হামিদুল মিসবাহ, সেন্টার ফর ল’ গভর্ন্যান্স ও পলিসির পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার এহসান আবদুল্লাহ সিদ্দিকী।
বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলসহ বেশকিছু বিষয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কেন অবৈধ হবে না, এই মর্মে জারি করা রুলের রায়ের জন্য ১৭ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেন হাইকোর্ট। দীর্ঘ শুনানি শেষে হাইকোর্ট রায়ের জন্য এদিন ধার্য করেন। গত ১৯ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কেন অবৈধ হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি শশাঙ্ক শেখর সরকারের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেছিলেন। সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ অন্যদের রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে আদালত এ রুল জারি করেন। পরে রুলে পক্ষভুক্ত হন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। এছাড়া ইনসানিয়াত বিপ্লব, গণফোরাম ও চার আবেদনকারী রুলে ইন্টারভেনর হিসেবে পক্ষভুক্ত হন।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ সংশোধনীর দ্বারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এছাড়া জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা বিদ্যমান ৪৫-এর স্থলে ৫০ করা হয়। এছাড়া বেশকিছু বিষয়ে সংশোধনী আনা হয়েছিল।