অন্তর্বর্তী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার : জাতীয় নির্বাচন
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:২৩
বিগত প্রায় ষোলো বছরের অপশাসনের পর আগস্ট মাসে জাতির আপাত মুক্তি মিলেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে আওয়ামী ও ভারতীয় ব্রাক্ষণ্যবাদ ১৬ বছর ধরে দেশে অসহনীয় জুলুম-নির্যাতন ও বিপুল লুটপাট করেছে। নির্বিঘ্নে এ লুটপাট করতে বিরোধীদল ও মতের ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়েছে। আর ফ্যাসিস্টরা নিজেদের শাসনকে বৈধতা দিতে কথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্যবহার করেছে। শেখ মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যারা এর বিরোধিতা করবে, তারাই দেশ ও জাতির শত্রু। আর এ চেতনাকে ব্যবহার আওয়ামী লীগ ও তার দোসর দলগুলো একটি বয়ান তৈরি করেছিল- তাদের যারা বিরোধিতা করবে, তারাই স্বাধীনতাবিরোধী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও তথাকথিত স্বাধীনতাবিরোধী চেতনাকে ব্যবহার করে বিগত ৫৩ বছর এক ধরনের রাজনীতির বয়ান তৈরি করা হয়েছিল। এ চেতনা ও বয়ানের চরম বিকাশ ঘটে বিগত ১৬ বছরে। আর এগুলো ছিল চরম মিথ্যাচার ও মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে সৃষ্টি করা হয় এক ধরনের মিথ। কিন্তু বাংলাদেশের কথিত বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ এ মিথ্যা বয়ানকে ন্যায্যতা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করে। কথিত সুশীল সমাজে স্তুতি ও আনুকূল্য পেয়ে শাসকমহল সন্তুষ্ট থাকলেও তরুণ ও যুবসমাজ এ মিথ্যা মিথ মেনে নেয়নি। ফুঁসতে থাকে তরুণ ও যুবসমাজ। ভিন্নমত ও দলের তরুণ ও যুবসমাজ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। একসময় তারা অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো জ¦লে ওঠে। দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন। ফাসিবাদী রেজিম চেষ্টা করে অত্যাচার-নির্যাতন ও গুলি করে হত্যা করে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করে। কিন্তু অত্যাচার-নির্যাতন ও গুলি উপেক্ষা তরুণ-যুবসমাজ এগিয়ে যায় ফ্যাসিবাদের পতনের দাবিতে। একপর্যায়ে ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী রেজিম পদত্যাগে বাধ্য হয় এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে যান।
পতন ঘটে ফ্যাসিস্ট রেজিম ও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী নেত্রী শেখ হাসিনার। দায়িত্ব গ্রহণের আহ্বান জানানো হয় নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। উনার নেতৃত্বে গঠিত হয় একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি ও প্রশাসনকে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টা পরিষদ দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। প্রথমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে নেয়া হয় ১৬ জন, তারপর যোগ হয় চারজন, তারপর আরো তিনজন। সর্বমোট ২৪ জনের একটি উপদেষ্টা পরিষদ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ চার মাস অতিক্রম করে পাচ মাস চলছে।
একটি সরকারের দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে সাধারণ জনগণের স্বাভাবিক সেবা প্রদানের পাশাপাশি সার্বিক সমস্যা অবহিত হওয়ার পাশাপাশি সমাধানেও দায়িত্ব পালন করতে হয়। আধুনিক রাষ্ট্রে সাধারণ জনগণের মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আবাসনের ব্যবস্থার পাশাপাশি আরো অনেক বিষয়েও দায়িত্ব নিতে হয়। যেমন রাজধানীসহ বড় শহরগুলোয় যোগাযোগ ব্যবস্থা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ রক্ষা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ অনেক বিষয়েও এখন রাষ্ট্র ও সরকারকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ইতোপূর্বেকার সরকারগুলো সুষ্ঠুভাবে এসব দায়িত্ব পালন করেনি, বরং গণবিরোধী শক্তির সাথে একাত্ম হয়ে জনগণের জন্য সমস্যাই তৈরি করেছে। যার কারণে বিগত ৫৩ বছরেও সাধারণ জনগণের মৌলিক পাঁচটি চাহিদাই পূরণ করতে পারেনি। এখনো বাংলাদেশে কয়েক কোটি মানুষ গৃহহীন, লাখকোটি মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্যের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না, লাখ লাখ মানুষকে উপযুক্ত চিকিৎসাসেবা দেশে না পেয়ে বিদেশে যেতে হচ্ছে। একটি বিশেষ দল ও গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে দেশ শাসন করলেও সাধারণ জনগণের মুক্তি ও কল্যাণের চিন্তা ছিল না তাদের মাথায়। তাই বিগত ৫৩ বছরেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে অপশাসনে সাধারণ জনগণের মুক্তি মেলেনি।
তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেশের ১৭ কোটি মানুষের মাঝে প্রত্যাশা অনেক বেশি। তারা আশা করছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা সাধারণ জনগণের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করবেন। বিশেষ করে নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ও প্রশাসন বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করবে। নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সরকার তথা প্রশাসনকে প্রতিটি পণ্য নিয়ে কাজ করতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও অধিদপ্তরকে জানতে হবে কোন পণ্যের চাহিদা কত, উৎপাদনের পরিমাণ কত, দেশের উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে গ্যাপ কী পরিমাণ, আমদানি করতে হয় নাকি দেশের উৎপাদন দিয়ে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব এবং সরবরাহ লাইন কী, সরবরাহ লাইন ঠিক আছে নাকি সমস্যা আছে- সব বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত আপডেট থাকতে হবে। আর একটি বিষয় হচ্ছে, এ পণ্য সরবরাহে কোনো সিন্ডিকেট আছে কিনা আর সিন্ডিকেট থাকলে কারা এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে। বিশেষ করে সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি তথ্য অধিদপ্তর, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ও কার্যকর সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সংশ্লিষ্টদের অভিমত সরকারের উল্লেখিত মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো যদি যথাযথ উদ্যোগ নেয়, তাহলে নিত্যপণ্যের মূল্য স্বাভাবিক পর্যায়ে তথা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। কারণ যারা পণ্যের সিন্ডিকেট করে, তারা সরকার ও প্রশাসন থেকে শক্তিশালী নয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাকি অন্তর্বর্তী সরকার
বর্তমানে একটি অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। দেশে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তীতে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে বলেছেন, ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘যদি অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি, তাহলে আরও অন্তত ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। মোটাদাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে।’
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের মাধ্যমে বোঝা গেল, আগামী দেড় বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এদিকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করা-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের দুটি ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান পুনর্বহাল এবং আইনের আরও চারটি ধারা বাতিল করেছেন আদালত।
বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপসহ বেশকিছু বিষয়ে ১৩ বছর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়েছিল। পঞ্চদশ সংশোধনী আইন ও আইনের কয়েকটি ধারার বৈধতা নিয়ে করা পৃথক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ১৭ ডিসেম্বর মঙ্গলবার এ রায় দেন। এ রায়ের মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আবার যুক্ত হবে। বর্তমানে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। ইতোপূর্বে ২০০৮ সাল পর্যন্ত অনেকগুলো জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা উচ্চ আদালতের মাধ্যমে বাতিল করে দেয়। উচ্চ আদালত আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের আদেশ দিয়েছেন। এখন একটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছেÑ আগামী জাতীয় নির্বাচন কীভাবে এবং কোন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। আর জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়, তাহলে তার রূপরেখা কী হবে, তা নিয়েও নানামহলে আলোচনা চলছে। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আগামী নির্বাচন কি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হবে নাকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে? রাজনৈতিক মহলে এ প্রশ্ন দেখা দেয়া স্বাভাবিক।
অবশ্য আইনজ্ঞরা বলছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী-সংক্রান্ত হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর বিস্তারিত জানা যাবে। অনেকে বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল-সংক্রান্ত রায় রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। আগামী মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ওই রিভিউ আবেদন আপিল বিভাগে শুনানি হতে পারে। এটি নিষ্পত্তি হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে যেসব প্রশ্ন রয়েছে, তার অবসান ঘটবে। কেউ কেউ বলছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী মামলার রায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল হয়ে গেছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলছেন, বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকারই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় ফিরতে পারে।
রায়ের পর গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় পেতে সময় লাগবে। সংক্ষিপ্ত রায় হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল-সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর রিভিউ আবেদন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে। দুটি রায় প্রকাশিত হলে সব মিলিয়ে সেখানে আদালতের দিকনির্দেশনা থাকবে। আগামী নির্বাচন কার অধীনে এবং কীভাবে হবে- সেটা স্পষ্ট হবে। এরপর ওই রায় সংবিধানে পুনঃস্থাপন করতে হবে। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কার্যকরের কথা বলা যাবে না। তার মতে, সার্বিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে এ রায়ে। অবশ্যই এটা ইতিবাচক।
তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবধা হয় না- এটা সর্বজনস্বীকৃত। তাই আগামী নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকার হোক বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার হোক, তা সুষ্ঠু ও অবাধ করতে হবে। যাতে সাধারণ জনগণ পছন্দ অনুযায়ী দল ও প্রার্থীকে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে- সেটা নিশ্চিত করতে হবে।