ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করতে হবে
২৯ নভেম্বর ২০২৪ ০০:০০
॥ হারুন ইবনে শাহাদাত ॥
‘আমরাও পারি, কিন্তু কেন পারি না?’ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগছে- কী পারি, আর কী পারি না? আসলে এদেশের মানুষের মুখের উদ্দীপনামূলক স্লোগান, ‘আমরাও পারি।’ এ স্লোগানটি কিন্তু মিথ্যা নয়। এদেশের মানুষ; বিশেষ করে তরুণরা অনেক কিছু পারে। এ শতাব্দীর ‘শ্রেষ্ঠ’ ফ্যাসিস্ট আয়রন লেডিখ্যাত শেখ হাসিনা, যাকে ঊনবিংশ শতাব্দীর কুখ্যাত ফ্যাসিস্ট হিটলার-মুসোলিনির সাথে তুলনা করা হয়, তিনিও কিন্তু কম পারেননি। অন্যদিকে তাকে যারা দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছেন, সেই ছাত্র-জনতাও কম পারেন না। তারা কম পারেন না বলেই গত ৫ আগস্ট দেশ ফ্যাসিস্ট শাসনের জাঁতাকলমুক্ত হয়েছে। তাহলে কি পারি না আমরা? আমরা প্রতারণা রুখে স্বাধীনতার সুফল ধরে রাখতে পারি না। কথায় আছে, ‘চঞ্চলা মনে প্রজ্ঞা বাসা বানাতে পারে না’। এদেশের মানুষের মনটা মনে হয় একটু বেশিই চঞ্চল। জাপানি একজন শিল্পপতি বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেছিলেন, ‘তোমরা বড় অধৈর্য, সকালে গাছ রোপণ করে বিকালেই ফল খেতে ব্যস্ত হও। ফুলফলে পরিণত হওয়ার আগেই ছিঁড়ে খাও, ফল পাকার আগেই খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়।’ বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ বিশ্লেষণ মিথ্যা নয়। তাই হয়তো এদেশের ১৯৪৭-এর স্বাধীতার পর পিন্ডির জিঞ্জির ছেঁড়ার জন্য ১৯৭১-এ যুদ্ধ করে বন্দি হয়েছিল দিল্লির শিকলে। দিল্লির সেবাদাসীর ফ্যাসিবাদী শাসনের যে বন্ধন ছিন্ন করার জন্য ছাত্র-জনতা দীর্ঘ দেড় যুগ আন্দোলন-সংগ্রাম করল। অবশেষে এ বছরের জুলাই-আগস্টে প্রায় দুই হাজার ছাত্র-জনতা জীবন ও প্রায় ৫০ হাজারের অঙ্গহানির পর এলো আরেক স্বাধীনতা, যাকে আদরভরা আবেগে বলা হচ্ছে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’। সেই স্বাধীনতার সুফল পাওয়ার শঙ্কা এখনো কাটেনি, আবারও ফ্যাসিবাদ দাঁত বের করে হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দ্বিতীয় স্বাধীনতার সুফলভোগী যারা এখন রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণীর ভূমিকা পালন করছেন, তাদের নিয়েও এমন সন্দেহ-সংশয়ের কালো মেঘের ঘনঘটা বড় ঝড়ের পূর্বভাস দিচ্ছে। এ ঝড় যেকোনো মূল্যে থামাতে হবে। তা না হলে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর আবার শিকড় গাড়বে ফ্যাসিবাদ। এ ধারাবাহিকতা চলছে মুক্তিযুদ্ধ থেকে নিয়ে ছাত্র-জনতার প্রতিটি আন্দোলনে বিজয়ের পরই। তাই ‘আমরা পারছি না।’ ইউরোপ-আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্ব যা পারছে, আমরা তা পারছি না।
কেন তারা পারছে, কেন আমরা পারছি না
কেন তারা পারছে, কেন আমরা পারছি না- প্রশ্নের উত্তর জানতে তাদের ইতিহাসের পাতাগুলো উল্টে দেখতে হবে। কারণ তারাও একদিনে তা পারেনি। অনেক রক্তক্ষয় এবং সংগ্রাম করতে হয়েছে। এখনো করতে হচ্ছে। তারা ফ্যাসিবাদের চিহ্নও পর্যন্ত বরদাশত করে না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মিছিল-মিটিং এবং রাজনীতি করার অধিকারকে মানবাধিকারের জন্য অপরিহার্য বলে তারা তা রক্ষা করতে জীবন দিতে রাজি। কিন্তু ফ্যাসিবাদীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মিছিল-মিটিং এবং রাজনীতি করার অধিকার রুখতেও তারা যুদ্ধ করেছে প্রায় এক শতাব্দী, এখনো তারা তাদের যুদ্ধ শেষ করেনি। তারা সবসময় সতর্ক দৃষ্টি রাখে কোনোভাবেই যেন ফ্যাসিবাদ মাথা চাড়া দিতে না পারে। রাজনৈতিক কোনো এজেন্ডা নিয়ে ফ্যাসিবাদের সমর্থকদের তারা আজও রাস্তায় দাঁড়াতে দেয় না।
১৯৪৫ সালের ১ মে হামবুর্গের রেডিও ঘোষণা করেছিল অ্যাডলফ হিটলার নিহত হয়েছেন। এ বছরেরই ৯ মে ইউরোপে ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত পরাজয়ের দিন হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। ইউরোপ ফ্যাসিবাদী শাসনের বিষফল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখে শিক্ষা নিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর। এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল ৬১টি দেশের ১৭০০ মিলিয়ন মানুষ, যা সে সময় পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মারা গেছে ৫০ মিলিয়ন মানুষ, যার মধ্যে ৪০ শতাংশ সোভিয়েত নাগরিক। ১২ মিলিয়ন মানুষকে ফ্যাসিস্ট কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি করে নির্যাতন করা হয়েছে। ৯৫ মিলিয়ন মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করেছেন।
১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অভ্যুদ্বয় ঘটা বাংলাদেশের মানুষ আশা করেছিলেন ভোটাধিকার ফিরে পাবেন। স্বাধীন দেশে সাম্য (ইনসাফ), মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে। কিন্তু তারা কী পেলেন- ১. হেলিকপ্টারে ব্যালট ছিনতাই নির্বাচন, ২. লুটপাট কালোবাজারি আর অর্থ পাচারের পরিণতিতে ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ, ৩. ফ্যাসিবাদী একদলীয় বাকশালী দুঃশাসন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি মিলল সামরিক অভ্যুত্থানে। তারপর বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলেও একই সাথে চললো ফ্যাসিবাদীদের পুনর্বাসন। ফ্যাসিবাদ শুধু ডাল-পালাই মেলল না, শিকড়ও গাড়লো অনেক গভীরে। ক্ষমতা ও ক্ষমতার বাইরে দুই অবস্থাতেই তারা তাদের আগ্রাসী থাবায় ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকলো দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম, সামাজিক মূল্যবোধ ও শিক্ষাসহ সকল সেক্টর। হালুয়া-রুটির বিনিময়ে বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিককর্মী, ব্যবসায়ী থেকে নিয়ে সর্বস্তরে তারা তাদের বলয় বাড়াতে প্রতিবেশী ভারতের সহযোগিতায় চালিয়েছে বেপরোয়া তৎপরতা। তাদের উত্থান-পতনের সেই ইতিহাস ইতোপূর্বে এ প্রতিবেদকের একাধিক প্রতিবেদনে আলোচনা করা হয়ছে। এবারের আলোচ্য বিষয়- আবারও কি ফ্যাসিবাদ ফিরে আসছে কি?
আবারও ফ্যাসিবাদ ফিরে আসছে কি?
হাসিনা পালিয়েছেন। কিন্তু চুপ নেই। ভারতের মাটিতে বসে একের পর এক ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন। তার দোসররা জনগণকে ধোঁকা দিতে দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় ব্যাপক প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। মিথ্যা তথ্য প্রচার করে জনগণের মনে বিষ ঢালছে। দেশের চঞ্চল ও অস্থির মনের মানুষও তাদের সাথে তালি বাজাচ্ছে। অহেতুক নানা ইস্যু তৈরি করে পলাতক ফ্যাসিবাদীদের জ¦ালানো তুষের আগুনে বাতাস দিচ্ছে। তারা পরবর্তী পরিণতির কথা ভাবছে না। অবস্থা দেখে মনে হয়, তিন মাসেই তারা ভুলে গেছেন, ‘পেঁয়াজের বদলে আপেল খাওয়া, তেল ছাড়া রান্না, কাঁচামরিচ ও ডিম সিদ্ধ করে ফ্রিজে রাখা, মিষ্টি কুমড়ার রেসিপিগুলো এবং গুম-খুন আয়নাঘর, বিনা ভোট আর ডামি নির্বাচনের মন্ত্রী-এমপিদের টর্চার সেলের কথা। তাই তো ফ্যাসিবাদ প্রতিহতের জন্য রাষ্ট্র সংস্কারের কথা ভুলে তারা ব্যস্ত এখন…।
দেশের রাজনীতিবিদ, নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক ও সচেতন নাগরিকদের অসচেতনতার কারণে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে এলে তা হবে ভয়াবহ। এ প্রসঙ্গে জার্মানির ডয়চে ভেলে একাডেমি ও বন রাইন-জিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক যোগাযোগবিষয়ক শিক্ষক ড. সাইমুম পারভেজ সম্প্রতি একটি নিবন্ধে বিস্তারিত ভুলে ধরে বলেছেন, ‘গত ১৫ বছরে সুষ্ঠু ভোট না হওয়া, জুলাই হত্যাকাণ্ড এবং অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার পলায়নÑ এ তিনটি কারণে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন কতটুকু কমেছে, তা বোঝা মুশকিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের আচরণ ও বক্তব্যে এ নিয়ে অনুশোচনা লক্ষ করা যায় না। তাই যদি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে কোটি মানুষের পরিণতি এর সঙ্গে জড়িত।’ তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, ‘রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়ায় শুধু অপরাধের বিচার নয়, বরং এর সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় জড়িত। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শক্তি তার সাংস্কৃতিক মূলধন। বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের অনেক মহারথী ও মতামত প্রভাবক আওয়ামী লীগের শক্তি। তাই দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রাম ছাড়া দলটিকে নিষিদ্ধ করলে তা কার্যকরী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আওয়ামী লীগকে স্বল্পমেয়াদি নিষিদ্ধ করলে কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছানো কঠিন হবে।’
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান গণরায়। এ রায় তারা দিয়েছে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে। তাই এ রায়ের ভিত্তিতেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না। আওয়ামী লীগের রাজনীতি যাকে ঘিরে, তিনি (শেখ মুজিবুর রহমান) ক্ষমতা লাভের পর গণতন্ত্র নয়, বাকশালী ফ্যাসিবাদী শাসন জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিলেন।
‘আমাদের সংবিধানে এমন কতগুলো মারাত্মক ত্রুটি রয়ে গেছে কিংবা নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে, যেগুলো এ দেশের রাষ্ট্রচরিত্রকে স্বৈরাচারী ও গণবিরোধী একনায়কত্বে পরিণত করছে বার বার। উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম সম্প্রতি লিখেছেন, “সংবিধানের আরেকটি মারাত্মক ত্রুটি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে ‘নির্বাচিত একনায়কের’ ক্ষমতা দিয়ে সর্বশক্তিমান করে ফেলার ব্যবস্থা করা।” ১৯৭২ সালে যখন সংবিধানটি প্রণয়ন করা হয়, তখন প্রধানমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে সংবিধান প্রণয়ন কমিটি সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন করে যখন সেটা বঙ্গবন্ধুর কাছে পেশ করেছিল, তখন যেখানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার বিষয়গুলো বর্ণিত হয়েছে, সেখানেই বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে কেটেছেঁটে ওগুলোয় পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে রাষ্ট্রপতির তুলনায় একচ্ছত্র (অ্যাবসলিউট অ্যান্ড আনচ্যালেঞ্জড) করার ব্যবস্থা করেছিলেন, যার ফলে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতাহীন বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। ব্যাপারটি আমাকে বলেছিলেন ওই কমিটির সদস্য দৈনিক আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক সর্বজনশ্রদ্ধেয় অধ্যাপক খালেদ। কমিটির কাছে কাটাকুটি করা খসড়াটি যখন ফেরত এসেছিল, কমিটির কারো সাহস হয়নি বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে করা পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কিছু করার।’ শেখ মুজিবুর রহমানের এ কাজ দেশের বা বঙ্গের বন্ধুর মতো না হলেও অধ্যাপক সাহেব তাকে কিন্তু বন্ধু বলেই ডেকেছেন। এ মানসিকতার বদল না হলে তার বাকশালী আদর্শ তো ফিরে আসবেই। তাই সাদাকে সাদা এবং কালো বলতে গিয়ে যদি কারো নামের আগে বন্ধুর বদলে ফ্যাসিস্ট বলার প্রয়োজন হয়, তা বলার সাহস অর্জন করতে হবে। তবেই এ অপশক্তি মোকাবিলা সম্ভব হবে। তাহলেই ইউরোপের মতো ‘আমরাও পারবো’, নয়তো আবারও ফ্যাসিবাদের নাগপাশে বন্দি হতে হবে এ দেশের মানুষকে; ২৪ বিপ্লবের নায়কদের জীবন হবে বিপন্ন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাই এক্ষেত্রে ইউরোপের আদর্শ অনুসরণ করতে হবে। ফ্যাসিবাদের ডিএনএ যাদের রক্তে আছে, তাদের রাজনীতির বাইরে রাখতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।