ফ্যাসিস্ট আ’লীগ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদ নির্মূল করতে হবে

গড়তে হবে দেশপ্রেমিকদের ঐক্য


১৫ মে ২০২৫ ১৪:৫৮

॥ জামশেদ মেহদী॥
আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গ সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে গত ১২ মে সোমবার সরকারি গেজেট প্রচারিত খবরে বলা হয়, “যেহেতু সরকারের নিকট যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গ সংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল ও অকার্যকর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকাসহ জনমনে ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসী সংগঠনের মতো বিভিন্ন বেআইনি কার্যকলাপ ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। সেহেতু সরকার যুক্তিসংগতভাবে মনে করে সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর ধারা-১৮(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গ সংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটি এবং এর সব অঙ্গ সংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা সমীচীন।”
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গ সংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গ সংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন কর্তৃক যেকোনো ধরনের প্রকাশনা, গণমাধ্যম, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেকোনো ধরনের প্রচারণা, মিছিল, সভা-সমাবেশ, সম্মেলন আয়োজনসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।”
সরকারের গেজেট নোটিফিকেশন বেশ বড়। এর অংশবিশেষও বড়। তবুও আমরা অংশবিশেষের বেশ বড় অংশ হুবহু উদ্ধৃত করলাম একটি বিভ্রান্তি দূর করার উদ্দেশ্যে। গত ১১ মে থেকে একটি মহল থেকে বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগকে সরাসরি ব্যান্ড করে কেন সরকারি ফরমান জারি হলো না? কেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলো? উত্তরটি খুব পরিষ্কার।
সরকার এবং দেশের সব বিরোধীদল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হোক, সেটা চায়। আবার ঐ দিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়; বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব চায় না, কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হোক। তবে রাজনীতির নামে যদি কোনো দল বা গোষ্ঠী সন্ত্রাসী তৎপরতায় লিপ্ত হয়, তাহলে সেই দল বা গোষ্ঠীকে নিষিদ্ধ ঘোষণায় তাদের আপত্তি নেই। তবে সেটি আইনগতভাবে করা দরকার। বিগত ১৫ বছর ধরে এদেশের মানুষ দেখেছেন, শাসনকার্যের নামে, রাজনৈতিক দল পরিচালনার নামে আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনগুলো হেন অপরাধ নাই, যা তারা করেনি। প্রত্যেকটি অপরাধের অকাট্য প্রমাণ সরকার এবং একশ্রেণির নাগরিক সমাজের হাতে রয়েছে। আদালতের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে প্রমাণ করা মোটেই কঠিন হবে না। কিন্তু যেহেতু আদালতের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা সময়সাপেক্ষ এবং যেহেতু সেই সময়ের মধ্যে আওয়ামী দুষ্কৃতকারীরা অনেক অঘটন এবং অনর্থ ঘটাতে পারে, তাই ঐ মধ্যবর্তী সময়ে তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হলো, যাতে করে তারা দেশের পরিস্থিতি ডিস্টাবিলাইজড করতে না পারে। জার্মানিতে নাৎসি পার্টি নিষিদ্ধ হয়েছে এবং পাশাপাশি বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী নুরেমবার্গ ট্রায়াল বা বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
সত্যি কথা বলতে কী, গত ৫ আগস্ট সারা দেশে লাখ লাখ নয়, কোটি কোটি মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, সোয়াত প্রভৃতি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে শেখ হাসিনাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছেন। আসলে গত বছরের জুলাইয়ের ১৫ তারিখ থেকে আগস্টের ৫ তারিখ পর্যন্ত এই ২২ দিনেই দেশের সর্বশ্রেণির মানুষ তাদের মারমুখো আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার রায় পরোক্ষভাবে দিয়েছেন। ৮ তারিখে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দায়িত্বভার গ্রহণের পূর্বেই প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে সাবেক জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। ইউনূস সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করা দরকার ছিল। এটি ছিল সরকারের একটি টেকনিক্যাল মিসটেক। আরও অনেক কিছুই করা উচিত ছিল যেটা সেই সময় করলে সঠিক হতো।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ঐরঃ ঃযব রৎড়হ যিবহ রঃ রং যড়ঃ. অর্থাৎ লোহা বাঁকাতে হলে যখন সেটি গরমে লাল হয়ে গনগন করে, তখনই লোহা বাঁকাও। বিপ্লবের অব্যবহিত পর রাজনৈতিক উত্তাপ যখন ছিল সর্বোচ্চ, তখনই কিছু বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার ছিল। কেন সেগুলো নেওয়া হয়নি, সেগুলো আজও অনেকের কাছে প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে আছে। দু-একটি উদাহরণ দিই।
৫ আগস্ট যখন শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেন, তখন রাজনৈতিক নেতারা ক্যান্টনমেন্টে গেলেন কেন? যে ছাত্রদের নেতৃত্বে বিপ্লব হলো, সেই ছাত্র নেতৃত্ব দুপুর বা বিকেলে সেনা সদরে ছিলেন না কেন? উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের সময় ছাত্র নেতৃত্বকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি কেন? বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিনকে ক্ষমতায় রাখা এবং সংবিধানকে বাতিল বা স্থগিত না রাখার সিদ্ধান্ত কে বা কারা নিয়েছিলেন? দেশে ঘটে গেল বিপ্লব। কিন্তু ৮ আগস্টের সরকারকে মুজিববাদী সংবিধানের (৭২-এর সংবিধান) মধ্যে ঢুকিয়ে দিল কারা? কেন? ইউনূস সরকার দায়িত্ব গ্রহণের অব্যবহিত পরেই আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী সংগঠন এবং তার দোসর সংগঠনগুলোকে (জাতীয় পার্টি, জাসদ ইনু, মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি) নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো না কেন?
গতস্য শোচনা নাস্তি। যা ঘটে গেছে, সেটি নিয়ে আর বিলাপ করায় কোনো লাভ নেই। বরং ইংরেজি প্রবাদের মতো, ইবঃঃবৎ ষধঃব ঃযধহ হবাবৎ. অর্থাৎ না হওয়ার চেয়ে দেরিতে হওয়া ভালো। তাই ৯ মাস পরে হলেও আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর কার্যক্রম যে নিষিদ্ধ করা সম্ভব হয়েছে, তার জন্য এনসিপিসহ ৩৫টি সংগঠন, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরকে ধন্যবাদ।
গত ৪-৫ দিনে ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানের খোঁজখবর এবং প্রতিক্রিয়া থেকে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের সর্বশ্রেণির মানুষ উল্লসিত। তারা বলছেন যে, এর মাধ্যমে দেশ আর একটি হানাহানি থেকে বেঁচে গেল। কারণ এ নিষিদ্ধের বিষয়টি যদি পরবর্তী সংসদের সিদ্ধান্তের জন্য ঝুলিয়ে রাখা হতো, তাহলে আইনগতভাবে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখার কোনো যুক্তি থাকতো না। কিন্তু শুধু ঢাকা নয়, মফস্বলের পল্লী অঞ্চল থেকেও দেখা গেছে, যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিত তাহলে অন্যান্য রাজনৈতিক দল তো দূরের কথা, সাধারণ মানুষও আওয়ামী প্রার্থী এবং তার সমর্থকদের ধাওয়া দিতেন। সেই ধাওয়ার মুখে আওয়ামী লীগ যদি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করত তাহলে সারা দেশে হানাহানি ছড়িয়ে পড়তো।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার পর মির্জা ফখরুল বিবৃতি দিয়েছেন যে, দেশের ১৮ কোটি মানুষ আওয়ামী লীগকে দেখতে পারে না। কিন্তু আবার সেই একই মির্জা ফখরুল বিগত ৯ মাস ধরে বিরতিহীনভাবে বলে যাচ্ছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার তারা কে? এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবে তো জনগণ। এসব কথা এতই বালখিল্যতার পরিচয় দেয় যে, সেসব কথার জবাব দেওয়াটাও গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। তবে অনেকে ভাবেন, বিএনপির মধ্যে কি কোনো সমন্বয় নেই?
যদি সমন্বয়ই থাকবে, তাহলে আগের দিন মির্জা ফখরুল নিষিদ্ধ ঘোষণার কাজকে সমর্থন করার পরদিন অর্থাৎ ১২ মে সোমবার আর এক সিনিয়র নেতা মির্জা আব্বাস শাহবাগের গণজমায়েতকে নাটক বলেন কীভাবে?
এ প্রসঙ্গে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মাহফুজ আলমের গত ১০ মে শনিবার রাতের এক ফেসবুক স্ট্যাটাসের কথা উল্লেখ না করে পারছি না। তাঁর স্ট্যাটাসের শিরোনাম, ‘দুটি কথা’। সেখানে তিনি ৭১-এর প্রশ্ন মীমাংসা, যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগীদের ক্ষমা চাওয়া, পাকিস্তান পন্থা বাদ দেওয়া, ইনিয়ে-বিনিয়ে পাকিস্তানিদের গণহত্যার পক্ষে বয়ান অবতারণা করলেন কেন? তিনি তো সরকারের একজন উপদেষ্টা, অর্থাৎ মন্ত্রী। তিনি কোন ক্যাপাসিটিতে এসব কথা বললেন? মন্ত্রী হিসেবে? তাহলে তো সেটা হয় সরকারের কথা। তাই কি? আর যদি পার্সোনাল ক্যাপাসিটিতে দিয়ে থাকেন, তাহলে মন্ত্রীর চেয়ারে বসে সেটা তিনি দিতে পারেন না। সেক্ষেত্রে এটা তার মন্ত্রিত্বের শপথ ভঙ্গ হয়। এসব কথা বলতে চাইলে তিনি মন্ত্রিত্ব ছাড়েন না কেন? মন্ত্রিত্ব ছেড়ে জনতার কাতারে নেমে এসে একজন পলিটিশিয়ান হিসেবে কথা বলুন। যাকে ইচ্ছা তাকে সমর্থন করুন। যাকে ইচ্ছা তার সমালোচনা করুন। কেউ কিছু বলবে না।
সব শেষে একটি কথা। গত ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবের ৩২ নম্বরের বাড়ি ছাত্র-জনতা সম্মিলিতভাবে ভেঙে দিয়েছেন। ঐদিন এবং তার পরের দুই দিন সারা দেশে শেখ মুজিব এবং তার এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলির সব সদস্যের মূর্তি, ম্যুরাল এবং অন্যান্য চিহ্ন মুছে ফেলা হয়। সেদিনও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা যেত।
এবার নতুন করে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলন শুরু হয় সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের দেশত্যাগের পর। সরকারের হোমড়া-চোমড়া এবং বিমানবন্দরের কর্তাব্যক্তিদের নাকের ডগার ওপর দিয়ে কীভাবে ১০ বছর রাষ্ট্রপ্রধানের পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি বিদেশ যেতে পারলেন, সেই প্রশ্ন দেশের সব সচেতন মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরই সূত্র ধরে যখন গত ৯ মে শুক্রবার এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ এনসিপির কয়েকজন নেতাকর্মীকে সাথে নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার সামনে বসে পড়েন, তখন সারা দেশের টনক নড়ে। পরদিন হাসনাত আব্দুল্লাহর এ অবস্থানকে জোরদার করার জন্য এনসিপি, হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবির সেই অবস্থানে অংশগ্রহণ করে। শান্তি-শৃঙ্খলায় যাতে ব্যাঘাত না ঘটে, সেজন্য পরদিন অবস্থানটি যমুনা থেকে স্থানান্তর করা হয়। ঘোষণা দেওয়া হয়, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ না করা পর্যন্ত তারা রাজপথ ছেড়ে যাবেন না। তারই ফলে ১২ মে’র এ গেজেট নোটিফিকেশন।
এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে এনসিপি, জামায়াত, হেফাজতসহ দেশপ্রেমিক শক্তির মধ্যে যে ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে, যেকোনো মূল্যে সেই ঐক্য ধরে রাখতে হবে। শুধু তাই নয়, এ ঐক্যের পরিধি আরো বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে একটি জোটও গঠন করা যেতে পারে। সেই জোটের সেন্ট্রাল পয়েন্টস হবে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও প্রভুত্ববাদকে নির্মূল করা এবং আওয়ামী লীগসহ সব ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারকে চিরদিনের জন্য বাংলার রাজনীতি থেকে উৎখাত করা। যদি এ দুটি ইস্যুতে বৃহত্তর ঐক্য গঠন করা যায়, তাহলে সেটি বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক নতুন দিগন্তের সৃষ্টি করবে।