খুনের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল আ’লীগ
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:০৮
জুলাই বিপ্লব ঠেকাতে খুন দেড় সহস্রাধিক
১৫ বছরে বিচার ছাড়াই ১৯২৬ জন হত্যা
আ’লীগের শেষ ৫ বছরে খুন ১৬ সহস্রাধিক
॥ সৈয়দ খালিদ হোসেন ॥
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা খুনের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তিনি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠা নিয়ে মানুষ হত্যা করার প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন । তখন তার ঘোষণা অনুযায়ী আওয়ামী লীগের ক্যাড়াররা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে জামায়াতে ইসলামীর শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলা চালায়। ঘটায় খুনের ঘটনা। শুধু হত্যা করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি তারা, লাশের ওপর নৃত্য করে সেদিন আওয়ামী ক্যাডাররা উল্লাস প্রকাশ করে। একই অবস্থা ঘটে জুলাই বিপ্লবেও, ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ঠেকাতে প্রথমে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অস্ত্রধারীদের নামানো হয়, তারা গুলি ও হামলা চালিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে চেয়েছিল। দলীয় ক্যাডারদের মাধ্যমে ছাত্র-জনতাকে দমাতে না পেরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে হাসিনা সরকার। তারা ঠাণ্ডামাথায় গুলি করে নাগরিকদের হত্যায় মেতে ওঠে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। এছাড়া আওয়ামী লীগ তার শাসনামলে যাকে চেয়েছে, হত্যা করেছে। বিচার ছাড়াই কয়েক হাজার মানুষ হত্যা করেছে আওয়ামী লীগ। কোনো হত্যা হয়েছে সরাসরি দলীয় ক্যাডার বাহিনী দ্বারা, আবার কোনো হত্যা হয়েছে সরকারি বাহিনী দ্বারা। মোটকথা টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে খুনের রাজত্ব কায়েম করেছিল আওয়ামী লীগ।
জুলাই বিপ্লব ঠেকাতে খুন করা হয় দেড় সহস্রাধিক ছাত্র-জনতা : কীভাবে গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে, তার বিররণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে শোনাচ্ছিলেন এক পুলিশ অফিসার, এমন এক দৃশ্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। ওই অফিসার বলছিলেন, ‘স্যার একটাকে গুলি করি একটা মরে, ওই একটাই সরে, বাকিরা সরে না, এইটাই হলো সমস্যা’। মানে হচ্ছে গুলি করে যাকে মারা হচ্ছে, সে ছাড়া আর বাকিরা আন্দোলন থেকে পিছু হটছেন না। তবুও গত ৫ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত গুলি চালায় পুলিশ। ওই সময় যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তার একটা পরিসংখ্যান তুলে ধরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য সচিব ও সমন্বয়ক তারেকুল ইসলাম ২০ সেপ্টেম্বর জানিয়েছেন, সরকার পতন আন্দোলন ঘিরে এখন পর্যন্ত এক হাজার ৪২৩ জন শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ২২ হাজার। এ সংখ্যা চূড়ান্ত নয় বলে তখনই জানিয়েছিলেন তারেকুল ইসলাম। পরিসংখ্যানে আসেনি এমন আরও অনেক নাম রয়েছে। আহত ২২ হাজারের মধ্যে চিরতরে পঙ্গু বা অঙ্গহানি হয়েছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা ৫৮৭।
২৮ অক্টোবর খুন দিয়ে যাত্রা শুরু
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর দেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করে আওয়ামী লীগ। ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে লগি-বৈঠা দিয়ে তরতাজা তরুণদের পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে নারকীয় উল্লাস চালায় আওয়ামী লীগ। ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রেডিও-টিভিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। মূলত এ ভাষণ শেষ হওয়ার পরপরই দেশব্যাপী শুরু হয় লগি-বৈঠার তাণ্ডব। বিভিন্ন স্থানে বিএনপি-জামায়াত অফিসসহ নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি যেমন পৈশাচিক হামলা চালানো হয়, তেমনি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় অনেক অফিস, বাড়িঘর, দেশব্যাপী চলে এমন তাণ্ডব। তার প্রথম শিকার হয় গাজীপুরে জামায়াতে ইসলামীর অফিস। এ সময় লগি-বৈঠা বাহিনীর তাণ্ডবে শহীদ হন রুহুল আমিন। সুপরিকল্পিত হামলায় চারদলীয় জোট সরকারের ৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরীর উদ্যোগে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিকাল ৩টায় বায়তুল মোকাররমের উত্তর সড়কে পূর্বনির্ধারিত সমাবেশ ছিল। সকাল থেকেই সভার মঞ্চ তৈরির কাজ চলছিল। হঠাৎ করেই বেলা ১১টার দিকে আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠা ও অস্ত্রধারীরা জামায়াতের সমাবেশস্থলে হামলা চালায়। তাদের পৈশাচিক হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হন জামায়াত ও শিবিরের অসংখ্য নেতা-কর্মী। তাদের এ হামলা ছিল সুপরিকল্পিত ও ভয়াবহ। তারা একযোগে বিজয়নগর, তোপখানা রোড ও মুক্তাঙ্গন থেকে পল্টন মোড় দিয়ে আক্রমণ চালায়। একপর্যায়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা পল্টনের বিভিন্ন গলিতে ঢুকে পড়ে এবং নিরীহ জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের বেধড়ক পেটাতে থাকে। পল্টন মোড়ের পৈশাচিকতা সেদিন পল্টনজুড়ে ছিল লগি-বৈঠা বাহিনীর তাণ্ডব। লগি-বৈঠা আর অস্ত্রধারীদের হাতে একের পর এক আহত হতে থাকেন নিরস্ত্র জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীরা। তারা শিবির নেতা মুজাহিদুল ইসলামকে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। লগি-বৈঠা দিয়ে একের পর এক আঘাত করে নির্মমভাবে হত্যা করে জামায়াত কর্মী জসিম উদ্দিনকে।
মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তারা তার লাশের ওপর নৃত্য-উল্লাস করতে থাকে। ২০০৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পল্টন ময়দানের মহাসমাবেশ থেকে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা তার কর্মীদের লগি-বৈঠা নিয়ে ঢাকা অবরোধের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারা এ আহ্বানে সাড়া দিয়েই আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের কর্মীরা লগি-বৈঠা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ২৭ অক্টোবর থেকেই ঢাকাসহ সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। সে দিনও মুক্তাঙ্গনে আওয়ামী লীগের সভাস্থল থেকে বার বার ঘোষণা দেয়া হচ্ছিল, “জামায়াত-শিবিরের ওপর হামলা কর” ওদের খতম কর”। ১৪ দলীয় জোট ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিল, তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন বার বার উত্তেজনাকর বক্তব্য দিয়ে হামলার জন্য তাদের সন্ত্রাসী বাহিনীকে উৎসাহিত করছিলেন। ২৮ অক্টোবরের পৈশাচিকতা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছিল।
আশুলিয়ায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৪৬ জনকে গুলি করে হত্যার পর পুড়িয়ে দেওয়া হয় লাশ
সাভারের আশুলিয়ায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৪৬ জনকে গুলি করে হত্যার পর মৃতদেহ ভ্যানে তোলা এবং আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা পুরো জাতিকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। আশুলিয়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএফএম সায়েদ ওপর মহলের আদেশপ্রাপ্ত হয়ে এমন বর্বর কাজ করেন। এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দায়ের করা হয়। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী, ২১ পুলিশ সদস্যসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ৩৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, ৫ আগস্ট আশুলিয়ার বাইপাইলে ছাত্র-জনতার মিছিলে ১ থেকে ১২ নম্বর (১ নম্বর শেখ হাসিনা) আসামির নির্দেশে ১৩ থেকে ৩৬নং আসামিরা নির্বিচারে গুলি চালালে আহনাফসহ ৪৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। গুলিবিদ্ধ লাশগুলো ১৩ থেকে ১৬নং আসামিসহ অজ্ঞাত পুলিশ সদস্যরা ময়লার বস্তার মতো করে ভ্যানে তোলেন। থানার পাশে পুলিশের একটি গাড়িতে পেট্রল দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে তাদের লাশ পুড়িয়ে দিয়ে গণহত্যার নির্মম ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন।
প্রকাশ্যে কুপিয়ে বিশ্বজিৎকে হত্যা
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে শিবির সন্দেহে ছাত্রলীগের কর্মীরা পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কে এলাকায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা ভোজেশ্বর ইউনিয়নের মসুরা গ্রামের বিশ্বজিৎ দাসকে। বিশ্বজিৎকে কোপানোর এ ভিডিও দেখে সেদিন আঁতকে উঠেছিল দেশবাসী। সেই ঘটনায় বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করার পরে ঢাকার দ্রুত বিচার টাইব্যুনালে মামলার রায়ে ২১ জনের মধ্যে ৮ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ১৩ জনের যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছিল। মামলাটি হাইকোর্টে গেলে ২০১৭ সালের ৬ অগাস্ট আটজনের মধ্যে দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন উচ্চ আদালত। বাকি ছয়জনের মধ্যে চারজনকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়; দুজন খালাস পান। এছাড়া যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া ১৩ আসামির দুজন খালাস পান, অপর ১১ জনের যাবজ্জীবন বহাল থাকে। বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার নিয়ে এখনো তার পরিবারে আক্ষেপ চলছে। বিশ্বজিৎ দাসের মা কল্পনা দাস জানান, তার ছেলে কোনো সন্ত্রাসী ছিল না এবং কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। বিশ্বজিৎ ঢাকার শাঁখারীবাজারে দোকান চালাতো, যেখানে সবাই তার বন্ধু ছিল, কোনো শত্রু ছিল না। ২০১২ সালে প্রকাশ্যে নির্মমভাবে তাকে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর আগে বিশ্বজিৎ বলছিল, আমি হিন্দু, আমাকে মারবেন না। তবুও রেহাই পায়নি। ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও হত্যাকারীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়নি বলে জানান কল্পনা দাস। তিনি বর্তমান সরকারের কাছে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার আহ্বান জানান, যাতে তার ছেলের আত্মা শান্তি পায়।
মালিবাগে বিএনপির মিছিলে গুলি চালায় আ’লীগের এমপি ইকবাল
রাজধানীর মালিবাগে ২৩ বছরের বেশি সময় আগে বিএনপির মিছিলে গুলি করে চারজনকে হত্যার মামলায় আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এইচ বি এম ইকবাল, নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনসহ আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা, যা তখন দেশজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলা আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এইচ বি এম ইকবাল, নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনসহ ১৫ জনের অব্যাহতির আদেশ স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্ট আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এক আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও বিচারপতি মো. সগীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের পর ওই মামলা থেকে ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট এবং ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ ইকবাল, শাওনসহ ১৫ জনকে অব্যাহতি দেন। অব্যাহতির পৃথক আদেশ বাতিল চেয়ে ওই মামলার বাদী তৎকালীন খিলগাঁও থানা বিএনপির সভাপতি ইউনুস মৃধা গত ২৭ অক্টোবর হাইকোর্টে আবেদনটি করেন। ২০০১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মালিবাগে হরতাল চলাকালে তৎকালীন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ইকবালের নেতৃত্বে মিছিল থেকে বিএনপির মিছিলে গুলি চালানো হয়। এতে বিএনপির চার কর্মী নিহত হন।
আ’লীগের ১৫ বছরে বিচার ছাড়াই ১৯২৬ জন হত্যা
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে এমন ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারের’ নামে অন্তত ১ হাজার ৯২৬ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার এ হিসাব বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)। তারা এ পরিসংখ্যান তৈরি করেছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে। এভাবে মানুষ মারার প্রতিটি ঘটনার পর সরকারের তরফ থেকে প্রায় একই রকম গল্প বলা হয়। এসব যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সেটা শেখ হাসিনা সরকার ও তার প্রশাসন আগাগোড়াই অস্বীকার করে গেছে। তবে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ২০১৫ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সাত বছরের ক্রসফায়ারের তথ্য সংরক্ষণ করেছে। এ-সংক্রান্ত তথ্যাদি দেশের একটি প্রভাবশালী গণমাধ্যমের কাছে এসেছেন। ওই তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদন বলছে, এ সাত বছরেই ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে ১ হাজার ২৯৩ জন। দেশের এমন কোনো জেলা নেই যেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেনি। এর মধ্যে অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মীও রয়েছেন।
আ’লীগের শেষ ৫ বছরে ১৬ সহস্রাধিক হত্যাকাণ্ড
আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ পাঁচ বছরে সারা দেশে ১৬ হাজারের বেশি মানুষ খুনের শিকার হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৯টির বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা অপরাধ পরিসংখ্যানে এ তথ্য এসেছে। পাঁচ বছরের বেশি সময় বন্ধ রাখার পর গত ৫ ডিসেম্বর পুলিশ এ পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ১৬ হাজার ৫৫৫টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এ হিসাবটা এসেছে দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা থেকে। সাধারণত জোড়া খুন বা একসঙ্গে ততোধিক খুনের ঘটনায় একটি মামলা হয়। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বছরে গড়ে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ৩১১টি। এমনকি করোনা মহামারির সময় ২০২০ সালেও সাড়ে তিন হাজার খুনের ঘটনা ঘটেছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, শুধু এক দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিন হাজার মানুষের বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তিনি বলেন, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত এই সরকারের অধীনে এদেশে প্রায় তিন হাজার মানুষ পুলিশ, র্যাব, ডিবির হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এদের অধিকাংশই বিরোধীদলের নেতা-কর্মী। কক্সবাজারে মেরিন ড্রাইভে পুলিশের গুলিতে নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘‘ তাকে (সিনহা) পুলিশ হত্যা করেছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্টাভাবে অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। বিএনপি মহাসচিব বলেন, আওয়ামী লীগে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এসব করেছে।”
মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল ২৩ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে এক সভায় বলেছিলেন, যারা সহিংস শক্তি প্রদর্শন করতে পারছেন, তাদের কথায় রাষ্ট্র চলছে। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার নিজেকে রাষ্ট্র মনে করে। সুলতানা কামাল বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যা একটা হলেও সেটা অপরাধ। একটি সভ্য সমাজে এটি হতে পারে না। তাই আমরা এর প্রতিবাদ জানাবই। আমাদের সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, ‘কোনো অপরাধিকে যে অপরাধের জন্য ধরা হয়েছে, তাকে সেই আনুপাতিক শাস্তির চেয়ে বেশি শাস্তি দেওয়া যাবে না।’ আইন মানুষকে শাস্তি বা কষ্ট দেওয়ার জন্য নয়; বরং শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের পরিবেশ তৈরির জন্য।