মুখ বাঁকা হতে পারে, কানে শোনাও বন্ধ হতে পারে
॥ হামিম উল কবির ॥
জলবসন্ত বা চিকেন পক্সের জীবাণু জীবনের কোনো সময় মানবদেহে মারাত্মক রোগ ডেকে আনতে পারে। কারো জলবসন্ত হলে এর জীবাণু শরীরে দুর্বল হয়ে জলবসন্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক হয়ে থেকে যায়। সাধারণত যে একবার জলবসন্তে আক্রান্ত হয়, তাকে আর এ রোগ আক্রান্ত করতে পারে না। তবে মানবদেহে এ জীবাণুটিই কখনো কখনো জেগে উঠতে পারে এবং জলবসন্ত না হলেও আক্রান্ত ব্যক্তির নিচের চোয়াল বাঁকা হয়ে যেতে পারে, চোখের পাতাকে আক্রান্ত করতে পারে, ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি চোখের পাতা বন্ধ করতে পারে না এবং কান আক্রান্ত করে কানে শোনাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। জলবসন্ত থেকেই রোগটি যে হতে পারেÑ এ সম্বন্ধে সাধারণ মানুষ একেবারেই সচেতন নন। আক্রান্ত হলে সাথে সাথে চিকিৎসা নিতে না পারলে আক্রান্ত ব্যক্তি স্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। চিকিৎসকদের ভাষায় রোগটির নাম ‘রামসে হান্ট সিনড্রোম’। এটি একটি ভাইরাসজনিত স্নায়ুর রোগ। ঠিক সময়ে ধরা না পড়লে এটি গুরুতর হতে পারে।
জলবসন্ত থেকে রামসে হান্ট সিনড্রোম
চিকেন পক্স বা জলবসন্তের ভাইরাসটির নাম ভ্যারিসেলা হারপিস জোস্টার। এটাকে রামসে হান্ট সিন্ড্রোমও বলে। বাংলাদেশে শীত শেষে গরম শুরুর পর যখন অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয় বা শুষ্ক আবহাওয়া দেখা দেয়, তখন এ ভ্যারিসেলা হারপিস জোস্টার ভাইরাসটির আক্রমণ একটু বেশি দেখা দিয়ে থাকে। সব বয়সী মানুষই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। শিশুদের মধ্যে আক্রান্তের হার বেশি। বিশেষ করে ১০ বছরের কম বয়সীদের জলবসন্তে আক্রান্ত হতে বেশি দেখা যায়। জলবসন্ত বা চিকেন পক্সে আক্রান্ত হলে তাদের শরীরে সুপ্ত অবস্থায় ভ্যারিসেলা হারপিস জোস্টার ভাইরাসটি থেকে যায়। বয়সকালে ওই একই ভাইরাস থেকে হারপিস রোগ হয়ে থাকে, তবে সবার নয়। ছোট ছোট ফুসকুড়ির মতো হারপিস মুখ বা শরীরের যে কোনো অঙ্গের ত্বকে হতে পারে। কানের ভেতরের একটি সংবেদনশীল নার্ভে হারপিস হলে তখন তাকে বলা হয় রামসে হান্ট সিন্ড্রোম।
কানের কোন নার্ভে হয় এ রোগ
কানের ভেতরে রয়েছে দুটি গুরুত্বপূর্ণ নার্ভের অবস্থান। একটি শোনার জন্য কাজ করে এবং অন্যটির সাথে মুখের পেশির যোগ রয়েছে। কানের লতির পিছন দিক দিয়ে ওই নার্ভ বেরিয়ে মুখের পেশির সঙ্গে যুক্ত হয়। রামসে হান্ট সিন্ড্রোম হলে কান ও মুখের নার্ভ দুটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। রোগটি হলে প্রথমে কানে ব্যথা হয়। কানে শুনতে সমস্যা হয়। কানের ত্বকে হারপিস বা ফোসকার মতো হয়। এই ফোস্কার মধ্যে যথেষ্ট পানি জমা হয়। হারপিস হলে ফেসিয়াল প্যারালাইসিস হয়ে যায়। কারণ এটা মুখের পেশির সাথে যুক্ত থাকে। ফেসিয়াল প্যারালাইসিস হলে মুখ বাঁকা হয়ে যায়। চিকিৎসকরা বলেন, এ ধরনের প্যারালাইসিসে রোগীর মুখের বেঁকে যাওয়া অংশ একেবারে অবশ হয়ে যায় না। পেশিগুলো দুর্বল হয়ে যাওয়ায় কুলকুচি করতে সমস্যা হতে পারে। এরই প্রভাবে চোখের পাতা বন্ধ করতে সমস্যা হয়, সারাক্ষণই চোখের পাতা খোলা থাকে। মুখের পেশি দ্বারা যে কাজগুলো হয়ে থাকে, সেগুলোকে প্রভাবিত করে রামসে হান্ট সিনড্রোম। এ সিনড্রোমের কারণে শ্রবণশক্তিও ক্রমশ কমতে পারে। চোখের পাতা বন্ধ করতে না পারলে অথবা মুখের নিচের চোয়াল বাঁকা হয়ে গেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিউরোলজির চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডায়াগনসিস করা যায়, ততই ভালো এবং তত তাড়াতাড়ি নার্ভ কাজ করতে শুরু করবে ওষুধের কারণে। নিউরো মেডিসিনের চিকিৎসক ডা. হুমায়ুন আহমেদ জানান, হারপিসের সমস্যা হলে তা থেকে সুস্থ করার জন্য কার্যকর ওষুধ রয়েছে। কম সময়ের মধ্যে ডাক্তারের কাছে আসতে পারলে বাঁকা চোয়াল অথবা চোখের পাতা বন্ধ হওয়া রোধ করা যায়। এছাড়া মুখের পেশির দুর্বলতার জন্য ফিজিওথেরাপির প্রয়োজন পড়ে। দেহে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে কার কম সময়ে রোগটি সেড়ে যাবে অথবা কার কিছু বেশি সময় লাগবে, তবে রোগটি সেড়ে যায়। রামসে হান্ট সিন্ড্রোম যে কোনো বয়সের মানুষের হতে পারে, বয়স্কদের ক্ষেত্রে এটা বেশি ঘটে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে এ ভাইরাস সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং চোখ, চোয়াল ও কানের ক্ষতি করে থাকে।
স্নায়ুতন্ত্রের রোগ রামসে হান্ট সিনড্রোম
স্নায়ুতন্ত্রের এক ধরনের রোগ এ রামসে হান্ট সিনড্রোম। ভ্যারিসেলা জোস্টার ভাইরাস যখন মুখের নাড়াচড়ায় যুক্ত স্নায়ুগুলোকে আক্রমণ করে তখন সমস্যা তৈরি করে। ভাইরাসের কারণে মুখের স্নায়ুগুলোয় ইনফ্লেমেশান বা জ্বলা-পোড়া দেখা দেয়। আর ইনফ্লেমেশনের কারণেই স্নায়ুগুলো কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে মুখের যে জায়গায় এ ভাইরাস আক্রমণ করে সেখানে অস্থায়ী ফেসিয়াল প্যারালাইসিস দেখা দেয়। আক্রান্ত হলে ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির মুখের মাংসপেশির সাথে মস্তিষ্কের যোগাযোগ বিচ্ছন্ন হয়ে যায় এবং মাংসপেশিগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। এই স্নায়ুগুলোর সাথে মুখের যে অংশ যুক্ত সে অংশে প্যারালাইসিস দেখা দেয় বা সেই অংশ অসাড় হয়ে যায় বা সেখানে পক্ষাঘাত দেখা দেয়। চিকিৎসকরা বলেন, মানবদেহে মোট ১২টি ক্রেনিয়াল নার্ভ থাকে। এই ১২ নার্ভের মধ্যে সপ্তম ক্রেনিয়াল নার্ভে ভাইরাসটি আক্রমণ করলে রামসে হান্ট সিনড্রোম দেখা দেয়।
লক্ষণগুলো কী কী?
রামসে হান্ট সিনড্রোম দেখা দিলে কানের ভেতরে কিংবা কানের চারপাশে ব্যথা, লালচে র্যাশ কিংবা ফোস্কা পড়ে যায়। আর মুখের ওই অংশে সাময়িক পক্ষাঘাত দেখা যায়। একই সাথে রোগীরা আক্রান্ত কানে সারাক্ষণ বেল বাজার মতো আওয়াজ শুনতে পান আবার অনেকে সাময়িকভাবে শ্রবণ শক্তিও হারিয়ে ফেলেন। এছাড়া যে দিকে ভাইরাসের আক্রমণ বেশি থাকে, সেদিকের চোখেও সমস্যা দেখা যায়। চোখের পাতা বন্ধ করা যায় না, ফলে চোখ শুকিয়ে যায়। ফলে চোখের চিকিৎসার দরকার পড়ে। কানের পাশাপাশি মুখের ভেতর, জিভেও র্যাশ বের হয় বলে নিউরোলজিস্ট ডা. হুমায়ুন আহমেদ জানান। এছাড়া মাথা ঘোরার সমস্যাও দেখা যায়। মুখের একদিকের মাংশপেশি ও স্নায়ু শিথিল হয়ে যাওয়ার কারণে অনেকের মুখ ঝুলে যায়। খাবার খেতে সমস্যা হয়, মুখ থেকে খাবার পড়ে যায়, লালা ঝরতে থাকে।
জলবসন্ত বা চিকেন পক্স
জন্মের পর থেকে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত জলবসন্তের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। বড়দেরও হতে পারে, তবে খুব কম। আর একবার কারো বসন্ত হয়ে গেলে দ্বিতীয়বার সাধারণত হয় না। একবার আক্রান্ত হলে শরীরে এ ভাইরাসের ‘অ্যান্টিবডি’ তৈরি হয়ে যায়। এর বিরুদ্ধে কার্যকর টিকা রয়েছে, শিশুর জন্মের ৪৫ দিন পর থেকে যেকোনো বয়সেই চিকেন পক্সের টিকা দেয়া যায়। টিকা দেয়া থাকলে চিকেন পক্স হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। আক্রান্ত রোগী থেকে এ ভাইরাস সুস্থদের মধ্যে ছড়াতে পারে। বসন্তে আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক অবস্থার চেয়ে সেরে ওঠার সময়টাই বেশি মারাত্মক। সেরে ওঠার সময় পানি ভর্তি ফোস্কাগুলো ফেটে ওই স্থানের ত্বক শুকিয়ে যায়। এসময় স্বাভাবিকভাবে কিংবা চুলকানোর কারণে ফোস্কার পাতলা ও শুকনো চামড়াগুলো ঝরে পড়ে। শুকনো চামড়াগুলোয় ভ্যারিসেলা জোস্টার ভাইরাস থাকে। এই চামড়া কারো গায়ে লাগলে অন্যরাও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। বাতাসের মাধ্যমে ছাড়াও রোগীকে স্পর্শ করা, রোগীর ব্যবহৃত জামা-কাপড়, বিছানার চাদর ও অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসের সংস্পর্শে আসার মাধ্যমেও এ ভাইরাস অন্যের মধ্যে ছড়াতে পারে। বাতাসের মাধ্যমেই ভাইরাসটি বেশি ছড়াতে পারে।
চিকেন পক্সের চিকিৎসা
কোনোরকম ওষুধ ছাড়াই ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই চিকেন পক্স ভালো হয়ে যায়। ছোঁয়াচে বলে আক্রান্তকে সুস্থদের কাছ থেকে কিছুটা দূরে রাখা উচিত। রোগটি থেকে সেরে ওঠার শেষ দিকে যখন ফোস্কাগুলো শুকাতে থাকে, তখন সুস্থ শিশুদের থেকে আক্রান্তদের দূরে রাখা জরুরি। তখনই রোগটি বেশি ছড়াতে পারে। বড়দের এ রোগটি কমই হয়। সেবা যত্ন করলেও বিশেষ করে বাবা ও মায়ের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। আক্রান্ত হলে রোগীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে; বিশেষ করে ব্যবহার্য জিনিসপত্রের। রোগীকে নিয়মিত গোসল করাতে হবে। তবে গোসলের পর গা মোছার ক্ষেত্রে সাবধান হতে হবে- যাতে পানি ভর্তি ফোস্কাগুলো যেন ফেটে না যায়। প্রথমদিকে রোগীর শরীরে দুর্বল ভাব, মাথাব্যথা, সর্দি-কাশি, জ্বর ভাব ইত্যাদি হয়। কিছুদিনের মধ্যেই শরীরে ঘামাচির মতো ছোট ছোট দানা দেখা দেয়। পরে সেগুলো বড় হয়ে ভেতরে পানি জমতে থাকে। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে জ্বর ও শারীরিক দুর্বলতা। শরীরে ব্যথা ও সর্দি-কাশিও হতে পারে।
এ পাতার অন্যান্য খবর
- দিল্লি-বেইজিং দ্বন্দ্বক্ষেত্র ঢাকা?
- কে হচ্ছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট
- উৎসবের পর ফিরছে মানুষ
- বছরে ৯২ হাজার কোটি টাকা পাচার হয় : সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী
- মুসলমানদের ইতিহাস মুছে দিচ্ছে চীন
- সেন্টমার্টিন কি বিচ্ছিন্ন
- ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে : নূরুল ইসলাম বুলবুল
- পানিবন্দি মানুষ চরম দুর্ভোগে : এ্যাড. জুবায়ের
- রাজপথে ইস্পাতকঠিন ঐক্য গড়ে তুলুন : ড. রেজাউল করিম
- ইসলাম প্রচার সমিতির উদ্যোগে দুস্থ নওমুসলিমদের মাঝে কুরবানির গোশত বিতরণ
- উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধসে নিহত ৯
- সব দেশের সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চায় আফগানিস্তান
- ভারতে ফ্রিজে গরুর গোশত রাখার অভিযোগে গুঁড়িয়ে দেয়া হলো ১১টি মুসলিম বাড়ি