সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ‘শ্রমজগতের রূপান্তর-রূপরেখা’

দেশের অখন্ডতার জন্য হুমকিমূলক সুপারিশ

হারুন ইবনে শাহাদাত
১ মে ২০২৫ ১৭:১৪

সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ‘শ্রমজগতের রূপান্তর-রূপরেখা’ দেশের অখন্ডতার জন্য হুমকিমূলক সুপারিশ

॥ হারুন ইবনে শাহাদাত ॥
দেশের সংস্কার কমিশন ‘শ্রমজগতের রূপান্তর-রূপরেখা’ শিরোনামে এমন কিছু বিষয়ে সুপারিশ করেছে, যা দেশের স্বাধীন অস্তিত্বের জন্য হুমকি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। অথচ বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হচ্ছে না। কেউ গুরুত্বের সাথে দেখছেন না। এ সংস্কার প্রতিবেদনে শ্রম আইন সংস্কার কমিশন তাদের সীমানার বাইরে গিয়ে কিছু রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে। তারা আদিবাসীদের জন্য আইএলও কনভেনশন ১৬৯-কে আত্মীকরণের অনুসমর্থনের প্রস্তাব করেছে। অথচ এ কথা কারো অজানা নয়, ঐতিহাসিকদের বিশ্লেষণ এবং বাংলাদেশে সাংবিধানিক কোনো আদিবাসী জনগোষ্ঠী নেই। যারা ভিত্তিহীনভাবে এ দাবি করেন, তারা হলেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। অনেকে না বুঝেই বলেন, ওরা যদি খুশি হয়, তাহলে তাদের ‘আদিবাসী’ বললে ক্ষতি কী? আইএলও কনভেনশন ১৬৯ অনুসারে আদিবাসী হিসেবে এদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে স্বীকার করলে এ অজ্ঞতার জন্য দেশের স্বাধীন অখ-তা হুমকির মুখে পড়বে।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মাহফুজ আহমেদ মন্তব্য করেছেন, ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র অনুসারে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার,  তথা স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। এমনকি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি তারা মনে করে যে, তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে থাকবে না বা ভারতেও যোগ দেবে ; এমন কি তারা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিও করতে পারবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে থাকলেও তারা যে অঞ্চলে বাস করে সেই অঞ্চলের ভূমির মালিকানা বাংলাদেশের হবে না এবং সে অঞ্চলে সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। তারা আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বায়ত্তশাসন, স্বশাসিত সরকার ও তাদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আইনি কার্যক্রম এবং তা পরিচালনার জন্য স্বনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করতে পারবে। উপর্যুক্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত হলে প্রকারান্তরে তা এ অঞ্চলের ওপর বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ খর্ব করবে।’ (প্রকাশিত : পার্বত্যনিউজডটকম, ২৭ আগস্ট ২০১৫)।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আদিবাসীবিষয়ক গবেষক সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন চেয়ারম্যান ও পার্বত্য নিউজের সম্পাদক মেহেদেী হাসান পলাশ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘জাতিসংঘ ও আইএলওর সংজ্ঞার অপব্যাখ্যা বাংলাদেশের উপজাতি জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী বানানোর কোনো সুযোগ নেই। বরং ওইসব কনভেনশন ও চার্টার অনুযায়ী ট্রাইবাল বা উপজাতির যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তা বিচার করেই নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো উপজাতি। একই কারণে আদিবাসীবিষয়ক জাতিসংঘ চার্টার বাংলাদেশের উপজাতিদের জন্য প্রযোজ্য নয়।’
এডভোকেট সুলতান মাহমুদ হোসাইনী সাপ্তাহিক সোনার বাংলাকে বলেন, ‘শ্রম আইন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত রিপোর্টে অনেক কিছু আপত্তিকর বিষয় আছে যা ভূরাজনৈতিক কারণে, আইনগত কারণে ও সামাজিক কারণে আপত্তিকর। শ্রম আইন সংস্কার কমিশন তাদের সীমানার বাইরে গিয়ে কিছু রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে। তারা আদিবাসীদের জন্য আইএলও কনভেনশন ১৬৯-কে আত্মীকরণের Self-Determination বা অনুসমর্থনের প্রস্তাব করেছে। এ কমিশনের সদস্যরা বিজ্ঞ না অজ্ঞ নাকি বিশ্বাসঘাতক! আদিবাসী শব্দটা প্রয়োগ করা বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সম্পূর্ণ বেআইনি। সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই। কনভেনশন ১৬৯-এর Self-Determination-এর পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। আদিবাসীরা এ কনভেনশন অনুযায়ী দাবি করতে পারে গণভোটের তাদের এলাকায় যে আদিবাসী নামে অভিহিত জনগোষ্ঠী আর বাংলাদেশের সঙ্গে থাকবে না, আদিবাসীরা ইচ্ছা করলে তাদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র বানাতে পারে, ফেডারেশন হিসেবে থাকতে পারে অথবা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে দাবি করতে পারে। এমন দাবি করলে আইএলও কনভেনশন-১৬৯ অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার বাধ্য হবে তাদের দাবি মানতে। দাবি না মানলে তখন সৃষ্টি হবে আরেকটি পূর্ব তিমুর অথবা দক্ষিণ সুদান।’ তিনি আরো বলেন, ‘এ কমিশনের সকল সদস্যকে গ্রেফতার করে রাষ্ট্রদ্রোহীর অপরাধে বিচার করা উচিত। সরকারকে অনুরোধ করছি এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য।’
রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা সংস্কার কমিশনগুলো একে একে তাদের প্রতিবেদনগুলো জমা দিতে শুরু করেছে। কমিশনের সদস্যরা বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওর চোখে এতদিন দেশটাকে দেখেছে। তার প্রতিফলন ইতোমধ্যে দেশের সচেতন মানুষ প্রত্যক্ষ করছেন। বিশেষ করে শিক্ষা কমিশন বাতিল এবং নারী কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের পর জাতি প্রত্যক্ষ করল, তাদের চিন্তা-চেতনা বিশেষ গোষ্ঠী স্বার্থ রক্ষার এনজিও চিন্তায় এতটাই মগ্ন যে, তারা দেশের সংবিধান, প্রচলিত প্রথা, আইন এবং জাতিসংঘ সর্বজনীন সনদের কথাও ভুলে গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের ধর্মীয় বিধানের বিপরীত বিষয় সংবিধি করতে সুপারিশ করেছে। পৃথিবীর অমুসলিম দেশগুলোও ধর্মপালনের স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখিয়ে যাতে হাত দেয়নি, সা¤্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকরাও যে সাহস দেখায়নি। অন্যদিকে শ্রম কমিশনের প্রতিবেদনে সীমার বাইরে গিয়ে কেন এমন সুপারিশ করা হলো একটি স্পর্শকাতর ইস্যু নিয়ে। এর নেপথ্যে কি সত্যি সত্যি এশিয়ার এ অঞ্চলে তৃতীয় খ্রিস্টান রাষ্ট্র গড়ার নীলনকশা বা অন্য কোনো ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে তা অবশ্যই পর্যালোচনার দবি রাখে। কারণ কথায় আছে সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ।’ দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা আদিবাসী নন। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বসবাস করছেন। সা¤্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা এদেশ দখলের সময় আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার মতো কোনো আদিবাসী বা রেড ইন্ডিয়ানদের সাথে তাদের কোনো যুদ্ধ হয়নি। যুদ্ধ করেছেন তৎকালীন মুসলিম শাসকরা। তাই ঐতিহাসিক বিচার ও ঘটনাক্রম বিচারে মুসলমানরাই এ উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশের আদিবাসী। সাংবিধানিক ও ঐতিহাসিক এসত্য বিশ^বাসীর সামনে তুলে ধরা এ সরকার, জনগণ ও সংবাদমাধ্যমগুলোর দায়িত্ব।
ওরা আদিবাসী নন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী
নৃতত্ত্ববিদ মর্গানের সংজ্ঞানুযায়ী আদিবাসী হচ্ছে, ‘কোনো স্থানে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাসকারী আদিমতম জনগোষ্ঠী, যাদের উৎপত্তি, ছড়িয়ে পড়া এবং বসতি স্থাপন সম্পর্কে বিশেষ কোনো ইতিহাস জানা নেই’। ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, প্রতœতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর কেউই বাংলাদেশে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাস করছে না। তাদের সকলেই বহির্বিশ্ব; বিশেষ করে ভারত ও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে বিভিন্ন সময়ে। এ অনুপ্রবেশও স্মরণাতীতকাল পূর্বে ঘটেনি। মাত্র কয়েকশ’ বছর পূর্বে ভারত ও মিয়ানমার থেকে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের এ উপজাতীয় জনগোষ্ঠী তাদের আদিনিবাস ভারত ও মিয়ানমারে হলেও উল্লেখিত দুটি দেশও তাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকার করে না।
বাংলাদেশে বসবাস করা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারা সবাই এদেশের বাইরে থেকে এসেছেন।
বাংলাদেশের ‘আদিবাসী’: এথনোগ্রাফিয় গবেষণা পুস্তকের মতে, কিংবদন্তি অনুযায়ী অতীতে চাকমারা চম্পকনগর নামে একটি রাজ্যে বাস করত। চম্পকনগর ত্রিপুরা রাজ্যেরই কাছাকাছি কোনো জায়গায় অবস্থিত ছিল। এ ব্যাপারে নানা সাক্ষ্যও পাওয়া যায়। বাংলাপিডিয়া মতে, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে খুমিরা আরাকান থেকে বাংলাদেশে আসে। খ্যাং উপজাতি তাদের আরাকান থেকে বিতাড়ন করে। তবে এখনো কিছু খুমি আরাকানের কোলাদাইন নদীর তীরে বসবাস করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের ‘আদিবাসী’ : এথনোগ্রাফিয় গবেষণা পুস্তকের মতে, খুমি ‘আদিবাসী’রা মূলত মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীভুক্ত একটি দল। তারা তিব্বতি বার্মিজ-কুকিচিন ভাষায় কথা বলে। বাংলাদেশে খুমি নৃগোষ্ঠীর আগমন বার্মার চিন প্রদেশ থেকে। এই চিন হিলস প্রদেশ ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭ সালে আরাকান প্রদেশ থেকে আলাদা হয়ে নামকরণ করা হয় চায়না হিলস। বাংলাপিডিয়া মতে, কয়েক শতাব্দী আগে মিয়ানমারের ইরাবতী নদীর উজান অঞ্চল থেকে এরা আরাকান দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে। অন্যদিকে বাংলাদেশের ‘আদিবাসী’: এথনোগ্রাফিয় গবেষণা পুস্তকের মতে, বাংলাদেশের বাইরেও বিভিন্ন দেশে; যেমন ভারতের মনিপুর ও অরুণাচল, মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশ, মধ্য বার্মা (রোহমা পর্বতের পাদদেশে), উত্তর ও দক্ষিণ বার্মা এবং লাওসে বিচ্ছিন্নভাবে চাক জনগোষ্ঠীর বংশভুক্ত প্রাচীন ‘আদিবাসী’ আছে। ইতিহাসে জানা যায়, হিমালয়ের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পামির মালভূমি চাকদের উৎপত্তিস্থল। ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে চাকরা বংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে। বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস করে। তিন পার্বত্য জেলা ছাড়াও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী সমতল এলাকার কুমিল্লা, সিলেট, বৃহত্তর চট্টগামের বিভিন্ন উপজেলা, রাজবাড়ি, চাঁদপুর, ফরিদপুর ইত্যাদি অঞ্চলেও বর্তমানে বসবাস করে। বাংলাপিডিয়া মতে, এরা ছিল বর্তমান বারীয় রাজ্য ত্রিপুরার পার্বত্য এলাকার অধিবাসী। পরবর্তীতে এরা নিজ এলাকা ছেড়ে বাংলাদেশের মূলত কুমিল্লা, সিলেট এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় বসতি স্থাপন করে। অনেকের মতে, টিপরারা আসাম, বার্মা এবং থাইল্যান্ডের অধিবাসী সাধারণ এক উপজাতির পূর্বপুরুষ বডো জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশের ‘আদিবাসী’: এথনোগ্রাফিয় গবেষণা পুস্তকের মতে, এ জাতির মূল অংশ বাস করছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে। ত্রিপুরা রাজ্য ছাড়াও ভারতের মিজোরাম, আসাম প্রভৃতি প্রদেশেও অনেক ত্রিপুরা বাস করে। মিয়ানমারেও ত্রিপুরাদের জনবসতি আছে বলে জানা যায়। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ইতিহাস থেকে জানা যায়, আনুমানিক ৬৫ খ্রিস্টাব্দে সুই বংশের সময়কালে পশ্চিম চীনের ইয়াংসি ও হোয়াংহো নদীর উপত্যকা হচ্ছে এদের প্রাচীন আবাসস্থল। পরবর্তীতে এ জনগোষ্ঠী ভারতের আসাম হয়ে বর্তমান বসতি অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে এবং রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে বলে ইতিহাস সূত্রে জানা যায়। বাংলাপিডিয়া মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের এ উপজাতিকে মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর একটি উপশাখা বলে মনে করা হয়। এদের আদি নিবাস সম্ভবত ব্রহ্মদেশ (মিয়ানমার)। সেখান থেকে কোনো কারণে বিতাড়িত হয়ে কয়েকশ’ বছর আগে তারা এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছে। বাংলাদেশের ‘আদিবাসী’: এথনোগ্রাফিয় গবেষণা পুস্তকের মতে, পাংখোয়াদের বিশ্বাস অতীতে তারা লুসাই পাহাড়ের পাংখোয়া নামক কোনো গ্রাম থেকে এসেছিল। মিজোরাম প্রাদেশিক দলিলপত্র ও মানচিত্রে ৫৬১১নং পাংখোয়া গ্রামটির চিহ্ন উল্লেখ পাওয়া যায়। তারা বিশ্বাস করে যে, তারা বার্মার শান জাতির অংশ এবং দক্ষিণ দিক থেকে তারা এসেছিল। তাদের মূল আবাসভূমি বর্তমান মিয়ানমারের চীন প্রদেশ। প-িতদের মতে, পাংখোয়ারা সেই অঞ্চল থেকে সরে এসে ক্রমান্বয়ে আরাকান ও লুসাই হিলসে বসতি স্থাপন করে এবং কালক্রমে ধীরে ধীরে জীবন জীবিকার সন্ধানে পাংখোয়াদের একটি অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে।
বার্মার এক সাবেক নৌ অফিসার ক্যাপ্টেন এইচ কক্সকে মগ বসতির জন্য তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করা হয়। তার নামানুসারে বাংলাদেশের সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের নামকরণ করা হয়। মগদের এরূপ আশ্রয় দান ও তাদের লুটতরাজের ফলে ১৯২৪-১৯২৫ সালে প্রথম ইঙ্গ বার্মিজ যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যাতে বার্মা পরাজিত হয় এবং ১৮২৬ সালের ইয়ানদাবু চুক্তির ফলে আরাকান ও তেনাসারিম অঞ্চল ব্রিটিশ শাসনভুক্ত হয়। আরাকান মগরা থেকে আগত শরণার্থীরা চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ অঞ্চলে একটা স্থায়ী ঠিকানা খুঁজে নেয়। ক্রমে মাতামুহুরী উপত্যকার মধ্য দিয়ে তারা বান্দরবানে ছড়িয়ে পড়ে। তৃতীয় দলটি সীতাকু-ু অঞ্চল থেকে খাগড়াছড়িতে প্রবেশ করে। চতুর্থ দলটি বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করে বৃহত্তর পটুয়াখালীর দক্ষিণ অঞ্চলে পৌছে এবং সেখানে বসতি গড়ে তোলে।
বাংলাদেশের ‘আদিবাসী’: এথনোগ্রাফিয় গবেষণা পুস্তকের মতে, ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের রাজা শ্রী সুধাম্মার (শ্রীসুধর্ম) মৃত্যুর পর তার এক অমাত্য নরপতি আরাকানের সিংহাসন দখল করে রাজপরিবারের সদস্য ও প-িতদের মৃতুদ- দিতে থাকলে অনেকেই দেশ ছেড়ে পালাতে থাকে। দেশের এ রাজনৈতিক দুর্যোগের সময় রাজার পুত্র নাগাথোয়াইখিন রাজপরিবারের সদস্যবর্গ ও প-িতদের নিয়ে রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে যান। এ সময় তিনি চট্টগ্রামের কাইসাঁ জায়গায় আশ্রয় নেন। বাংলাদেশের ‘আদিবাসী’: এথনোগ্রাফিয় গবেষণা পুস্তকের মতে, ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের মতে, ম্রো (মুরং) নামে একটি জনজাতি যারা পূর্বে আরাকান হিলসে বাস করত তারা প্রধানত এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের সাঙ্গু নদীর পশ্চিমে এবং মাতামুহুরী নদী বরাবর বাস করে। বাংলাদেশের ‘আদিবাসী’: এথনোগ্রাফিয় গবেষণা পুস্তকে লুসাইদের বিষয়ে বলা হয়েছে, লুসাই হিল লুসাই জনগোষ্ঠীর মূল আবাস ভূমি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এককালে লুসাই হিল বর্তমানে মিজোরাম নামে পরিচিত। লুসাইদের পূর্বপুরুষেরা চিনলুং থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয় এবং নিজেদের তারা মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর বংশধর বলেই পরিচয় দেন।
অহমিয়া বা অসমদের মূল জনগোষ্ঠী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল আসাম রাজ্যে বাস করছে। মূলত অহমিয়া জনগোষ্ঠীর নামে ভারতের উক্ত প্রদেশের নাম আসাম নামকরণ হয়েছে। ব্রিটিশ কর্তৃক আসাম দখলের পর ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তার শাসনকার্য পরিচালনা এবং আরো বেশি বেশি পার্বত্যাঞ্চলে দুর্ধর্ষ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলোকে আয়ত্তে আনার লক্ষ্যে।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার রাজস্থলি, কাপ্তাই এবং বান্দরবান জেলার সদর, রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় খিয়াং জনগোষ্ঠীর বসবাস। ১৯৮১ এবং ১৯৯১ সালের আদমশুমারী অনুসারে খিয়াং জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা যথাক্রমে ৫৪৫৩ এবং ১৯৫০। দক্ষিণের টেম- চিন বা উত্তরের ওয়াইল্ড চিন নামে অবহিত আরাকান ইয়োমা উপত্যকার অববাহিকায় খিয়াংদের আদি নিবাস ছিল বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন। প্রথম মতবাদে খিয়াংরা আরাকানের উত্তর ও দক্ষিণের ইয়োমা পর্বত হতে জীবন জীবিকা আরম্ভ করে। বার্মার (বর্তমান মিয়ানমারে) আকিয়াব, ক্যকপু এবং সানডোওয়ে জেলার পশ্চিমে তাদের বসবাস রয়েছে বলে জানা যায়। অন্য মতবাদে জানা যায়, বার্মার চীন হিলসের অধিবাসীদের খিয়াং বলা হয়। বার্মিজরা এদের চিনস আর আরাকানিরা খিয়াং বলে ডাকে।
ইতিহাস বিশ্লেষণ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আদিবাসীবিষয়ক গবেষক মেহেদী হাসান পলাশ ও অন্য গবেষকরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন, সমতলের উপজাতীয় সম্প্রদায় যেমনÑ সাঁওতাল, গারো, হাজং, মনিপুরী প্রভৃতির বাংলাদেশে আগমনের ইতিহাস তিন-চারশত বছরের বেশি নয়। উত্তরাঞ্চলের প্রাচীন বিভিন্ন ইতিহাস থেকে জানা যায়, সাঁওতাল সম্প্রদায় রেল সম্প্রসারণের কাজে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ভারতের উড়িষ্যা ও বিহার অঞ্চল থেকে বাংলাদেশে আগমন ঘটে। কাজেই উপর্যুক্ত আলোচনায় প্রমাণ হয় আভিধানিকভাবে বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী কোনোভাবেই এখানকার স্বদেশজাত বা ভূমিপুত্র বা ‘আদিবাসী’ নয়।’ এ প্রশ্ন হলোÑ দেশের সংস্কার কমিশনের ‘শ্রমজগতের রূপান্তর-রূপরেখা’ এ কেন সন্তু লারমার নাতনি অগাস্টিনা চাকমার বক্তব্যের প্রতিফলন।
সন্তু লারমার নাতনি অগাস্টিনা চাকমার দাবি
গত ২১ এপ্রিল নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে চলমান জাতিসংঘের স্থায়ী আদিবাসীবিষয়ক ফোরামের ২৪তম অধিবেশনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)-এর প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি সৃষ্টিকারী শান্তি বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা সন্তু লারমার নাতি অগাস্টিনা চাকমা যে দাবি জানিয়েছেন, তা যেন ‘শ্রমজগতের রূপান্তর-রূপরেখা’-এ বর্ণিত ৬.১.৫ এর সুপারিশমালারই প্রতিধ্বনি। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহার ও পুনর্বাসিত বাঙালিদের পার্বত্য এলাকার বাইরে সম্মানজনকভাবে প্রত্যাহারসহ জাতিসংঘে একগুচ্ছ দাবি জানিয়েছেন। এ যেন মামা বাড়ির আবদার। ত্রিপুরা রাজ্যের চম্পকনগর থেকে বিতাড়িত হয়ে এদেশে আশ্রয় নেয়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী উপজাতির বংশধররা এখন এ অঞ্চলের ভূমিপুত্র তাদের নিজ ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়নের দাবি জানাচ্ছে। যদি আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পায়, তখন প্রথমে স্বায়ত্তশাসন তার পর স্বাধীনতার দাবি জানাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাই বিষয়টি হালকা করে দেখার সুযোগ নেই।

Harun ibn shahadat