‘দেবো না সীমানা ছেড়ে ইঞ্চি জমিন’

বিজয় বেহাত করতে তৎপর আগ্রাসী অপশক্তি

হারুন ইবনে শাহাদাত
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৭:৫৭

মানুষ স্বাধীনতা চায়। মানবপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য হলো স্বাধীনভাবে জীবনযাপনের আকাক্সক্ষা। এ পৃথিবীতে যখন একজন মানুষ আসে, স্বাধীনভাবেই আসে। যদিও একজন মানবশিশু বড় অসহায়। কারণ তাকে স্বাধীনভাবে চলাফেরার যোগ্যতা অর্জন করতে হয় বাবা-মা, পরিবার এবং সমাজের আট-দশজনের সহযোগিতায়। এজন্যই ফরাসি দার্শনিক জ্যা জ্যাক রুশো হয়তো বলেছেন, Man is born free but everywhere he is in chain. (মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত করে)।

কিন্তু এদেশের মানুষ জানেন, এ শৃঙ্খল ছিন্ন করার ঘোষণার মূলসূত্র, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। অর্থাৎ মানুষের কোনো প্রভু নেই, কোনো মানুষ কারো গোলাম নয়, সে মুক্ত এবং স্বাধীন। একজন মানুষ কোনো মানুষের দাসত্ব করতে বাধ্য নয়। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই হলেন একজন মানুষের প্রভু। কোনো মানুষ বা অন্য কোনো সৃষ্টির তাকে দিয়ে দাসত্ব করিয়ে কিছুতেই তার স্বাধীনতা বিকিয়ে নিতে পারে না। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’- এ মূলসূত্র মেনে নিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে একজন মানুষ প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ করতে পারে বলে মনে করেন দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানীরা। কিন্তু সমাজের প্রভাবশালী মানুষ তৈরি করেছেন হাজারো শৃঙ্খল। একটি দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রভাবশালী মানুষ বিভিন্ন আইন ও বিধিবিধানের নামে দুর্বলদের শৃঙ্খলিত করে রাখে। প্রভাবশালীরা নিজেদের স্বার্থে অন্যায়ভাবে তাদের গোলাম বানিয়ে রাখতে চায়। এ শৃঙ্খল ছিন্ন করার বাসনাই তাকে স্বাধীনতার জন্য তাড়িত করে। এ তাড়না থেকেই একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী জীবনবাজি রাখার সাহস পায়। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর মিছিল দেখেও পিছু হটে না। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা আর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভ করে, বিজয় উল্লাসে হয় আত্মহারা। কিন্তু বার বার তাদের মোহভঙ্গ হতে হয়। এ বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ড এর জন্য ছাত্র-জনতা গত ৫ আগস্ট তৃতীয়বারের মতো বিজয়ী ছিনিয়ে এনেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের ভাষায় ৩৬ জুলাই তারা নতুন করে স্বাধীনতা লাভ করেছেন। এর আগে ১৯৪৭-এ ব্রিটিশদের নিকট থেকে এবং ১৯৭১-এ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান বিভক্ত হয়েছে, পেয়েছে স্বাধীনতা ও বিজয়। কিন্তু বিজয়ী জাতি হিসেবে স্বাধীনতার সুফল তারা পায়নি। সাম্য (ইনসাফপূর্ণ বণ্টন), মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়নি।

ঐতিহাসিক সত্য হলো, ১৯৭০ সালে ভোটের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই শেষ পর্যন্ত পরিণত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। তারপর অনেক রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভের পর কেটে গেছে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভোটের অধিকার পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা হয়নি। জনগণ পায়নি মানুষের প্রভুত্ব থেকে মুক্তি, গোলামিমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ। বরং বার বার স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ চেপে বসেছে এ দেশের জনগণের ওপর। ছিনতাই হয়েছে তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা এবং বিজয়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম বিজয় দিবস উদযাপনের দুই বছর পর ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই জাতীয় নির্বাচনে হেলিকপ্টারে ব্যালট ছিনতাই করে ঢাকায় এনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ‘ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার প্রচেষ্টা মূলত আওয়ামী লীগের জেনেটিক্যাল ক্যারেক্টার।’ সেই সময়ের আওয়ামী লীগ নেতা রাজনীতিবিদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী তার ‘রাজনীতির তিনকাল’ বইয়ের ১৪২নং পৃষ্ঠায় ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচন সম্পর্কে বলেছেন, ‘এ নির্বাচন সর্বাংশে শান্তিপূর্ণ ও অবাধ হয়েছিল, তা বলা যাবে না। কোনো কোনো আসনে বিরোধীদলীয় প্রার্থীকে বলপূর্বক পরাজিত করা হয়েছে বলে নির্বাচনের পর অভিযোগ আনা হয়।’

দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২৩ মার্চ ১৯৭৩ সালে। এ নির্বাচনে অনেক প্রার্থীকেই মনোনয়ন দাখিল করতে দেননি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা। অনেককে মনোনয়ন প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়। মাগুরার সোহরাব হোসেন, ফরিদপুরের কেএম ওবায়দুর রহমান, মোতাহার উদ্দিন আহমেদ বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দিতে দেননি। বিরোধী প্রার্থীকে মনোনয়ন জমা দিতে দেননি ভোলার তোফায়েল আহমেদ। হালিম দাদ খান তার বইয়ে উল্লেখ করেন, ‘রাজশাহীর এএইচএম কামরুজ্জামান, ময়মনসিংহের রফিকউদ্দিন ভূঞা, কিশোরগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জিল্লুর রহমান ও মনোরঞ্জন ধর বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারে বাধ্য করেন। (বাংলাদেশের রাজনীতি-হালিম দাদ খান-পৃ. ৪৭)।

ভোলায় আরেকটি আসনে মনোনয়ন জমা দেয়ার কথা ছিল ডা. আজহারউদ্দিনের। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। মনোনয়ন জমা দেয়ার আগে তাকে অপহরণ করায় তার মনোনয়ন জমা পড়েনি। ফলে ঐ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন। (জাসদের উত্থান-পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি, পৃ. ৯৮)। আওয়ামী বুদ্ধিজীবী ও ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পদক পদ্মশ্রী পাওয়া পরলোকগত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলÑ দেশ স্বাধীন করতে প্রাণ দেয়ার জন্য সদা প্রস্তুত থাকতো, তারাই ১৬ ডিসেম্বরে লুটপাটকারীতে পরিণত হয়।’ এই হলো আওয়ামী লীগের গণতন্ত্রের নমুনা। আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আশাহত মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিবাদ শুরু করেন।

ভোটাধিকার ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শেখ মুজিব এরপর ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করে দেশের প্রথম স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় নিবন্ধিত হন। এ বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তাকে ঐতিহাসিকরা দেশের প্রথম ফ্যাসিবাদী শাসক বলে গণ্য করেন। একদল মুক্তিযোদ্ধা সেনাকর্মকর্তা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশকে মুক্ত করেন। কিন্তু চূড়ান্ত বিজয় তখন থাকে অধরা। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ভারতীয় আগ্রাসনে বেহাত স্বাধীনতার সর্বশেষ পর্ব হাসিনার গত দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন শেষে এসেছে তৃতীয় স্বাধীনতা ও বিজয় ২০১৪-এর ৫ আগস্ট।

ফ্যাসিবাদবিরোধী এ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট হাসিনা ও আওয়ামী লীগ পালিয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা এবং চূড়ান্ত বিজয় এখনো আসেনি। ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর।

আগ্রাসী অপশক্তি ভারতও বসে নেই। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনাকে শুধু আশ্রয়ই নয়, প্রশ্রয়ও দিচ্ছে ভারত। তাকে সাথে নিয়ে রীতিমতো বাংলাদেশবিরোধী অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের শান্তিপূর্ণ কাজে বাধা সৃষ্টি করছে। তাকে হটিয়ে ক্ষমতা পুনঃদখলের দুঃস্বপ্ন দেখছে। ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় মোবাইল ফোনে ভিডিও কল করে বাংলাদেশে আত্মগোপনে থাকা খুন-হত্যা-সন্ত্রাস, দুর্নীতি-অর্থ পাচার মামলার পলাতক আসামিদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছে। বিদেশে বিভিন্ন মিটিংয়ে বক্তৃতা দিয়ে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। তবে আশার কথা গোটা জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, ৩৬ জুলাইয়ে এ বিজয় ছাত্র-জনতা কিছুতেই ছিনতাই কিংবা বেহাত হতে দেবে না। তারা ঐক্যবদ্ধভাবে যেকোনো ষড়যন্ত্র রুখে দেবে। কবি-কথাসাহিত্যিক বুলবুল সরওয়ারের ভাষায়, ‘সাড়ে তিন হাত হাড় কবরের ভুঁই/ফুল পাখী নদী নীড় দেবো না কিছুই/দেবো না যবের ছড়া/ফসলের শতকরা/সবুজে শ্যামলে আঁকা থোকা থোকা জুঁই/নাও নদী ঢেউ জল দেবো না কিছুই। … দেবো না পালিয়ে যেতে কোনো হানাদার/রক্তের লোভে যারা আসে বার বার/বারুদের উপহার/যত চাই দেবো, আর/উজাড় দু’হাত ভরে শোধ দেবো ঋণ/দেবো না সীমানা ছেড়ে ইঞ্চি জমিন।’