রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ১২তম সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ॥ ৭ জিলহজ ১৪৪৫ হিজরী ॥ ১৪ জুন ২০২৪

অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক সংকটে

অস্থিরতা বাড়ছে

॥ ফারাহ মাসুম ॥
সরকার প্রভাবশালী দু’পক্ষকে খুশি করে ক্ষমতায় থাকতে মরিয়া চেষ্টা করেও সফল হওয়ার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না। একদিকে অর্থনীতির ভঙ্গদশা, জাতীয় নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা হুমকির মুখে; অন্যদিকে মহাশক্তিধরদের প্লে-গ্রাউন্ডে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ। সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর হাইকমান্ডের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ার কারণে সরকারের ক্ষমতার জন্য স্তম্ভের মতো ভূমিকা রাখা ব্যক্তিরাও নিরাপদবোধ করছেন না। দেশে কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম বা রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকলেও হুড়মুড় করে মসনদ ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে শাসকমহলকে। এর মধ্যে অনেকে নীরবতা ভেঙে মুখ খুলতে শুরু করেছেন।
নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মমদ ইউনূস অব্যাহত চাপের মুখে রয়টার্সকে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করেছে আওয়ামী লীগ। শাসকদল রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার পরিবেশ ধ্বংস করে দেওয়ায় একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। দেশকে একেবারে রাজনীতিশূন্য করা হয়েছে।
শুধু প্রফেসর ইউনূসই নন, দেশের শীর্ষস্থানীয় সব ব্যক্তিত্বই যেন একসাথে রাষ্ট্রের পরিস্থিতি নিয়ে মুখ খুলেছেন। শীর্ষ অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, ড. আহসান এইচ মনসুর, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সবাই প্রায় একই ভাষায় কথা বলছেন। ড ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, দেশে এখন সর্বব্যাপী দুর্নীতি, ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণহীন ও অরক্ষিত। প্রশাসনের সর্বস্তরে জবাবদিহির অভাব, অনিয়ম ও দুর্নীতিতে ভরা। ফলে সরকারি ব্যয় সাশ্রয়ের বদলে হচ্ছে ব্যাপক অপচয়। ড. হোসেন জিল্লুর বলেছেন, দুর্নীতি বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের মন্তব্য হলো, ঋণখেলাপি এখন বাংলাদেশে নতুন বিজনেস মডেল। এর অর্থ হলো আপনি ঋণ নেবেন আর সেটি ফিরিয়ে দিতে হবে না। ড. আহসান মনসুর বলেছেন, ব্যাংক খাতের জন্য শ্বেতপত্র দরকার। ড. দেবপ্রিয় ঘোষিত বাজেটকে বাংলাদেশের জন্য এক বে-নজির বাজেট বলে মন্তব্য করেছেন।  
অর্থনীতিবিদরা এসব কথা বলছেন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) ও সম্পাদক পরিষদ অথবা শীর্ষস্থানীয় বণিক সংগঠন আয়োজিত অনুষ্ঠানে। এর সাথে প্রতিদিনই শেয়ারবাজারে ভয়াবহ দরপতন ঘটে চলেছে। ব্যাংকগুলোর এটিএম বুথে টাকা পাওয়া যাচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রেই। বড় অঙ্কের চেক দিয়ে টাকা তোলা সম্ভব হচ্ছে না।
এসব বিষয় সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করে আসছিলেন। কিন্তু ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের মতো ব্যক্তিত্বরা নিশ্চুপ ছিলেন অনেকটাই। এখন তিনি বলছেন, অব্যাহত মুদ্রাস্ফীতি ও বৈদেশিক রিজার্ভের পতন, রাজস্ব সংগ্রহের স্বল্পতা, রফতানি ও রেমিট্যান্সপ্রবাহের স্থবিরতা, পুঁজিবাজার ও ব্যাংক খাতের বিশৃঙ্খলা, সর্বব্যাপী দুর্নীতি এবং সরকারি ব্যয়ের অনিয়ম, অপচয়, জবাবদিহি না থাকার সংস্কৃতি, বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে বর্তমান দায় এসব এখনকার বাস্তবতা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে দেখা গেছে, যেকোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তনের আগে কিছু ব্যক্তিকে খলনায়ক বানানো হয়। মন্ত্রীর বাসায় সন্ত্রাসী ইমদুর ধরা পড়া ছিল একসময়ের আলোচিত ঘটনা। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের এখনকার ঘটনার মধ্যে শাসকদলের অনেকে তেমন সংকেত খুঁজে পাচ্ছেন। এ ধরনের হাওয়া ও আভাস ইঙ্গিত প্রথমেই ব্যবসায়ী অলিগার্কদের কাছে আসে।
হয়তো এ কারণেই বণিক সংগঠনগুলোর শীর্ষে সরকার সমর্থকরা বসে থাকলেও এবারের বাজেট নিয়ে প্রায় সব সংগঠনই ব্যাপকভাবে সমালোচনামুখর হয়ে উঠছে। এক আলোচিত ব্যবসায়ী বাংলাদেশি পাসপোর্ট সমর্পণ করে তল্পিতল্পা নিয়ে নির্বাসনে আয়েশে থাকার আয়োজন সম্পন্ন করার গুজব ছড়িয়ে পড়েছে।
এ অবস্থায় রাষ্ট্রে সংবেদনশীল বিভিন্ন পদেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। অনেকে এর সাথে নিরাপদ প্রস্থান পাওয়ার সম্পর্ক দেখছেন। এ সময়ে দুর্নীতি-অনিয়মের নানা দায়মুক্তির বিষয় ধামাচাপা দেয়ার উদ্যোগও সন্তর্পণে চলছে মর্মে খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিরূপ পরিস্থিতিতে কেউ কেউ বেশ ধার্মিকও হয়ে যাচ্ছেন। শাসকদলের একটি সূত্র বলছে, ‘হাবভাব ভালো নয় রে ভাই’। যারা এতদিন সরকারকে ঠেকিয়ে রেখেছিল, তারা মেজাজ হারিয়ে ফেলছেন। সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে এসব ম্যানেজ করার জন্য প্রতিবেশী দেশে গিয়ে কতটা লাভ হয়েছে, তা স্পষ্ট হচ্ছে না। তবে যেসব শর্তের বিষয় সেখান থেকে জানানো হয়েছে, তাতে ক্ষমতায় থাকা বিদ্যমানদের জন্য অনেকখানি অসম্ভব হয়ে যেতে পারে। তার বিপরীত দিক থেকেও রয়েছে প্রবল চাপ। মাস শেষে সে দেশ সফরে সুনির্দিষ্ট কমিটমেন্ট ও পদক্ষেপ না এলে সমর্থন চালিয়ে যাবে না এমন বার্তাই পাওয়া যাচ্ছে।
অন্যদিকে হঠাৎ সবাই সোচ্চার হয়ে ওঠার পেছনে একক শক্তিধর বিশ্বশক্তি হিসেবে খ্যাত দেশের সন্তর্পণ ভূমিকা রয়েছে বলে আশঙ্কা শাসকমহলের। ক্ষমতার শীর্ষপর্যায় থেকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংকটের কথা খোলামেলা প্রকাশ করে সম্প্রতি বলা হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মিয়ানমারের অংশ নিয়ে পূর্ব তিমুরের মতো খ্রিস্টান রাষ্ট্র করার জন্য কাজ হচ্ছে। এজন্য সাদা চামড়ার একজন ঘাঁটি চেয়েছিল। সেটি দিইনি বলে বিপত্তি।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নিরাপত্তা সংকটের কথা খোলামেলা বলার পর এখন গণতন্ত্র ও রাজনীতির সংকট আর অর্থনৈতিক অচলাবস্থার পাশাপাশি সার্বভৌমত্বের সংকট প্রবলভাবে উঠে এলো বলে মনে করা হচ্ছে।
নোবেল বিজযী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূসের মুখ খোলাকে এর সাথে মিলিযে হিসাব করতে হবে। রয়টার্সকে তিনি খোলামেলা বলেছেন, ‘বাংলাদেশে আর কোনো রাজনীতি অবশিষ্ট নেই। এখানে কেবল একটি দলই সক্রিয় এবং তারাই সবকিছুই দখল করেছে। তারা সবকিছু করছে, তাদের মতো করে নির্বাচন করছে।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘তারা (আওয়ামী লীগ) বিভিন্ন কৌশলে তাদের প্রার্থীদের পাস করায়, যেমন আসল প্রার্থী, ডামি প্রার্থী, স্বতন্ত্র প্রার্থী। আর এরা সব একই দলের।’
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এ মন্তব্যকে দেশের জনগণের জন্য ‘অপমানজনক’ বলে অভিহিত করেছেন আইনমন্ত্রী। দেশে গণতন্ত্র পুরোপুরি সচল রয়েছে বলে মন্তব্যও করেছেন তিনি।
এরপরও ড. ইউনূস থামছেন না। লোহার খাঁচায় দাঁড়ানোর পরও অশীতিপর এ বৈশ্বিক ব্যক্তিত্ব কথা বলে যাচ্ছেন। এমপিকে মেরে লাশ টুকরো করার মতো অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে চলেছে এর পাশাপাশি। আর এজন্য গ্রেফতার করা হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতাদের। সরকারের মন্ত্রীরাও এ ইস্যু নিয়ে একেক সময় একেক কথা বলছেন। এর মধ্যে শাসকের দলের দুই নম্বর ব্যক্তি স্বাস্থ্য চেকআপের জন্য সিদ্ধাপুর চলে গেছেন। এবার তিনি কিছুটা বেশি সময় নিয়ে স্বাস্থ্য চেকআপ করবেন বলে জানা যাচ্ছে। বেনজীর ও আজিজের পাশাপাশি এমপি আনারের ঘটনা সামনে রেখে এর নেপথ্য বার্তা পাঠ করলে ভিন্ন কিছু পাওয়া যাবে বলে অনেকে মনে করছেন।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, ৭ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়নি বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট। আর নির্বাচনে ভীতি প্রদর্শন আর সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে ব্রিটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একই সময়ে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি ও জামায়াত এ নির্বাচনকে ভুয়া বলেছে। বিরোধীদল হাসিনার পদত্যাগের মাধ্যমে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। তবে এ দাবি পূরণের জন্য সেরকম জোরালো কোনো আন্দোলন দেখা যাচ্ছে না। এরপরও সৃষ্টি হচ্ছে অন্যরকম এক আতঙ্ক।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বেনজীর আহমেদের বিষয়টিও তার বক্তব্যে তুলে আনেন। তিনি বলেছেন, সাবেক আইজিপির শত শত কোটি টাকা ব্যাংকে জমা হলো, আবার রাতারাতি উধাও হয়ে গেল। তাহলে এ টাকাগুলোর পদচিহ্ন কোথায় গেল। ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স বিভাগের কাজ এখানে কী ছিল।
ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খলা এমন পর্যায়ে এসে পড়েছে যে, অর্থনীতির সবচেয়ে সংবেদনশীল জায়গায়টি এখন নিয়ন্ত্রণহীন ও অরক্ষিত অবস্থায়। বিনিয়োগের জন্য আমরা প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ এখনো করতে পারিনি। অর্থনীতিতে যে আস্থার পরিবেশ, সেটা তো তৈরিই হয়নি, বরং প্রশাসনের সব স্তরে জবাবদিহির অভাব, অনিয়ম ও দুর্নীতির ফলে সরকারি ব্যয় সাশ্রয়ের বদলে হচ্ছে ব্যাপক অপচয়।
এদিকে সরকারের সামনে একটি বড় সংকটে পরিণত হয়েছে চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্কের বিষয়টি। সরকারপ্রধান এ সম্পর্ককে নিজের মতো করে এগিয়ে নিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তিন নম্বর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দিল্লি গিয়েছিলেন। মোদির ত্রিশঙ্কু সরকারের অধীনে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বদলাবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে ভারতীয় বিরোধীরা মোদির আঞ্চলিক পররাষ্ট্রনীতি ও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যাচাই-বাছাই করতে তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করবে কিনা, তা দেখার বিষয়। এখানে চীন একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠে এসেছে। এসব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ্লোমেট ম্যাগাজিনে তাৎপর্যপূর্ণ এক নিবন্ধ লিখেছেন প্রবাসী রাষ্ট্রনীতিবিদ প্রফেসর আলী রীয়াজ।
তিনি বলছেন, ভারতের ১৮তম সাধারণ নির্বাচনের ফলে একটি ‘নতুন’ সরকার এসেছে, যা অনেকটা ‘পুরনো’ সরকারের মতো, উভয়ের নেতৃত্বে নরেন্দ্র মোদি। তবুও অনেকেই ভাবছেন যে, প্রতিবেশীদের প্রতি এর ভঙ্গি ও সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন হবে কিনা। প্রশ্নটি তিনটি বিবেচনার ভিত্তিতে করা হয়েছে। প্রথমটি হলো, বিজেপি; বিশেষ করে মোদির ভোট সমর্থনের গুরুতর পতনের পরে কিছু আত্মদর্শন করতে পারে। দ্বিতীয়ত, মোদির দুটি মেয়াদে এ অঞ্চলে চীনের বিপরীতে ভারতের প্রভাব হ্রাস পেয়েছে, যা স্পষ্টতই মোদির ‘প্রথম প্রতিবেশী’ বৈদেশিক নীতির ব্যর্থতা। তৃতীয়টি হলো বিরোধী ভারত ব্লকের শক্তি, যা বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকারকে তার অভ্যন্তরীণ এজেন্ডা ও বিদেশি নীতির উদ্দেশ্য নিয়ে চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে সক্ষম হবে।
আলী রীয়াজের বিশ্লেষণ অনুসারে, বাংলাদেশে, যারা শেখ হাসিনার প্রতি মোদি সরকারের  সমর্থনকে গুরুতর গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণের অনুঘটক হিসেবে দেখেন, তারা আশা করছেন যে, এ শর্তগুলো মোদির তৃতীয় মেয়াদকে আলাদা করবে। তবে তারা তাদের শ্বাস আটকে রাখবে না। ২০১৪ সালে যখন বিজেপি ক্ষমতায় আসে, তখন বাংলাদেশের কেউ কেউ আশা করেছিল যে, বিজেপির শাসন তার পূর্বসূরি, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের থেকে বাংলাদেশের সাথে তার সম্পর্কের বিষয়ে ভিন্ন হবে। বাস্তবে তা ঘটেনি। অন্যদিকে বর্তমান আওয়ামী লীগ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে যে সংসদে আসন সংখ্যা হ্রাস পেলেও বিজেপি এখনো ক্ষমতায় রয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেন, ২০২৪ সালের বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জোরের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ খোলাখুলিভাবে নয়াদিল্লির নিরঙ্কুশ হস্তক্ষেপের জন্য বলেছিল। নির্বাচনের পরপরই বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ স্বীকার করেছেন, ভারত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিল। তিনি বলেন, ‘এ বছরের নির্বাচনেও ভারতের অবস্থান আপনারা সবাই জানেন।’
আলী রীয়াজ বলেছেন, নির্বাচনের ফলাফল যেহেতু সরকারে কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় না, তাই মোদি সরকারের পদ্ধতি বা নীতিতে পরিবর্তন আশা করার কোনো কারণ নেই। অন্য দুটি উপাদান নীতির ধারাবাহিকতার পক্ষে। ভারতের বাংলাদেশ নীতিতে ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্টের ব্যাপক সমর্থনের সব চিহ্ন রয়েছে। গত এক দশকে; বিশেষ করে ২০২৩ সালে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল, তখন ভারতীয় সংস্থা থেকে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে নেতিবাচক বক্তব্য দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয়ত, নীতিটি ভারতের নিরাপত্তা হুমকির ধারণা দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্পষ্টতই বাংলাদেশকে নিরাপত্তা লেন্স দিয়ে দেখে। তাদের বোধগম্যতা হলো শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ; বিশেষ করে শেখ হাসিনাই নিশ্চিত করতে পারেন যে, ভারতের অশান্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোসহ পূর্ব ফ্রন্টে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হতে হবে না।
আলী রীয়াজের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, ধারাবাহিকতার পক্ষে জোরালো যুক্তি থাকা সত্ত্বেও একটি অজানা উপাদান হলো বিরোধীদলের ভূমিকা। এটা কি সরকারের আঞ্চলিক নীতিকে একটি ইস্যুতে পরিণত করবে? ২০১৮ সালে, কংগ্রেস প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে তার সম্পর্কের বিশেষ উল্লেখ করে মোদি সরকারের বিদেশনীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।... গত তিন বছরের দিকে ফিরে তাকালে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি কৌশলগত লাভের দিক থেকে খুব কমই অর্জন করেছে। ‘নেবারহুড ফার্স্ট’ নীতি একটি ‘নেবারহুড লস্ট’ নীতিতে পরিণত হয়েছে, যেখানে ভারত বিচ্ছিন্ন এবং সাধারণত অবিশ্বাসের প্রতিবেশী হয়ে উঠেছে।
আলী রীয়াজ বলছেন, নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযোগ রয়েছে, যা বর্তমানে অনেক দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শেয়ার করা হয়। ভারতের ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোকে উত্ত্যক্ত করার এবং তাদের স্থানীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার প্রয়াস নিয়ে অনেক গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। ভারতীয় এক নথিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘বাংলাদেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক এমন একটি দেশ, যার সাথে ভারতের একটি ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ এবং সমৃদ্ধ সম্পর্ক রয়েছে, তাও চাপের লক্ষণ দেখছে।’
যদিও ২০১৮ সালের এ মূল্যায়ন এবং পরবর্তীকালে আরও ভাঙনের সাথে কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারে না, তবে এটাও সত্য যে, এ ধরনের ভাঙন ২০১৩ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড প্রগতিশীল জোট সরকারের অধীনে শুরু হয়েছিল। তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বিতর্কিত নির্বাচনের আগে ঢাকা সফর করেন এবং সাবেক স্বৈরশাসক জেনারেল এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে যোগ দিতে রাজি করান। সব বিরোধীদল দ্বারা বয়কট করা এ নির্বাচনটি ছিল গণতান্ত্রিক ক্ষয়ের দিকে একটি বড় পদক্ষেপ এবং ভারতের ভূমিকাকে অনেক বাংলাদেশি হস্তক্ষেপকারী হিসেবে দেখেছিলেন।
আলী রীয়াজ বলেন, কংগ্রেসের রাজনৈতিক বক্তৃতায় গত বছরে বাংলাদেশ আবার আবির্ভূত হয়েছিল, যখন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী মোদি-আদানি সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন এবং কিছু দুর্নীতিমূলক অনুশীলনের কথা বলেছিলেন। তিনি স্পষ্টভাবে প্রশ্ন তোলেন, ‘মোদি সরকারের বিদেশনীতির উদ্দেশ্য শিল্পপতি গৌতম আদানিকে আরও ধনী করা কিনা।’ তিনি মোদির ২০১৫ সালের বাংলাদেশ সফরের কথা উল্লেখ করেছিলেন, যখন আদানি গ্রুপ বাংলাদেশের সাথে একটি বিদ্যুৎ-উৎপাদন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, যা আদানিকে ভারতের অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে যে দামে বিদ্যুতের আমদানি করছে তার চেয়ে তিনগুণ বেশি দাম নেওয়ার অনুমতি দেয়। এটি লক্ষণীয় যে, ২০২৩ সাল থেকে এবং নির্বাচনী প্রচারের সময় রাহুল গান্ধী বার বার ‘আদানি এবং আম্বানি’কে মোদি সরকারের দুর্নীতির প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অবস্থা ভারতের বিরোধীদলগুলোর কাছে অজানা নয়। নির্বাচনী প্রচারণার সময় আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেছিলেন, ‘আমরা চাই না যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং রাশিয়ার মতো ভারতে গণতন্ত্রের অবসান হোক।’ বাংলাদেশের রাজনীতি যারা পর্যবেক্ষণ করেন, তাদের কাছে এটা কোনো উদ্ঘাটন ছিল না, বরং এটা ছিল ভারতের একজন জাতীয় রাজনৈতিক নেতার বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অভাবের বিরল স্বীকৃতি।
একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় পররাষ্ট্রনীতি মূলত নির্বাহী বিভাগের আওতায় থাকে এবং খুব কমই বিরোধীরা পথ পরিবর্তন করতে পারেন। তবে বিরোধীদলগুলো জবাবদিহির জন্য চাপ দিতে পারে এবং নীতিগুলোর পেছনের উদ্দেশ্যগুলো প্রকাশ করতে পারে। কংগ্রেস দল ও জোট তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে মোদির আঞ্চলিক পররাষ্ট্রনীতি এবং বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে পর্যালোচনা করতে ইচ্ছুক কিনা, তা ভবিষ্যতে দেখার বিষয়।
আলী রীয়াজের বিশ্লেষণে যাই বলা হোক না কেন, বাংলাদেশের রাজনীতির অন্দরের খবর যারা রাখেন তাদের অজানা নয় যে, এবারের নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয়তাকে নামিয়ে আনার পেছনে ভারতের ভূমিকা ছিল। সেটি ভারতীয় সাবেক শীর্ষ কূটনীতিক পিনাক রঞ্জন খোলাসা করে দিয়েছেন। তিনি যেটি বলেননি, সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্র যেসব শর্তসাপেক্ষে ছাড় দিয়েছিল, যেসব শর্ত পূরণের কথা ছিল শেখ হাসিনা নতুন সরকার গঠনের পর। যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত সেসব শর্তের এখন বাস্তবায়ন চাইছে। এ নিয়ে উত্তাপের মধ্যে সরকার প্রধান খ্রিস্টান রাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করেছেন। এটি করে তিনি এ ধরনের একটি রাষ্ট্র হলে যে দুটি বড় দেশ চীন ও ভারত এর শিকার হতে পারে, তাদের সমর্থনও চেয়ে থাকতে পারেন।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিরাপত্তা সংকট, অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব আর রাজনৈতিক সংকট মিলিয়ে এক সন্ধিক্ষণে এসে উপনীত হয়েছে। এ কারণে শান্ত নিস্তরঙ্গ রাজনৈতিক আন্দোলনের মুখেও শাসকদলের নীতিপ্রণেতাদের সামনে অস্থিরতা ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠছে।

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।