যারা দেশ বিক্রি করে পালিয়েছে, তারা এ দেশকে নিজের মনে করত না -ডা. শফিকুর রহমান
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:৩১
স্টাফ রিপোর্টার : বাংলাদেশে যোদ্ধা দুই লাখ-চার লাখ নয়, এ দেশে যোদ্ধা মিনিমাম ১০ কোটি উল্লেখ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, এই ১০ কোটি যোদ্ধার ২০ কোটি হাত সদা প্রস্তুত যেকোনো ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার জন্য। আমরা আল্লাহ তায়ালার সাহায্য চাই আমরা যেন অন্যায় এবং অসত্যের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই করতে পারি। প্রিয় দেশবাসী আসুন, আজকে আমরা আরেকবার অঙ্গীকার করি, এ বিজয় দিবসে আমরা অবশ্যই দেশকে ভালোবাসবো, এ দেশকে আমরা কারো তাঁবেদার বানাতে দেব না এবং কেউ তাঁবেদারি করতে এলে তাকেও আমরা ছাড় দেব না। তিনি বলেন, যারা বিক্রি করেছিল আজকে তারা পালিয়ে গিয়ে ওখানেই আশ্রয় নিয়েছে। তারা এ দেশকে নিজের দেশ মনে করত না। কারণ এ দেশে তাদের বাচ্চা-কাচ্চা বসবাস করত না। তাদের বাচ্চাদের নীরবে অন্য দেশে পাঠিয়ে দিয়ে তারা সন্ত্রাস-ত্রাসের মাধ্যমে এ দেশকে শোষণ করেছিল।
গত ১৬ ডিসেম্বর সোমবার রাজধানীর পুরানা পল্টন মোড়ে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আয়োজিত সমাবেশ ও বিজয় র্যালি অনুষ্ঠিত হয়। র্যালিপূর্ব সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর মো. নূরুল ইসলাম বুলবুলের সভাপতিত্বে এবং কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদের পরিচালনায় পল্টন মোড়ে অনুষ্ঠিত মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সমাবেশ রূপ নেয় জনসমুদ্রে! সকাল ১০টায় সমাবেশ শুরুর নির্ধারিত সময়ের আগেই পল্টন মোড় থেকে কাকরাইল মোড় পর্যন্ত সড়কের চারপাশ মুখরিত হয়ে ওঠে বিজয় সমাবেশে উপস্থিত নেতাকর্মী ও জনসাধারণের অংশগ্রহণে। এছাড়া সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমীর আব্দুস সবুর ফকির ও এডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ সহকারী সেক্রেটারি যথাক্রমে মুহাম্মদ দেলোয়ার হোসাইন, কামাল হোসেন, ড. আব্দুল মান্নান, ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা মহানগর পূর্ব সভাপতি মুজাফফর হোসেন প্রমুখ।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, এ পল্টন ময়দানে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষকে সাপের মতো পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ আবু সাঈদের বক্তব্য ছিল ‘বুকের ভিতর তুমুল ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’Ñ এ তুমুল ঝড় এদেশের ১৮ কোটি জনগণের বুকের ভেতরের ঝড়। জামায়াতে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সকল হত্যাকাণ্ডের সঠিক তদন্ত ও ন্যায়বিচার করা হবে।
তিনি বলেন, তারা (আওয়ামী লীগ) মূলত প্রতিশোধ নিতে এসেছিল, আপনারা জানেন কীসের প্রতিশোধ। আমি জিজ্ঞেস করি সেদিন আপনার বাবাকে কারা হত্যা করেছিল? যারা একাত্তরের রণাঙ্গনে বুক চিতিয়ে যুদ্ধ করেছিল তাদের হাতে আপনার বাবাকে নিহত হতে হবে কেন? আপনারাই জবাব খুঁজেন। এর জন্য দায়ী কারা? কারা সেদিন ব্যাকফুটে ছিল? কারা সেদিন নব্য সৃষ্টি হওয়া বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছিল। কাদের নেতা বলেছিল, যদি ডানে তাকাই তারা চোর, বামে যেদিকই তাকাই তারাও চোর। সামনে যেদিকে তাকাই ওরাও চোর, পেছনে যেদিকে তাকাই ওরাও চোর। কাদের উদ্দেশ করে বলেছিলেন? সেই জবাব আজকে তাদের খুঁজতে হবে। কাজেই প্রতিশোধ জনগণের ওপর নয়, প্রতিশোধ নেন আপনাদের অপকর্মকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর।
তিনি আরো বলেন, আশ্চর্য লাগে তারা (আওয়ামী লীগ) বাংলাদেশটাকে টুকরা টুকরা করে বিভক্ত করে হিংসার রাজত্ব কায়েম করে পালিয়ে গিয়ে এখনো দেশকে তারা স্থির থাকতে দিচ্ছে না। তারা মাঝেমধ্যেই ফণা তুলে ফুঁসফাঁস করার চেষ্টা করে। যেই জাতি আপনাদের উচিত শিক্ষা দিয়ে তাড়াতে পেরেছে, সেই জাতি আপনাদের ফণাও একদম গুঁড়া করে দিতে পারে। এটা মনে রাখবেন, এই দেশে যোদ্ধা দুই লাখ চার-লাখ নয়, এ দেশে যোদ্ধা মিনিমাম ১০ কোটি। এই ১০ কোটি যোদ্ধার ২০ কোটি হাত সদা প্রস্তুত যেকোনো ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার জন্যে। আমরা আল্লাহ তায়ালার সাহায্য চাইÑ আমরা যেন অন্যায় এবং অসত্যের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই করতে পারি। প্রিয় দেশবাসী আসুন, আজকে আমরা আরেকবার অঙ্গীকার করি- এ বিজয় দিবসের আমরা অবশ্যই দেশকে ভালোবাসবো, আমরা কারো তাঁবেদার বানাতে এ দেশকে দেব না এবং কেউ তাঁবেদারি করতে এলে তাকেও আমরা ছাড় দেবো না।
শফিকুর রহমান বলেন, আমরা জাতি হিসেবে কৃতজ্ঞ জাতি। কিন্তু একটি পরিবার সে কৃতজ্ঞতাকে নষ্ট করে দিয়েছিল। স্বাধীনতার সব অর্জন ধূলিসাৎ করে সে পরিবারের সম্পত্তিতে পরিণত করা হয়েছিল। বাংলাদেশকে তারা তাদের জমিদারি মনে করে নিয়েছিল। জনগণকে তারা তাদের প্রজা ও ভাড়াটিয়া বানিয়েছিল। আমাদের সন্তানদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছিল। তারা একটি ক্যাডারভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। আজকের এমন একটি বিজয় দিবস বাংলাদেশের মানুষের মাথায় মাথায় লাল-সবুজের একেকটি খুঁটি। সবুজ হচ্ছে আমাদের শ্রমিক ও জমিন, আর লাল হচ্ছে শহীদ ভাইদের রক্ত। এ রক্ত দেওয়া কিন্তু শুরু হয়েছিল ৪৭ সাল থেকেই। সে রক্ত দেওয়ার ধারা অব্যাহত রয়েছে ২৪-এর আগস্ট পর্যন্তও।
তিনি বলেন, কিন্তু দুঃখের বিষয়, ৪৭-এর পরও জাতি স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারেনি। আবার ৭১-এর পরও জাতির স্বাধীনতা হাইজ্যাক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জাতির সামনে এর কোনো জবাব দেওয়া হয়নি। স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া শহীদ জিয়াউর রহমানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সেই পরিবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে জাতিকে শোষণ করেছে, ধোঁকা দিয়েছে, জুলুম করেছে, অধিকার কেড়ে নিয়েছে। জাতিকে দাসে পরিণত করেছিল।
জামায়াতের শীর্ষ এ নেতা বলেন, ৭২-এর পর জনগণের হাতে সত্যিকারের স্বাধীনতা তুলে দেওয়ার যে সংগ্রাম হয়েছিল, তা শেষ হয়েছে ২৪ এর আগস্টে। এই ২৪-এর লড়াইয়েও জনগণকে নিজ দেশের স্বৈরশাসকের কাছে জবাব দিতে হয়েছে। তারা জনগণকে পাত্তাই দেয়নি। মাটি থেকে, আকাশ থেকে গুলি করে জনগণের বুক ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছে। এ লড়াইয়ের প্রতীক ছিল শহীদ আবু সাঈদ। হাতের মধ্যে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না, কোনো বোমা ছিল না। খালি হাতে শুধু একটি লাঠি নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল। সে বলেছিল ‘বুকের ভিতর তুমুল ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’। সেই ঝড় কী শুধু তার ছিল? না। অধিকার কেড়ে নিয়ে জনগণকে দাসে পরিণত করার ঝড় তার বুকের মধ্যে ছিল, মানুষের ঝড়।
তিনি বলেন, এত রক্ত, এত ত্যাগের পর এটাকে বলা হচ্ছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা। স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখানো আমাদের জাতীয় ও নাগরিক দায়িত্ব। যারা বিদায় নিয়েছে তারাও আমাদের জাতীয় বীর। দেশের বাইরে যারা শহীদ হয়েছে তারাও আমাদের জাতীয় বীর। জাতীয় বীরদের উচ্চ শিখরে রেখে সম্মান জানাতে চাই। তাদের অবদান যেন কোনো গোষ্ঠী, পরিবার, দলের লোলুপ দৃষ্টির সামনে হারিয়ে না যায়। সুতরাং এ বিজয়, অবদানকে পাহারা দিতে হবে।
সমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, এ বিজয় দিবসের অঙ্গীকার হবে ভারতীয় আধিপত্যবাদ নিপাত যাক, পরাজিত শক্তি ভারতের দোসর আওয়ামী লীগ নিপাত যাক; জাতীয় স্বার্থে সকল বিভেদ ভুলে আমরা ঐক্যবদ্ধ। তিনি ভারতের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সকল রাজনৈতিক দলকে এককাতারে শামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, তবেই ১৯৭১ থেকে ২০২৪ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য জীবন উৎস্বর্গকারী শহীদদের স্বপ্ন ও চেতনা পূরণ হবে।
নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছে বর্গা দেওয়া হয়েছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এ দেশের ছাত্র-জনতা জীবন ও রক্ত দিয়ে সেই স্বাধীনতা ফিরিয়ে এনেছে। ছাত্র জনতার অর্জিত সেই স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে শেখ হাসিনা ভারতে বসে তার ভারতীয় প্রভুদের ঘাড়ে বসে ষড়যন্ত্র করছে। ছাত্র-জনতার অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষায় জামায়াত-শিবির এদেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব জনগণের ভাগ্য নিয়ে আর কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেওয়া হবে না। নতুন বাংলাদেশÑ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে একটি মানবিক ও কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করতে তিনি দেশবাসীর কাছে সহযোগিতা ও সমর্থন কামনা করেন। সমাবেশ শেষে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে বিজয় র্যালি পল্টন মোড় থেকে প্রেস ক্লাব-হাইকোর্ট-রমনা হয়ে কাকরাইল মোড়ে এসে শেষ হয়। বিজয় র্যালিতে কয়েক লাখ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন।