ভোট ২৮ জুন, চলছে শান্তিপূর্ণ প্রচারাভিযান
॥ ফেরদৌস আহমদ ভূইয়া ॥
মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আগামী ২৮ জুন। প্রেসিডেন্ট সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রাইসি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় শহীদ হওয়ার পর নির্ধারিত সময়ের এক বছর আগেই নতুন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হচ্ছে। ইসরাইলের সাথে প্রক্সি যুদ্ধ এবং তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এগিয়ে নেয়ার পশ্চিমা অভিযোগের মধ্যে এ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইরানে প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন প্রধান ধর্মীয় নেতার পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি। এবারের নির্বাচনে ৬ প্রার্থী প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ইতোমধ্যে প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারাভিযান চালিয়ে ভোটারদের কাছে ভোট চাচ্ছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা অনুযায়ী, এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইরানে ভোটার হচ্ছে ৬ কোটি ১৭ লাখ ১৭২ হাজার ২৯৮ জন। তবে নির্বাচনের দিন যাদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হবে, তারাও পরিচয়পত্র দেখিয়ে ভোট দিতে পারবেন। উল্লেখ্য, বর্তমানে ইরানের জনসংখ্যা প্রায় ৯ কোটি।
ইরানে সাধারণ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও মনোনয়ন ও প্রার্থিতা বাছাই করা হয়ে থাকে এক ব্যতিক্রমী পদ্ধতিতে। ইরানে ইচ্ছা করলেই কোনো নাগরিক প্রেসিডেন্ট বা অন্য কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হলে যেকোনো প্রার্থীকে ইরানের গার্ডিয়ান কাউন্সিল অর্থাৎ অভিভাবক পরিষদের কাছে আবেদন জানাতে হয়। অভিভাবক পরিষদ যাচাই-বাছাই শেষে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করে। এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক ৮০ রাজনীতিবিদ ইরানের গার্ডিয়ান কাউন্সিল বা অভিভাবক পরিষদে নাম নিবন্ধন করেছিলেন। যাচাই-বাছাই শেষে ৭৪ জনকে বাদ দিয়ে ছয়জনের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে। বাদ পড়াদের মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ও পার্লামেন্টের সাবেক স্পিকার আলি লারিজানিও রয়েছেন। আহমাদিনেজাদ ২০০৫ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন।
উল্লেখ্য, ইরানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্বাচন আয়োজন ও পরিচালনার মূল দায়িত্ব পালন করে থাকে। তবে প্রার্থিতা যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব হচ্ছে গার্ডিয়ান কাউন্সিল বা অভিভাবক পরিষদের। ১২ সদস্যের অভিভাবক পরিষদ উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি বডি, যারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে শুরু করে প্রতিটি নির্বাচনের প্রার্থী যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা করে থাকে। অভিভাবক পরিষদের যাচাই-বাছাইয়ে যে বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে, তা হচ্ছে দেশ জাতির প্রতি প্রতিশ্রুতি ও ইসলামী আদর্শের প্রতি আনুগত্যের বিষয়।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ১৪তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য চূড়ান্তভাবে যে ছয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়েছে, তারা হচ্ছেন- ১. মাসুদ পেজেশকিয়ান, তিনি বর্তমান সংসদ সদস্য ও মোহাম্মদ খাতামির শাসনামলের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসামন্ত্রী। ২. মোস্তফা পুরমোহাম্মাদী- হাসান রুহানির সরকারের বিচারমন্ত্রী ছিলেন। ৩. ড. সাঈদ জালিলি- ইরানের সাবেক প্রধান পরমাণু আলোচক এবং ইরানের নীতিনির্ধারণী পরিষদ সদস্য। তিনি ১৩তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রাইসির প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। ৪. আলী রেজা যাকানি- তেহরানের মেয়র ও সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। তিনিও ইব্রাহিম রাইসির প্রতি সমর্থন জানিয়ে গত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ান। ৫. সাইয়্যেদ আমির হোসেন কাজিজাদে হাশেমি- একাধিকবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও ৬. মোহাম্মদ বাকের কলিবাফ- তেহরানের সাবেক মেয়র ও ইরানের পার্লামেন্টের বর্তমান স্পিকার। যে ছয়জন প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হয়েছেন, তারা ব্যক্তিগতভাবেই প্রার্থী হয়েছেন। ইরানে কোনো রাজনৈতিক দল না থাকায় সব প্রার্থীকেই নির্দলীয়ভাবে প্রার্থী হতে হয়। গত ১২ জুন থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা শুরু হয়েছে এবং ২৭ জুন পর্যন্ত তা চলবে। আগামী ২৮ জুন শুক্রবার ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট গ্রহণ করা হবে।
ইতোমধ্যে টেলিভিশন বিতর্কে ছয় প্রার্থীই দেশের ওপর পশ্চিমা অবরোধ উঠানোর চেষ্টা করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে চার ঘণ্টাব্যাপী বিতর্কে তারা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে তাদের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। তারা মুদ্রাস্ফীতি, বাজেট ঘাটতি ও দুর্নীতি দমনে তাদের নিজ নিজ পরিকল্পনার কথাও টিভি বিতর্কে তুলে ধরেছেন। রাজনৈতিক দল না থাকলেও প্রার্থীদের মধ্যে রক্ষণশীল, মধ্যপন্থি ও সংস্কারপন্থি বলে কারো কারো পরিচিতি আছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মাসুদ পেজেশকিয়ান হচ্ছেন মধ্য ও সংস্কারপন্থিদের সমর্থিত প্রার্থী আর বর্তমান সংসদের স্পিকার মোহাম্মদ বাকের কলিবাফ হচ্ছেন সরকারের আস্থাভাজন। তাদের মধ্যে মূল ভোটের লড়াইটা হতে পারে। তবে কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, সাইদ জালিলিও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবেন। তবে ভোটের বাকি আরও এক সপ্তাহ, তাই মূল প্রতিযোগিতা কার কার মধ্যে হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কে হচ্ছেন প্রেসিডেন্ট, তার জন্য এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে।
গত ১৯ মে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রাইসি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ানসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা শহীদ হওয়ার পর এ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ইরানের সংবিধানের ১৩১ ও ১৩২ নম্বর ধারা অনুযায়ী, কোনো প্রেসিডেন্ট মৃত্যুবরণ করলে অথবা দায়িত্ব পালনে অক্ষম হলে সর্বোচ্চ ৫০ দিনের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হবে। সাংবিধানিক নিয়মেই যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
স্বৈরশাসক মার্কিনপন্থি রেজাশাহ পাহলভীর শাসনের অবসান ঘটিয়ে ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ইরানের জনগণ ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লব করে। তারপর থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান মার্কিনীদের নেতৃত্বে পশ্চিমা অবরোধ মোকাবিলা করেই বিগত ৪৫ বছর ধরে টিকে আছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশে^র অব্যাহত বিরোধিতা ও অবরোধের মোকাবিলা করে টিকে থাকার মূল শক্তি হলো ইরানের দৃঢ় প্রতিশ্রুতিশীল রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং নেতৃত্বের সাথে সাধারণ জনগণের ইস্পাতকঠিন সম্পর্ক। এত বড় একটি দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, কিন্তু কোনোরকম রাজনৈতিক হাঙ্গামা বা প্রার্থীদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী প্রচারাভিযান করে যাচ্ছেন। পশ্চিমারা; বিশেষ করে পশ্চিমা মিডিয়াগুলো এ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে বিভিন্নভাবে প্রচার চালাচ্ছে। কিন্তু এ পর্যন্ত খবরে যা জানা গেছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এ নির্বাচনে সরকার বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনোরকম পক্ষপাতিত্ব করার কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি। ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানের ধর্মীয় নেতা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দেশটির রাজনৈতিক ক্ষমতা ও দায়িত্বের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন। ইরানের বর্তমান রাজনৈতিক পদ্ধতিতে ধর্মীয় নেতা, প্রেসিডেন্ট, অভিভাবক পরিষদ, পার্লামেন্ট, বিশেষজ্ঞ পরিষদ ও সরকার তথা মন্ত্রিপরিষদের গঠন, ক্ষমতা, দায়িত্ব ও অধিকারের মধ্যে একটি চমৎকার ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা রয়েছে। বিগত ৪৫ বছর ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে শুরু করে পার্লামেন্ট, বিশেষজ্ঞ পরিষদ; এমনকি ধর্মীয় নেতা পর্যন্ত গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে থাকেন।
এ পাতার অন্যান্য খবর
- দিল্লি-বেইজিং দ্বন্দ্বক্ষেত্র ঢাকা?
- উৎসবের পর ফিরছে মানুষ
- জলবসন্তের জীবাণু থেকে সাবধান
- বছরে ৯২ হাজার কোটি টাকা পাচার হয় : সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী
- মুসলমানদের ইতিহাস মুছে দিচ্ছে চীন
- সেন্টমার্টিন কি বিচ্ছিন্ন
- ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে : নূরুল ইসলাম বুলবুল
- পানিবন্দি মানুষ চরম দুর্ভোগে : এ্যাড. জুবায়ের
- রাজপথে ইস্পাতকঠিন ঐক্য গড়ে তুলুন : ড. রেজাউল করিম
- ইসলাম প্রচার সমিতির উদ্যোগে দুস্থ নওমুসলিমদের মাঝে কুরবানির গোশত বিতরণ
- উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধসে নিহত ৯
- সব দেশের সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চায় আফগানিস্তান
- ভারতে ফ্রিজে গরুর গোশত রাখার অভিযোগে গুঁড়িয়ে দেয়া হলো ১১টি মুসলিম বাড়ি