অবৈধ সেশন ফি শিক্ষার্থীদের গলার কাঁটা
২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৬:২২
নির্ধারিত আয়ে চলা লোকেরা এমনিতেই জীবনযাপনের স্বাভাবিক ব্যয় নির্বাহে হিমশিম খাচ্ছেন, তার ওপর যুক্ত হচ্ছে সন্তানদের শিক্ষা ব্যয়। শিক্ষা উপকরণের বাড়তি দাম, গৃহশিক্ষকের সম্মানী ভাতা, স্কুলের বেতন, পরিবহন ব্যয়, নানা পরীক্ষার ফি সামলাতে অতিরিক্ত চাপ অনুভব করেন অভিভাবকরা। আর এখানেই শেষ নয়, ভর্তি ও অন্যান্য খাতে সব ধরনের খরচ নেওয়ার পরও ‘সেশন ফি’ নামে অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় খাতে হাজার হাজার টাকা নিচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্তৃপক্ষ, যা রীতিমতো অভিভাবকদের গলার কাঁটা হয়েছে দাঁড়িয়েছে। এই সেশন ফি’র নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায় বন্ধে বিভিন্ন সময় অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টরা সভা-সেমিনার ও মানববন্ধনও করেছে। কিন্তু এতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি গড়ায় হাইকোর্ট পর্যন্ত, উচ্চ আদালত সেশন ফি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু ‘সেশন ফি’ গ্রহণকারীরা হাইকোর্টের আপিল বিভাগের দ্বারস্থ হলে সেই নির্দেশ স্থগিত হয়ে যায়, ফলে চলমান থেকে যায় সেশন ফি’র নামে অবৈধভাবে অতিরিক্ত অর্থ আদায় কার্যক্রম।
গত ২৭ অক্টোবর ২০২৪ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের স্বাক্ষরিত পরিপত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোন কোন খাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করতে পারবেন, তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। মাসিক বেতন/টিউশন ফি স্কুল পর্যায়ে সরকার নির্ধারণ করে না দিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে কমিটি গঠন করে ওই কমিটির মাধ্যমে বেতন/টিউশন ফি নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে মহানগর, জেলা ও উপজেলা শহরে ফি নির্ধারণে ভিন্নতার কথাও বলা হয়েছে। স্থানীয় জনসাধারণের জীবনযাপন ব্যর্থ ও সামর্থ্যরে কথা বিবেচনায় এ ভিন্নতা তৈরি করতে বলা হয়। ওই পরিপত্রে স্কুল পর্যায়ের এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান এবং নন-এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান এবং কলেজ পর্যায়ে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান এবং নন-এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তফসিল ক, খ, গ এবং ঘ এ চারটি পৃথক ক্যাটাগরি ঠিক করা হয়।
সেখানে তফসিল ‘ক’তে শিক্ষার্থীদের নিকট হতে আদায়কৃত অর্থেও বিভিন্ন খাত উল্লেখ করা হয়েছে। যার প্রথমেই রয়েছে ‘টিউশন ফি/মাসিক বেতন’। অন্যান্য খাতের মধ্যে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা, মুদ্রণ/ছাপা (সিলেবাস, রেজি:, অগ্রগতি ইত্যাদি) বার্ষিক ফি ২০০ টাকা। বার্ষিক পরীক্ষার ফি, প্রতি বিষয়/প্রতি পত্রে ৩ ঘণ্টার জন্য ৪০ এবং তদনিম্ন সময়ের জন্য ৩০ টাকা হারে ফি। টিফিন (প্রযোজ্যক্ষেত্রে) মাসিক ১৫০ টাকা। ম্যাগাজিন (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) বার্ষিক ৭৫ টাকা। ক্রীড়া (অভ্যন্তরীণ ও বহিঃ) বার্ষিক ১৫০ টাকা। সাংস্কৃতিক/বিতর্ক বার্ষিক ৭৫ টাকা। বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপন বার্ষিক ৭৫ টাকা। বিভিন্ন ক্লাব গঠন বার্ষিক ২৫ টাকা। লাইব্রেরি বার্ষিক ২০ টাকা। কল্যাণ/দরিদ্র তহবিল বার্ষিক ২৫ টাকা। আইসিটি (প্রতি মাসে বিশ টাকা হারে) বার্ষিক ২৮০ টাকা। বাগান ও বাগান পরিচর্যা বার্ষিক ৬০ টাকা। ল্যাবরেটরি/গবেষণাগার (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) বার্ষিক ৮০ টাকা। স্কাউট/গার্লস গাইড/বিএনসিসি/শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত হারে। রেডক্রিসেন্ট (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) কমনরুম বার্ষিক ৩০ টাকা। পরিচয়পত্র বার্ষিক ৫০ টাকা। অত্যাবশ্যকীয় ব্যয় বার্ষিক ৫০ টাকা। নবীনবরণ, বিদায় সংবর্ধনা বার্ষিক ৫০ টাকা। চিকিৎসাসেবা বার্ষিক ১০ টাকা। বিবিধ/আনুষঙ্গিক বার্ষিক ৫০ টাকা। এছাড়া উন্নয়ন (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), শিক্ষা সফর, সাঁতার প্রশিক্ষণ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) খাতে প্রয়োজনীয়তা থাকলে ফি নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু চার ফর্দের জারি করা ওই তফসিলের কোথাও সেশন ফি নামে কোনো ফি নেওয়ার কথা উল্লেখ না থাকলেও তা নিচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলো।
রাজধানী ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স স্কুল এন্ড কলেজ। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের দুটি বিভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। একটি পুলিশ বিভাগ, অন্যটি সাধারণ বিভাগ। পুলিশ বিভাগে ‘নার্সারি থেকে কেজি শ্রেণি’ শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে ভর্তি ফি এবং সেশন ফি উল্লেখ করে অন্যান্য খাতে মোট ১২ হাজার ২০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। ঠিক একই শ্রেণির জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ১৮ হাজার ২০ টাকা। অর্থাৎ শুধু বিভাগের ভিন্নতার কারণে এখানে আরও ৬ হাজার টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে অভিভাবকদের। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স স্কুল এন্ড কলেজের একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক আনোয়ার হোসেন এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেশন ফি ও অন্যান্য অনেক অপ্রয়োজনীয় ফি নেওয়া হচ্ছে, যা আসলেই কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, যেসব প্রতিষ্ঠানে সরকারি অর্থায়নে বেতন-ভাতা চালু রয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সম্পত্তি রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের উচিত শিক্ষা ব্যয় কমিয়ে নিয়ে আসা। প্রতিষ্ঠানের মাসিক বেতন ছাড়াও যাতায়াত ভাড়া এবং শিক্ষা উপকরণে যথেষ্ট খরচ হয় অভিভাবকদের। সেক্ষেত্রে ব্যয় কমিয়ে আনা জরুরি।
রাজধানী এমন কোনো প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে না, যেখানে সেশন ফি নেওয়া হয় না। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজে একজন শিক্ষার্থীর মা ইয়ামিন বেগমের সঙ্গে কথা হলে তিনি সেশন ফি বাতিলসহ বিভিন্ন খাতে ফি আরও কমিয়ে আনার দাবি জানান। তিনি বলেন, গত বছর সপ্তম শ্রেণিতে ছিলেন তার মেয়ে, তখন তিনি ১০ হাজার টাকা সেশন ফি দিয়েছিলেন। এ অভিভাবক বলেন, কোনো কারণেই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সেশন ফি নেওয়া উচিত নয়, এটা বাড়তি চাপ। এমনিতেই সব খাতে টাকা নিয়ে নেয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। একবার ভর্তি হলেই যথেষ্ট, কিন্তু প্রতি বছরই নতুন করে নতুন ক্লাসে ভর্তির নামে টাকা নেওয়া হচ্ছে। ঢাকার একটি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠিত মহিলা মাদরাসার হিফজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে (শিক্ষার্থীপ্রতি) বার্ষিক ৩ হাজার টাকা সেশন ফি নেওয়া হচ্ছে। ২০২৫ সালের ভর্তিতেও এ ফি নেওয়া হয় বলে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা জানিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর একজন স্কুল শিক্ষক বলেন, অনেক স্কুলে সরকারি অর্থায়নে বেতন পাওয়া যায় না। তাছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানই নিজস্ব অর্থায়নে চলছে, সেক্ষেত্রে তারা শিক্ষকদের বেতন এবং প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য খরচ মেটাতে এ ফি নিচ্ছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সাইয়েদ এ জেড মোরশেদ আলীর সই করা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি নীতিমালা-২৪ সংক্রান্ত পরিপত্রে জানানো হয়, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল-কলেজ) টিউশন ফি ছাড়াও ২৩ ধরনের নতুন ফি নির্ধারণ করেছে সরকার। মোট চার ক্যাটাগরিতে এসব ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ক্যাটাগরিগুলো হচ্ছে- মাধ্যমিক (এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান), মাধ্যমিক (নন-এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান), কলেজ (এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান) ও কলেজ (নন-এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান)। এছাড়া টিউশন ফি নির্ধারণের জন্য মহানগর ও জেলা সদরে আলাদা কমিটি করতে হবে। নীতিমালায় টিউশন ফি নির্ধারণে মহানগর ও জেলা কমিটি করার কথা বলা হয়েছে। মহানগর কমিটিতে সভাপতি হিসেবে থাকবেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার শিক্ষা ও আইসিটি/সার্বিক এবং সদস্য সচিব হিসেবে থাকবেন আঞ্চলিক উপপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। সদস্য জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি, এমপিওভুক্ত কলেজের একজন অধ্যক্ষ (শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক মনোনীত), নন-এমপিও কলেজের একজন অধ্যক্ষ (শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক মনোনীত), এমপিওভুক্ত স্কুলের একজন প্রধান শিক্ষক (শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক মনোনীত) নন-এমপিও স্কুলের একজন প্রধান শিক্ষক (শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক মনোনীত) ও উপজেলা/থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা।
আর জেলা সদর পৌর এলাকার ও উপজেলার কমিটিতে সভাপতি থাকবেন জেলা প্রশাসক, সদস্যসচিব হিসেবে থাকবেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। সদস্য হিসেবে থাকবেন উপজেলা পর্যায়ে এমপিওভুক্ত কলেজের একজন অধ্যক্ষ (শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক মনোনীত), পৌরসভা পর্যায়ে নন-এমপিও কলেজের একজন অধ্যক্ষ (শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক মনোনীত), উপজেলা পর্যায়ে এমপিওভুক্ত স্কুলের একজন প্রধান শিক্ষক (শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক মনোনীত) ও উপজেলা পর্যায়ে নন-এমপিও স্কুলের একজন প্রধান শিক্ষক (শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক মনোনীত) ও উপজেলা/থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা।
সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অক্টোবর মাসের মধ্যে বিভিন্ন ক্যাটাগরির প্রতিনিধি নির্বাচন করে কমিটির সভাপতিকে অবহিত করবে। এছাড়া নীতিমালায় মাসিক বেতন/টিউশন ফি এবং তফসিলে বর্ণিত খাতে আদায়কৃত অর্থ তফসিলি ব্যাংকে নির্দিষ্ট হিসাবে রাখার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোনো একক খাতে বাৎসরিক আদায় ১০ লাখ টাকার অধিক হলে এ খাতের জন্য আলাদা ব্যাংক হিসাব খুলতে হবে। আদায়কৃত অর্থ আবশ্যিকভাবে খাতভিত্তিক ব্যয় করতে হবে এবং এক খাতের অর্থ অন্য খাতে ব্যয় করা যাবে না। সব আয় ও ব্যয় ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে। এসবের কোনো ক্ষেত্রেই সেশন ফি নেওয়া বিষয়ে কোনো তথ্য নেই বা উল্লেখ নেই।