আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ চায় জনগণ
১ মে ২০২৫ ১৭:৩০
॥ জামশেদ মেহদী॥
আজ প্রায় ৯ মাস হতে চললো, আওয়ামী লীগ সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো না। যে দলটি বিগত সাড়ে ১৫ বছর সীমাহীন এবং সংখ্যাহীন অপকর্ম এবং দুষ্কর্ম করেছে, সেই দলটি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব শুধুমাত্র সরকারের নয়; সবগুলো রাজনৈতিক দলের। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা তো দূরের কথা, কোনো কোনো মহল থেকে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের কথাও পরোক্ষভাবে বলা হচ্ছে। যেসব অপরাধে আওয়ামী লীগ অভিযুক্ত, সেসব অপরাধ আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ ব্যক্তি অর্থাৎ শেখ হাসিনার হুকুমে করা হয়েছে। আর সেই হুকুম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়াও আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা পর্যন্ত তামিল করেছে। তারপরও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে নানা ফন্দি-ফিকির করা হচ্ছে।
অথচ দেখুন, ১৯৭২ সালের সংবিধানের কথা। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে যে গণহত্যা হয়েছে, সেটা করেছে পাকিস্তানে সেনাবাহিনী। পক্ষান্তরে ভারতের হিমাচল প্রদেশের শিমলায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চুক্তি হয়েছে ১৯৭২ সালের ২ জুলাই। এ চুক্তিতে ছিল দুটি পক্ষ। একটি ভারতীয় পক্ষ। তাদের নেতা ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। অপরটি ছিল পাকিস্তান পক্ষ। তাদের নেতা ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। অথচ বিরোধটির কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে পাকবাহিনী এবং বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর মধ্যে চলছিল যুদ্ধ বা গেরিলা যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে ৯০ হাজার শরণার্থী ছিল। মুক্তিবাহিনী গঠিত হয় ভারতে। তারা ভারতেই প্রশিক্ষণ লাভ করে এবং ভারতই তাদের অস্ত্রশস্ত্র দেয়। সেই ট্রেনিং এবং অস্ত্র নিয়ে গেরিলারা বাংলাদেশের ভেতরে এসে পাকবাহিনীর ওপর এ্যাম্বুশ করে এবং অপারেশন সেরে ভারতে স্থাপিত আস্তানায় ফিরে যায়।
এভাবেই চলে ৯ মাস। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারত সরাসরি এ যুদ্ধে অংশ নেয়। তারা যুগপৎ পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) স্থল ও বিমান হামলা করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ১৫ দিনের যুদ্ধের পর পাকবাহিনী রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করে। এ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও রহস্যজনক কারণে তিনি অনুপস্থিত ছিলেন।
পাকবাহিনী একদিকে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেছে। তৎকালীন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি দল ঐ গণহত্যায় কমান্ডও দেয়নি বা সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে বা হত্যাকা-ে অংশগ্রহণ করেনি। অথচ ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের যে সংবিধান প্রণীত এবং গৃহীত হয়, সেই সংবিধানে শুধু ঐসব রাজনৈতিক দলই নয়, বরং সমগ্র ইসলামী রাজনীতিই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। অথচ নাস্তিক্যবাদী কমিউনিজম বহাল থাকে এবং কমিউনিস্ট পার্টি ও সমাজতান্ত্রিক পার্টিকে রাজনীতি করার অনুমতি দেওয়া হয়। যদিও কমিউনিজমের আদর্শে বিশ্বাসী কয়েকটি রাজনৈতিক দল পাকিস্তানের পক্ষে ছিল।
এ পটভূমি সবসময় মাথায় রাখতে হবে। ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো পাকবাহিনীর নির্যাতনে কোনো কমান্ড পজিশনে ছিল না। যে রাজাকারদের কথা যখন-তখন বলা হয়, সেই রাজাকারদের সংখ্যা কত ছিল? রাজাকারদের হাতে কতজন মানুষ নিহত হয়েছেন? সেই পরিসংখ্যান বিগত ৫৪ বছরেও পাওয়া যায়নি। যে ইসলামী রাজনৈতিক দলসমূহ আদর্শিক ভাবে বিশ^াস করত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা তারাও চান। কিন্তু যে স্বাধীনতা দেশকে ভারতীয় প্রভুত্বের গোলাম বানাবে, তেমন স্বাধীনতা অর্থবহ হতে পারে না। শুধুমাত্র এ বিশ^াসের জন্য কোনোরূপ আইনকানুন ছাড়াই, কোনোরূপ বিচার-আচার ছাড়াই সেদিন ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল। আজ জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানও বলছে, ২১ দিনের জুলাই বিপ্লবে ১৪শত ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছেন এবং সেই ভয়ঙ্কর গণহত্যা ঘটেছে সরাসরি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এবং এ গণহত্যায় সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী। এরপর তো আর কোনো প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। তারপরও আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো পক্ষ থেকেই কোনো স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না।
গত ২৬ এপ্রিল শনিবার ‘আল জাজিরাকে’ প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে এ ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, Asked if the Awami League will be allowed to take part in the polls, Yunus said, `We don’t know yet, they [AL] have not declared anything. He said once the declaration comes, then the matter of the response from the Election Commission and other factors will arise. Then there are other parties who may say that under this law they cannot participate and so on, he added.’
অনুবাদÑ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে কিনা, এ মর্মে জিজ্ঞাসিত হলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা সেটা জানি না। তারা এখন পর্যন্ত এ সম্পর্কে কোনো ঘোষণা দেয়নি। তিনি বলেন, একবার তারা এ সম্পর্কে কোনো ঘোষণা দিলে নির্বাচন কমিশন থেকে কি উত্তর দেওয়া হয়, সেটি এবং তার সাথে সাথে অন্যান্য প্রশ্নও উঠে আসবে। এছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলও রয়েছে। তারা বলতে পারে যে, অমুক আইনে তারা (আওয়ামী লীগ) নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের এ উত্তরটি দ্ব্যর্থবোধক। আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে কিনা, সেটার জন্য কি দেশবাসী আওয়ামী লীগের ঘোষণার জন্য বসে থাকবে? আমরা একটু আগে দেখলাম যে, বাংলাদেশের জন্মের সাথে সাথে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে গেল। অনুরূপভাবে গত ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের উপদেষ্টা পরিষদের শপথ গ্রহণের পরপরই আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দেখা গেল আওয়ামী লীগ নয়, এমনকি ছাত্রলীগকেও নিষিদ্ধ করা না করা নিয়ে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস্য দোলাচল ছিল। তারপরও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের প্রচ- চাপে ঝটপট ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হলো। যদি সেদিন ঐভাবে ঝড়ের গতিতে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা না হতো, তাহলে আওয়ামী লীগের মতো ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টিও ঝুলে থাকতো।
মানুষ ঠিক বুঝতে পারছে না যে, আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ ঘোষণার ব্যাপারে কেন এত গড়িমসি। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা যেত দুটি পন্থায়। প্রথমটি হলো নির্বাহী আদেশে দলটিকে নিষিদ্ধ করা। হিযবুত তাহরীরকে হাসিনা সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে নির্বাহী আদেশে। তেমনি ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের কয়েকদিন আগে ১ আগস্ট নির্বাহী আদেশে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ৫ আগস্টের পর নিষিদ্ধের এ আদেশ উঠে যায়।
আরেকটি পদ্ধতি হলো দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার আবেদন জানিয়ে মামলা করা। হাসিনা সরকার আদালতের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ২০১৩ সালে বাতিল করে। এ বাতিল আদেশ প্রত্যাহার করে নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার জন্য জামায়াত সংশ্লিষ্ট আদালতে আপিল করে। কিন্তু সাড়ে ৮ মাস হয়ে গেল, জামায়াত আজও নিবন্ধন ফিরে পায়নি। সেই একই সাড়ে ৮ মাস পার হয়ে গেল, কিন্তু আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধও হয়নি, তার নিবন্ধনও বাতিল হয়নি।
রাজনৈতিক মহলের একটি অংশ প্রস্তুতি নিচ্ছিল যে, আদালতে মামলা করে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের আবেদন জানানো হবে। এ সরকারের আমলে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) গঠনের সময় এ বিধান রাখা হয়েছিল যে, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী দলের বিচার করা যাবে। কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে সেই প্রস্তাবিত আইনটি বদলে বলা হয়, আইসিটির আইনে কোনো দল বা সংগঠনকে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী এবং বিচার করা যাবে না। এ আইন মোতাবেক এটি এখন স্পষ্ট, কোনো আইনি পথে আওয়ামী লীগের বিচার বা দলটিকে নিষিদ্ধ করা যাবে না।
তাহলে খোলা থাকলো একটিই পথ। সেটি হলো, নির্বাহী আদেশ। সেটিও সরকার করবে না। সরকার এর আগে বলেছে, রাজনৈতিক দলগুলো যদি এ ব্যাপারে একমত হয়, তাহলে সেই মোতাবেক ব্যবস্থা গৃহীত হবে। এ ব্যবস্থার মধ্যে থাকতে পারে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা অথবা পরবর্তী তিনটি নির্বাচনে দলকে অংশগ্রহণ করতে না দেওয়া।
এ ব্যাপারে বিএনপি বলেছে যে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার তারা কে? এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ। বিএনপির নিকট থেকে জানতে ইচ্ছে করে, জনগণ কীভাবে সিদ্ধান্ত নেবে? আগামী ডিসেম্বরে হোক বা আগামী বছরের জুনে হোক, নির্বাচন তো হচ্ছে। তার আগে জনগণ কীভাবে সিদ্ধান্ত নেবে? গণভোটের বিধান বর্তমানে বিদ্যমান সংবিধানে নেই। তাহলে জনগণ মতামত দেবে কীভাবে?
বিএনপি গত বছরের ৮ আগস্ট থেকে আজ পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে, লাগাতার নির্বাচনের কথা বলে যাচ্ছে। তারা বর্তমান সংবিধানের অধীনেই নির্বাচন দাবি করছে। তাই যদি হয়, তাহলে আওয়ামী লীগ চাইলে সেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। কারণ যেহেতু নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে না আবার আইসিটিতেও কোনো দলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে মামলা করা যাবে না, তাহলে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার আর কোনো রাস্তা খোলা আছে কি? আমরা তো দেখছি না।
কেন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না? এর সঠিক জবাব সম্ভবত দিয়েছেন সাবেক বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতা এবং বর্তমানে এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার কথা বললে সরকার পশ্চিমাদের দোহাই দেয়। তিনি প্রশ্ন করেন, কোথায় ছিল পশ্চিমা বিশ^, যখন বিডিআর ম্যাসাকার হয়, যখন শাপলায় আলেম-ওলামাদের গণহত্যা হয়, যখন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদ-াদেশের বিরুদ্ধে জনগণ রাজপথে নেমে এলে বেপরোয়া গুলিবর্ষণে ২৫৩ প্রতিবাদকারীকে হত্যা করা হয় এবং যখন জুলাই বিপ্লবে ১৪শত মানুষকে ২১ দিনে হত্যা করা হয়?
এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। আওয়ামী লীগ কি নির্বাচন করতে পারবে? তারও কোনো জবাব নেই।
তবে সারা দেশের জনগণের দাবি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের এ দেশে রাজনীতি করার অধিকার নেই। গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে পারে। জার্মানিসহ বিশে^র অনেক দেশেই ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফ্যাসিস্ট দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা হোক এটাই জনগণের দাবি।