প্রসঙ্গ : জঞ্জাল পরিষ্কার, জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর

একেএম রফিকুন্নবী
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০০

॥ একেএম রফিকুন্নবী ॥
আগস্ট বিপ্লবের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর দায়িত্ব পড়েছে দেশের গত ৫৩ বছরের আবর্জনা-জঞ্জাল পরিষ্কার করে দ্রুততম সময়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের। জনগণ অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে, রক্ত দিয়েছে, গুম হয়েছে, আহত হয়ে বিছানায় কাতরাচ্ছে। তাই এ বৈষম্য দূর করে ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে সার্থক করে তুলতে হবে। সাথে সাথে শহীদ পারিবারগুলোর পুনর্বাসন করতে হবে। তাদের পিতা-মাতা, ভাই-বোনদের ভবিষ্যৎ চলার সব দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। যারা আহত আছেন, পঙ্গুত্ববরণ করেছেন, তাদের চিকিৎসার সব দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। আহতদের গ্রাম থেকে শহর সব জায়গা থেকে স্থানীয় উপজেলা কর্মকর্তার মাধ্যমে এবং শহরগুলো থেকে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে তালিকা করে সরকারের কাছে দ্রুত পৌঁছাতে হবে। শহীদ ও আহতদের সাহায্য করা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। এখানে কোনো প্রকার কার্পণ্য করা যাবে না।
ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন অতিবাহিত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভাষণ দিলেন সাহসিকতার সাথে আস্থাশীলতার সাথে আগামী দিনের আশাব্যঞ্জক কথা বললেন। তাদের এ সময়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় বললেন, গোটা দুনিয়ার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো হয়েছে। দেশে-বিদেশে প্রধান উপদেষ্টার সাথে বড় বড় দেশের নেতাদের আলাপ হয়েছে, কথা হয়েছে, বাংলাদেশের সাথে তারা আছে।
ইতোমধ্যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সাধ পাওয়া শুরু হয়েছে। ৫৩ বছরে এমন স্বাধীনভাবে পত্রপত্রিকা কথা বলতে পারেনি। উপদেষ্টাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সমালোচনা করুন, সাথে সাথে পরামর্শ দিন। সাংবাদিকদের নির্যাতনমূলক আইন বাতিল করা হয়েছে। এ আইনে গ্রেফতারকৃত সাংবাদিকদের ছেড়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ভালো উদ্যোগ।
দেশে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ উদ্দেশ্যে সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য ৫ জন করে নাম দেয়ার অনুরোধ করেছিলেন। সব দল তাদের পছন্দমতো লোকের নাম ইতোমধ্যেই দিয়ে দিয়েছে। আশা করা যায়, স্বল্পসময়ের মধ্যেই নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। ভোটার তালিকা আপডেট করতে হবে। সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন হবে, না আগের মতোই হবে- তা ঠিক করতে হবে। জামায়াতে ইসলামীসহ বেশিরভাগ দলের ভোট পাওয়ার ওপর নির্ভর করে দলীয় সংসদ সদস্য নির্ধারিত হবে। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনে কোনো দলের সংসদ থেকে বাইরে থাকার সম্ভাবনা কম। সব দলের অংশগ্রহণে সংসদ কার্যকরী হবে। দেশের লাভ হবে, দলেরও লাভ হবে। কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠ পাওয়ার কারণে স্বৈরাচারী হতে পারবে না। আবার বাকশালী কায়দায় দেশ শাসন করতে পারবে না।
ইতোমধ্যে আইনকাঠামো সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বেশকিছু বৈঠকও ভারপ্রাপ্ত উপদেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন গ্রুপের পরামর্শ নেয়া হচ্ছে। বিচারপতিরা যাতে স্বাধীনভাবে বিচারকার্য করতে পারেন, তার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফরমায়েশি রায় যাতে না দিতে হয়, তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আইন সংস্কার দেশের জন্য একটি বড় কাজ। শুধু টাকার জোরে বা খুঁটির জোরে যাতে কেউ বিচার প্রভাবান্বিত করতে না পারে, তার নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করার কাজ চলছে।
পুলিশ বিভাগ দেশে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত, ফ্যাসিবাদী রাজনীতির কবলে পড়ে জনগণের আস্থাহীনতার বাইরে চলে গেছে। আগস্ট বিপ্লবের পর দেশের প্রায় সব থানার ওসিসহ সবাই থানা খালি করে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এখনো অনেক পুলিশ অফিসার ও সাধারণ পুলিশ সদস্য কাজে যোগ দেননি। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। দেশের মানুষের টাকায় যাদের বেতন হয়, তারা কি করে জনগণের বিপক্ষে দাঁড়াতে পারে? গুলি করতে পারে? গায়েবি মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে দীর্ঘদিন জেলে ভরে রাখতে পারে? স্বাধীন দেশে এটা চলতে পারে না। তাই পুলিশ বিভাগের জন্য কমিশন করে সৎ, যোগ্য লোক নিয়োগ করতে হবে। পুলিশ বিভাগে এখন যারা কাজ করছেন, তাদের মোটিভেশন করে পুলিশের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। পুলিশকে জনগণের বন্ধু হতে হবে, প্রয়োজনে তাদের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে দিতে হবে। যাতে করে তারা টাকার পেছনে না ঘুরে বা ঘুষ বাণিজ্যে জড়াতে না পারে। জনগণকেও সজাগ থাকতে হবেÑ যাতে করে কেউ পুলিশকে টাকা দিয়ে অন্যায় করাতে না পারে। ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারদেরও প্রশিক্ষণ দিয়ে জনগণের বন্ধু হওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
আমাদের দেশ আমলানির্ভর। আমলাদের চাকরিতে নেয়ার সময়ই সততার বিষয় দেখতে হবে। ছাত্রজীবন এবং পারিবারিক জীবনে তিনি সততার সাথে জীবন চালিয়েছেন কিনা, তা তদন্ত করেই তাদের চাকরি কনফার্ম করতে হবে। কোনোভাবেই স্বৈরাচারীর দোসরদের চাকরিতে নেয়া যাবে না। বর্তমানে যারা চাকরিতে আছেন, তাদের ব্যাপারেও তদন্ত করতে হবে। কারা দলবাজি করে চাকরির দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছেন, ঘাপটি মেরে যারা স্বৈরাচারের পক্ষে কাজ করেছেন, তাদের অবশ্যই বিতাড়িত করতে হবে। তারা যাতে ভবিষ্যতে চাকরির ফাঁকে খারাপ চিন্তা করতে না পারেন, তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কোনো প্রকার দলবাজ লোকদের দায়িত্বে রাখা যাবে না। অনেকে সুযোগ বুঝে ভোল পাল্টাতে পারেন, তার খবর রেখেই সামনে এগোতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। কারণ দেশটা কোনো দলের না। দেশটা সবার। এ নীতিতেই সামনে এগোতে হবে।
দলবাজি, চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। স্বৈরাচার গেলেও তাদের প্রেতাত্মারা এখনো সমাজে লুকিয়ে আছে। তারা বিএনপির ওপর ভর করে সমাজে দুর্নীতি, চাঁদাবাজির কাজ চালাচ্ছে। কয়েক জায়গায় নিজেরা নিজেরা মারামারি করছে। মিডিয়া-পত্রপত্রিকায় ছবিসহ তাদের খবর আসছে। কঠোর হাতে এর প্রতিবাদ করতে হবে। ইতোমধ্যেই তারেক জিয়াসহ বিএনপির কেন্দ্রের নেতারা এর প্রতিকারের উদ্যোগ নিয়েছেন। অনেককে বহিষ্কার করেছেন। কিন্তু খুব একটা ফল হয়নি। আমরা সাধারণ জনগণ এরূপ প্রত্যাশা করি না। যদি আগের স্বৈরাচারীর মতোই এখন হয়, সরকারের দল চাঁদাবাজি, হাটবাজার দখলবাজিতে তৎপর হয়, তাহলে ভবিষ্যতে জনগণ ভিন্ন চিন্তা করতে পারে। তাই এখনই দৃঢ়তার সাথে চাঁদাবাজি, দখলবাজি বন্ধ করতে হবে।
উল্লেখ্য, এখন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবিরের কোনো লোক কোথাও কোনো চাঁদাবাজি, দখলবাজিতে জড়িত হয়নি। এটা তাদের বড় পাওনা। তাই তো হাটবাজারে রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, সাধারণ মানুষ কিন্তু জামায়াতের লোকদের প্রশংসা করছে। সব দলই তো দেখা হলো, এবার জামায়াতকেই ক্ষমতায় দেখতে চাই বলে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। আমরা সবার ঐক্য চাই, দেশটাকে আর স্বৈরাচারের দোসর বানাতে চাই না।
সম্প্রতি প্রকাশ হয়েছে ব্যাংকের ঋণখেলাপি হয়েছে দুই লাখ পঁচাশি হাজার কোটি টাকা। এ টাকা জনগণের। ঋণখেলাপিরা এ দেশেরই মানুষ। তাদের ছাড় দেয়া যাবে না। বেশিরভাগ লোকই পতিত স্বৈরাচারের সমর্থক। তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। মিল-কারখানা প্রশাসক বসিয়ে তা চালু রাখতে হবে। কোনোভাবেই শিল্প-কারখানা বন্ধ করে শ্রমিকদের ক্ষেপানো যাবে না। উৎপাদন চালু রেখে দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও পাঠাতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার আমদানি চালু করতে হবে।
ইতোমধ্যে বিদেশে কর্মরতরা তাদের ঘামের পয়সা দেশে পাঠাতে শুরু করেছেন। পূর্বের তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উন্নতির দিকে। রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের জন্য ইতোমধ্যে বিমানবন্দরে বিশেষ সুযোগ দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা এ সুযোগ উদ্বোধন করেছেন। বিদেশে অবস্থাকারীরা যদি বুঝতে পারেন, তাদের টাকার সৎ ব্যবহার হবে, তারা নিশ্চিন্তে দেশে টাকা পাঠাবেন। ৮৪ বছরের প্রবীণ উপদেষ্টা যেভাবে দুনিয়া কাঁপিয়ে উপদেষ্টাদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। বিদেশে দূতাবাসের লোকজন যেভাবে তার সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিচ্ছেন। বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানগণও সাক্ষাৎ ও টেলিফোনে যোগাযোগ রাখছেন- এটা বাংলাদেশের জন্য এক অবিস্মরণীয় পাওনা। আমরা আশা করব, বর্তমান সরকার দেশটাকে একটি যুগোপযোগী করে দেশের রাজনৈতিক সরকারের কাছে তুলে দেবে। রাজনৈতিক দলগুলো সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে যাতে দলবাজি না করে জনগণের চিন্তা করে। পাওয়ার চেয়ে দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে কাজ করে, তবে এ দেশের মানুষ ভালো থাকবে। দেশ ভালো থাকবে। কোনো দেশের প্রতি নতজানু হয়ে থাকতে হবে না। স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। কারো গোলামি করা যাবে না। মহান আল্লাহ আমাদের ৫ আগস্টের মতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন, ইনশাআল্লাহ।
বিদেশিদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার চেষ্টা করতে হবে। দেশেও যারা অবৈধভাবে টাকা জমা করে রেখেছে, তাও বের করার চেষ্টা করতে হবে। অনেক আমলা, পুলিশ অফিসার, অসাধু ব্যবসায়ীর অবৈধ টাকা জনগণের কাছে ফেরত আনতে হবে। এ ব্যাপারে সৎ ও যোগ্য গোয়েন্দাদের কাজে লাগাতে হবে। যেহেতু উপদেষ্টাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই, তাই তারা উদ্যোগ নিলেই পাচার করা টাকা এবং দেশে অবৈধ জমানো টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হবে, ইনশাআল্লাহ।
উপদেষ্টা নেয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য না করে দেশের সব এলাকার যোগ্য, সৎলোক নিতে হবে। আগস্ট বিপ্লবে কিন্তু ছাত্র-জনতা বৈষম্য দূর করার জন্যই মাঠে নেমেছিল। তাই আমরা যেন বৈষম্য না করে সবার অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করি। উত্তরবঙ্গ হলো খাদ্যের ভাণ্ডার। ২৪ জন উপদেষ্টার মধ্যে একজনও উত্তরবঙ্গের ১৭ জেলা থেকে নেয়া হয়নি। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পূর্বেই সমাধান করা বুদ্ধিমানের কাজ। ইতোমধ্যেই উত্তরবঙ্গের; বিশেষ করে রংপুরের শহীদ আবু সাঈদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে উত্তরবঙ্গ থেকে একাধিক উপদেষ্টা নেয়া খুবই জরুরি।
বাজার নিয়ন্ত্রণের কাজ গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। সাধারণ জনগণ বাজারে গিয়ে কূলকিনারা পাচ্ছেন না। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার অস্থিতিশীল করা হচ্ছে। গ্রাম থেকে শহরে বাজারে ছাত্র-জনতাকে সাথে নিয়ে প্রশাসনের লোকেরা বাজার মনিটরিং করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। মোহাম্মদপুরে দেখলাম, ছাত্ররা বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দোকান সাজিয়ে পণ্যের দাম লিখে বিক্রয় করছেন। ভালো উদ্যোগ। পরীক্ষামূলকভাবে সব জায়গায় ন্যায্যমূল্যের দোকান সাজিয়ে ছাত্র-জনতা এভাবে কাজ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
ছাত্র-জনতার আগস্ট বিপ্লবের সময়ের মামলাগুলো এখনো সব তুলে নেয়া হয়নি। দ্রুত মামলামুক্ত করতে হবে। আগস্ট বিপ্লব দুনিয়ায় এক অনন্য উদাহরণ। নিজের দেশে নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য মাঠে নেমে এভাবে গুলির মুখোমুখি হওয়াটা খুবই দুঃখজনক, লজ্জাজনক। আমরা এর পুনরাবৃত্তি চাই না। দোষীদের উপযুক্ত সাজার ব্যবস্থা করে শহীদদের রুহের প্রতি মর্যাদা দিতে হবে। আহতদের প্রতি সহানুভূতির দরজা খুলে রাখতে হবে। উপদেষ্টাদের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে, আজীবন চিকিৎসার সুযোগ পাবে। ভালো উদ্যোগ। মনিটরিং মজবুত থাকতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের কাজে বরকত দেবেন।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।