পরিবর্তন-পরিমার্জনে ছাপা হচ্ছে পাঠ্যপুস্তক
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:০৭
পেছনের পৃষ্ঠায় থাকছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি
স্টাফ রিপোর্টার : বিনামূল্যে বিতরণের জন্য এবার ছাপানো হচ্ছে ৪০ কোটি পাঠ্যবই। নতুন বছরের শুরুতেই এসব বই হাতে পাবে শিক্ষার্থীরা। পতিত হাসিনা সরকারের প্রস্তুত করা বইয়ে কিছু পরিবর্তনও আনা হয়েছে। অর্থাৎ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর পরিবর্তনের হাওয়ায় বদলে যাচ্ছে পাঠ্যপুস্তকের পাতাও। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বাণী বাদ দিয়ে গণঅভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতি যোগ করে বই ছাপানো হচ্ছে। চলমান শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের পাশাপাশি সর্বস্তরের পাঠ্যবই পরিমার্জনে অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণার অংশ হিসেবে এমন যোগ-বিয়োগ হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে প্রায় পাঠ্যবইয়ের পেছনের মলাটে আর থাকছে না ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাণী। সেখানে যুক্ত হচ্ছে জুলাই-আগস্ট গণআন্দোলনের সময়ে শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতি। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও ছাপার দায়িত্বে থাকা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বর্তমান পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা বেশি প্রাধান্য পেলেও নতুন বইয়ে যুক্ত হবে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী ও মেজর জিয়াউর রহমানের মতো অন্যদের অবদানও। একই সঙ্গে জুলাই-আগস্ট গণআন্দোলনে নিহত আবু সাঈদ, মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধদের ‘বীরত্বগাথা’ বছরের পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। অপরদিকে আগের বছরগুলোয় বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের নিয়মিত কিছু লেখকের লেখাও বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার খবর এসেছে। বিশেষ করে যারা আগের সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
জানা গেছে, ব্যাপক পরিবর্তন আসছে এবারের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে। বাদ যেতে পারে শেখ মুজিবের ছবি। যুক্ত হবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি। বিশেষ করে বাংলা ও ইংরেজি বইয়ে ৭টি গদ্য ও পদ্য বাদ দিয়ে যুক্ত হচ্ছে ৮টি গদ্য ও পদ্য। আপত্তিকর ও অগ্রহণযোগ্য কারিকুলাম থেকে বাদ যাচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা তিনটি গদ্য, একটি পদ্য ও একটি জীবনী। তৃতীয় শ্রেণির একটি বই থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী বাদ দিয়ে সেখানে জাতীয় চার নেতার জীবনী যোগ করা হচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ ছেলে শেখ রাসেলকে নিয়ে লেখা ইংরেজি গদ্যও বাদ দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) জানিয়েছে, বিনামূল্যে বিতরণের জন্য এবার মোট পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা ৪০ কোটিরও বেশি। নতুন শিক্ষাবর্ষে জানুয়ারি মাসেই যাতে বিনামূল্যের এসব নতুন বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া যায় সে লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। তবে বছরের শুরুতেই সব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একেবারে সব নতুন বই নাও পেতে পারে বলে জানিয়েছে এনসিটিবি।
গত বছর (২০২৩ সাল) থেকে দেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়। কারিকুলামের আওতায় পরিবর্তন হয় প্রথম, দ্বিতীয় তৃতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির পাঠ্যবই। নতুন কারিকুলামের সাথে খাপ খাওয়াতে হিমশিম খেতে হয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়কে। চারদিকে দাবির ঝড় ওঠে এ কারিকুলাম পরিবর্তনের। বলা হয়, আমাদের সমাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এ কারিকুলাম। কিন্তু এসব দাবি উপেক্ষা করে বিগত সরকার একরকম জোর করেই চাপিয়ে দেয় সেই আপত্তিকর কারিকুলাম। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ‘সবকিছু চাপিয়ে দেয়া সরকার’র পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে প্রশ্নবিদ্ধ সেই নতুন শিক্ষাক্রম কার্যত বাতিল হয়ে যায়। এরপর ২০১২ সালে প্রণয়ন করা পুরোনো শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই পরিমার্জনের সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে বই ছাপানোর উপযোগী করা হয়েছে।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে পিঁপড়া ও পায়রার গল্প। ৩১ নম্বর ও ৩৫ নম্বর পৃষ্ঠায় দুটি ছবি বাদ দেওয়া হয়েছে। ৪১ নম্বর পৃষ্ঠায় এ-কার এর উদাহরণে রোদের তেজের পরিবর্তে মেঘের ছবি দেওয়া হয়েছে। ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়’ অধ্যায়ের নাম পরিবর্তন করে ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’ করা হয়েছে। সেখানে শুরুতেই ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। সেটি বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন একটি দৃশ্যের ছবি দেওয়া হয়েছে। অধ্যায়ের শুরু হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ দিয়ে। তাকে জাতির পিতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। নতুন বইয়ে এসব বাদ পড়েছে। এ অধ্যায় শুরু করা হয়েছে ২৫ মার্চের ঘটনা দিয়ে। এ অধ্যায়ের শব্দার্থে বঙ্গবন্ধু বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রশ্নোত্তর অংশে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে দুটি প্রশ্ন ছিল। সেগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া অনেক অধ্যায়ে উদাহরণের পরও সেই জিনিসের পরিচয় আলাদা করে তুলে ধরা হয়েছে। যেমন অ-তে অশোক ফুল ফুটেছে ভাই। এরপর লেখা হয়েছে অশোক একটি ফুলের নাম। উদাহরণের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন লেখায়ও পরিবর্তন এসেছে। যেমন আগে ছিল শৈবাল ভাসে। সেটিকে এখন লেখা হয়েছে নদীতে শৈবাল ভাসে। বিভিন্ন অধ্যায়ে সংক্ষিপ্ত লেখাকে বোঝার সুবিধার্থে বড় করা হয়েছে।
দ্বিতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে সিংহ আর ইঁদুরের গল্প নতুন করে যোগ হয়েছে। এছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর লেখা ‘সোনার ছেলে’ বাদ দেওয়া হয়েছে। সেখানে কাজী নজরুল ইসলামের ওপর লেখা ‘দুখু মিয়ার জীবন’ যোগ করা হয়েছে। ‘পহেলা বৈশাখ’ শীর্ষক গদ্যের নাম পরিবর্তন করে ‘নববর্ষ’ রাখা হয়েছে। বইয়ের ২৪ নম্বর পৃষ্ঠায় পদ্মা সেতুর একটি ছবি পরিবর্তন করা হয়েছে। নববর্ষ অধ্যায়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার ছবি বাদ দিয়ে সেখানে নববর্ষের অন্য ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া এ গল্পের লেখায়ও পরিবর্তন এসেছে। তবে দুটি শ্রেণির ইংরেজি ও গণিত বইয়ে তেমন পরিবর্তন দেখা যায়নি।
তৃতীয় শ্রেণির বইয়ে নতুন করে সংযোজন করা হচ্ছে ‘ঘাসফড়িং ও পিঁপড়ার গল্প’ এবং ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলেবেলা’। বাদ যাচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা গদ্য ‘সেই সাহসী ছেলে’। বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে ‘আমাদের জাতির পিতা’ বাদ দেওয়া হচ্ছে। সেখানে যাচ্ছে জাতীয় চার নেতাকে নিয়ে লেখা ‘আমাদের চার নেতা’। ইংরেজি বইয়ের শেষ অধ্যায়ে লেখা গদ্য ‘অ্যা ওয়ান্ডারফুল বয়’ বাদ যাচ্ছে। এতে শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ ছেলে শেখ রাসেলের জীবনী স্থাপন পেয়েছিল।
চতুর্থ শ্রেণির বাংলা বই থেকে বাদ যাচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে মমতাজউদ্দিনের লেখা ‘বাংলার খোকা’ এবং নির্মলেন্দু গুণের লেখা কবিতা ‘মুজিব মানে মুক্তি’। যোগ হচ্ছে ‘টুনুর কথা’ ও রজনীকান্ত সেনের কবিতা ‘স্বাধীনতার সুখ’। এছাড়া ‘মোবাইল ফোন’ নামক গদ্য বাদ যাচ্ছে। সেখানে যুক্ত হচ্ছে ‘বই পড়তে অনেক মজা’।
‘এছাড়া বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের প্রসঙ্গ কথা বাদ যাচ্ছে। সূচিপত্র ও অধ্যায়ের ১ ও ১০ নম্বর পৃষ্ঠায় আছে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। এটিকে পরিবর্তন করে লেখা হচ্ছে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী। এ বইয়ের এক নম্বরে অধ্যায়ের প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈচিত্র্য ও সামাজিক পরিবেশের ওপর প্রকৃতির প্রভাব, দুই নম্বর অধ্যায়ে সামাজিক বিভিন্নতা ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু, চার নম্বর অধ্যায়ে সামাজিক অধিকার ও অর্থনৈতিক অধিকার, সাত নম্বর অধ্যায়ে শ্রমজীবী ও চাকরিজীবী অনুচ্ছেদের আগের অংশের সঙ্গে কয়েকটি লাইন সংযোজন করা হবে।
পনেরো নম্বর অধ্যায়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ অংশে কয়েকটি লাইন সংযোজন ও বিয়োজন করা হবে। বইয়ের দুই নম্বর অধ্যায়ে নারী ও পুরুষ, ছয় নম্বর অধ্যায়ে অধিকাংশের মত গ্রহণ, বারো নম্বর অধ্যায়ে ঘূর্ণিঝড় এবং পনেরো নম্বর অধ্যায়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অনুচ্ছেদে একটি করে লাইন যুক্ত হবে। আর তিন নম্বর তথা মানচিত্র অধ্যায়ে একটি মানচিত্র সংযোজন করা হবে। আট নম্বর অধ্যায়ে ‘সামাজিক সম্পদ’ অনুচ্ছেদের নাম হবে ‘সামাজিক প্রতিষ্ঠান’, ‘আরও কিছু রাষ্ট্রীয় সম্পদ’ অনুচ্ছেদের নাম হবে ‘রাষ্ট্রীয় সম্পদ : প্রাকৃতিক’ এবং ৫২ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘এই বনভূমি বাংলাদেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে’ এই অংশকে লেখা হবে ‘এই বনভূমি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ’। এগারো নম্বর অধ্যায়ে ‘বঙ্গোপসাগর’কে লেখা হবে ‘বঙ্গোপসাগর একটি উপসাগর যা…।
চৌদ্দ নম্বর অধ্যায়ে ৭২ ও ৮৯ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘মধ্যযুগ’কে লেখা হবে ‘মুসলিম শাসনামল’। পনেরো নম্বর অধ্যায়ে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান অংশে ‘বঙ্গবন্ধু’র পরিবর্তে ‘মওলানা ভাসানী’র নাম যাবে। ৭৯ নম্বর পৃষ্ঠায় কে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন? অংশটুকু সংযোজন হবে। ইসলাম শিক্ষা বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ইবাদত অংশে ‘ঈদুল ফিতরের’ জায়গায় ‘ঈদুল ফিতর’, চতুর্থ অধ্যায়ের আরবি বর্ণমালা অংশের আটটি বর্ণের উচ্চারণে পরিবর্তন এবং পঞ্চম অধ্যায়ে নবী ও রাসূলদের পরিচয় অংশে সুরা আলাকের অর্থে ‘পড়ো, আর তোমার রব মহিমান্বিত’ করা হয়েছে।
পঞ্চম শ্রেণির বইয়ে নতুন করে স্থান পাচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিষয়বস্তু। এর বাইরে সূচিতে তেমন কোনো সংযোজন-বিয়োজন নেই। এনসিটিবি সূত্র বলছে, অতিবন্দনা ও অতিকথন রয়েছে এমন বিষয়গুলো এড়িয়ে জ্ঞান আহরণে যা প্রয়োজন, সেদিকেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবারের বই প্রণয়নের ক্ষেত্রে। সে কারণে বইগুলোয় দৃশ্যমান পরিবর্তন থাকবে। এছাড়া বয়স উপযোগী করে অনেক লেখা সহজবোধ্য করা হয়েছে। সবগুলো বইয়ের পেছনের পৃষ্ঠায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি যুক্ত করা হচ্ছে।