রেজি : ডিএ ৫১৭ ॥ ৬৩ বর্ষ : ৩য় সংখ্যা ॥ ঢাকা, শুক্রবার, ২২ চৈত্র ১৪৩০ ॥ ২৫ রমজান ১৪৪৫ হিজরী ॥ ৫ এপ্রিল ২০২৪

৬৩ শতাংশেরই মৃত্যু হয়
॥ হামিম উল কবির॥
বাংলাদেশে মুখগহ্বরের ক্যান্সারে বছরে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়। আক্রান্তদের ৬৩ শতাংশেরই মৃত্যু হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে মুখগহ্বরের ক্যান্সার একটি অবহেলিত রোগ। সব মানুষের মধ্যে হতে পারে কিন্তু প্রধানত দরিদ্র শ্রেণির মানুষ রোগটিতে বেশি ভোগে দারিদ্র্যের কারণে। মুখগহ্বরের ক্যান্সার শনাক্তের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও মৃত্যুর হারে শীর্ষে। ২০২০ সালে দেশে ১৬ হাজার ৮৮৪ জন মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্তের মৃত্যু হয়েছে বলে ওয়ার্ল্ড ক্যান্সার রিসার্চ ফান্ড ইন্টারন্যাশনালের (ডব্লিউসিআরএফ) রিপোর্টে বলা হয়েছে। অন্যদিকে এ দেশে প্রতি লাখে ২১ জন মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। পুরুষ রোগীদের মৃত্যুহার প্রতি লাখে ১৭.৪ এবং নারী রোগীরা মারা যাচ্ছে প্রতি লাখে ৬.১ জন। মুখগহ্বরের ক্যান্সারের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে বলে বাংলাদেশে এ ধরনের হার যেমন বেশি, তেমনি মৃত্যুর হারও বেশি। মুখগহ্বরের ক্যান্সার হলে মুখের অনেকগুলো অঙ্গকে জড়িয়ে ফেলে, ফলে এর অস্ত্রোপচার সহজ হয় না। সে কারণে প্রতিরোধই সর্বোত্তম পন্থা।
মুখগহ্বরের ক্যান্সার কী : ছোট ছোট অনেক অঙ্গ নিয়ে মুখ ও মুখগহ্বর গঠিত। মুখের বা মুখগহ্বরের শুরুটাই হয় ঠোঁট দিয়ে। এরপর মুখের ভেতরে রয়েছে মাড়ি, পাশে রয়েছে গাল, ওপরে তালু, তার পেছনে টনসিল, তার পেছনে রয়েছে ফ্যারিংস। এছাড়া জিহ্বা ও দাঁতও মুখগহ্বরের অংশ, কিছু গ্ল্যান্ডসও আছে। এ অঙ্গগুলোয় প্রদাহ হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাবিহীন থাকলে একসময় ক্যান্সারে রূপ নেয়। এটাকেই মুখগহ্বরের ক্যান্সার বলা হয়। মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্তের অন্যতম প্রধান কারণ তামাকের ব্যবহার। ধূমপান থেকে শুরু করে জর্দা, সাদা পাতা, গুল কিংবা তামাকজাতীয় অন্যান্য দ্রব্য সেবনের কারণে অধিকাংশ লোক এ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। এছাড়া অধিক মদপান করলেও মুখগহ্বরের ক্যান্সার হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে মদপানের অভ্যাস কম, এখানে তামাক ও তামাকজাতীয় পণ্য সেবনের কারণেই মুখ গহ্বরের ক্যান্সার বেশি হয়ে থাকে।
কীভাবে হয় মুখ গহ্বরের ক্যান্সার?
অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজনের কারণে এ ক্যান্সার হয়ে থাকে। কোষের অভ্যন্তরের ডিএনএ’র অস্বাভাবিক বিবর্তন থেকে শুরু হয় মুখের ভেতরে পরিবর্তন। ম্যালিগন্যান্ট বা ক্ষতিকর ক্যান্সার সেল মুখের ভেতর থেকে ছড়িয়ে পড়তে পারে মাথা, ঘাড় কিংবা শরীরের অন্য অংশে। অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়াকে বলা হয় মেটাস্টেসিস। আবার আশপাশের লসিকাগ্রন্থিতেও ছড়াতে পারে ক্যান্সার। ঠোঁট, জিহ্বা, দাঁতের মাড়ি, তালু, গালের ভেতরের দিক, চোয়াল, লালাগ্রন্থিসহ মুখের ভেতরের যেকোনো স্থানে ক্যান্সার হতে পারে। তবে এ রোগে আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক হলে বেশি কল্যাণ বয়ে আনে। যেকোনো সমস্যা পাওয়া গেলেই তা ক্যান্সার না-ও হতে পারে। বাংলাদেশে জাতীয় ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচি নেই। বিভিন্ন হাসপাতালে স্তন ও জরায়ুমুখের ক্যান্সারের অসংগঠিত কর্মসূচি থাকলেও মুখগহ্বরের ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচি নেই। সম্প্রতি ঢাকার লালমাটিয়ায় কমিউনিটি অনকোলজি সেন্টারে মুখগহ্বরের ক্যান্সারের প্রাথমিক স্ক্রিনিং চালু হয়েছে।
তামাক ও এক ধরনের ভাইরাস দায়ী : বাংলাদেশে ৪০ শতাংশের বেশির তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য সেবনের সাথে ক্যান্সারের সম্পৃক্ততা রয়েছে। অ্যালকোহল (মদ) জাতীয় দ্রব্য সেবন করলে ক্যান্সারের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। এছাড়া হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস নামে আরো এক ধরনের ভাইরাসের কারণে (হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস ১৬) মুখগহ্বরের ক্যান্সার হয়ে থাকে বলে বিশিষ্ট ক্যান্সার অনকোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোহাম্মদ আকরাম হোসেন বলেন। তিনি বলেন, এছাড়া স্টেমসেল ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনের কারণেও এ রোগের ঝুঁকি অনেকাংশেই বেড়ে যায়। মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যান্সার থেকে রক্ষা পেতে হলে প্রাথমিকভাবে প্রত্যেকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখের ভেতরে আঙুল দিয়ে নিজেই পরীক্ষা করে দেখতে পারে। এভাবে সচেতনতার মাধ্যমে এর ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আবার এমন অনেক মুখগহ্বরের ক্যান্সার আক্রান্ত আছে, যারা কখনো ধূমপান বা তামাকজাতীয় পণ্য ব্যবহার করেন না। এ ধরনের মানুষের মুখগহ্বরের ক্যান্সার হয়ে থাকে তাদের দেহে ভিটামিন বি-১২ বা অন্যান্য ভিটামিন, জিংক, ফলিক অ্যাসিড বা আয়রনের অভাব ঘটলে অথবা রক্তস্বল্পতাজনিত কারণে। এর বাইরে বদহজম বা ডায়রিয়া বা ইরিটেবল বাউল সিনড্রোম রোগীদের মুখগহ্বরের ক্যান্সার বেশি হয়। কারণ ঘা বা ক্ষত নিরাময়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিনগুলো সঠিকভাবে পরিপাকতন্ত্রে প্রবেশ করে না।
কীভাবে প্রাথমিক শনাক্ত করা যায় : মুখের কোনো অংশ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে গেলে প্রাথমিকভাবে মুখগহ্বরের ক্যান্সার হিসেবে চিহ্নিত করেন চিকিৎসকেরা এবং এ লক্ষণ দেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিশ্চিত হয়ে থাকেন রোগটি হয়েছে কি না। এছাড়া মুখের কোনো অংশে ঘা বা ছোট পিণ্ডের মতো কিছু অনুভূত হলে, মুখের ভেতর সাদাটে বা লাল হয়ে গেলে কিংবা মুখের ভেতরের রং পরিবর্তন হয়ে গেলে মুখগহ্বরের ক্যান্সার হতে পারে। মুখের ভেতরে যেখানে ঘা হয়েছে, সেখানে নির্দিষ্ট স্থানে হাত দিয়ে পরীক্ষা করলে খসখসে অনুভূত হলেও তা মুখ গহ্বরের ক্যান্সার হতে পারে। অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোহাম্মদ আকরাম হোসেন বলেন, মাড়ির কোনো অংশ থেকে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ, মাড়ির নিচের দিকে দেবে যাওয়া কিংবা অস্বাভাবিকভাবে ফুলে উঠলে মুখগহ্বরের ক্যান্সার হতে পারে। তিনি বলেন, ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যথা থাকে না। কিন্তু উপরে উল্লেখিত লক্ষণ থাকলে ব্যথা নেই বলে অবহেলাও করা যাবে না। দ্রুত অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মুখের ভেতরে ঘা বেড়ে গেলে মুখে অস্বাভাবিক রকম বেশি লালা তৈরি হতে পারে, মুখ খুলতে গেলে অথবা মুখের ‘হা’ ছোট হয়ে এলে, জিহ্বা নাড়তে কষ্ট হলে এবং খেতে কষ্ট হলেও মুখগহ্বরে ক্যান্সার হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। তবে মেশিনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া ছাড়া ক্যান্সারই হয়েছে এমন কিছু বলা যাবে না। চিকিৎসকরা বলছেন, মুখে কোনো ধরনের অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখলেই দেরি না করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে হবে। পান, সুপারি, জর্দা এবং ধূমপান ছাড়াও পুষ্টিহীনতা এবং মুখের অভ্যন্তরের অনুপযুক্ত পরিবেশও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এছাড়া মুখের অপরিচ্ছন্নতার কারণেও ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রতিদিন কমপক্ষে দুই বেলা যত্নসহকারে দাঁত মেজে পরিষ্কার থাকার মাধ্যমে মুখগহ্বরের ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়।
চিকিৎসা : মুখগহ্বরের ক্যান্সার অনেক বেশি ছড়িয়ে না পড়লে সার্জারি বা অপারেশন করেই সারিয়ে তোলা যায় রোগীকে। পরে রেডিওথেরাপি বা বিকিরণ কিংবা কেমোথেরাপি বা ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে। অনেক সময় অপারেশনের মাধ্যমে ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফিসিয়াল সার্জনরা মুখ ও চোয়ালের রিকনস্ট্রাকশন বা পুনর্গঠন করার রোগটি সারিয়ে তোলেন। জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও গবেষণা হাসপাতালে ক্যান্সার এপিডেমিওলজির সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, চিকিৎসা শুরুর আগেই সমন্বিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পুরো চিকিৎসার পরিকল্পনা করে নিতে হয়। প্রথম পর্যায়ে শনাক্ত করা সম্ভব হলে এ রোগ পুরোপুরি নিরাময়ের সম্ভাবনা থাকে। মুখগহ্বরের ক্যান্সার দেরিতে শনাক্ত হয় বলে অনেক সময় চিকিৎসকদের করার কিছুই থাকে না। আবার মুখগহ্বরের ক্যান্সার হলে এর অনেকগুলো অঙ্গকে জড়িয়ে ফেলে। ফলে এর অস্ত্রোপচার সহজ হয় না। তাছাড়া বাংলাদেশে মুখগহ্বরের ক্যান্সারের অস্ত্রোপচার যারা করেন, সেই সার্জনদের সংখ্যা খুব বেশি নয়, হাতেগোনা। এ ক্যান্সারের অপারেশন অনেকটা ঢাকাকেন্দ্রিক। সরকারি হাসপাতালে কিছুটা স্বল্পমূল্যে অপারেশন করা গেলেও বেসরকারিভাবে এ অপারেশন খুবই ব্যয়বহুল বলে দরিদ্র মানুষ অপরেশনটি করতে পারে না অর্থের অভাবে।
মুখগহ্বরের ক্যান্সারে বাংলাদেশের অবস্থান
বিশ্বে মুখগহ্বরের ক্যান্সার আক্রান্তের হারের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে পাপুয়া নিউগিনি। ডব্লিউসিআরএফের তথ্যানুযায়ী, দেশটিতে ২০২০ সালে প্রায় দেড় হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছে। দেশটিতে প্রতি লাখে ২৫.৭ জন মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে রোমানিয়া ও হাঙ্গেরি। এছাড়া এ তালিকায় শীর্ষ দশের মধ্যে থাকা অন্য দেশগুলো হলো যথাক্রমে কিউবা, স্লোভাকিয়া, ভারত, শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও মলদোভা। পাপুয়া নিউগিনি আক্রান্তের হারে শীর্ষে থাকলেও মৃত্যুহারে দ্বিতীয় অবস্থানে। মৃত্যুর দিক থেকে তৃতীয় থেকে দশম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে মালদোভা, পাকিস্তান, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, ভারত, বেলারুশ, স্লোভাকিয়া ও মন্টেনিগ্রো।

অন্যান্য মিডিয়া bdnews24 RTNN Sheersha News barta24 Prothom Alo Daily Nayadiganta Jugantor Samakal Amardesh Kaler Kantho Daily Ittefaq Daily Inqilab Daily Sangram Daily Janakantha Amader Shomoy Bangladesh Pratidin Bhorerkagoj Daily Dinkal Manob Zamin Destiny Sangbad Deshbangla Daily Star New Age New Nation Bangladesh Today Financial Express Independent News Today Shaptahik 2000 Computer Jagat Computer Barta Budhbar Bangladesherkhela Holiday Bangladesh Monitor BBC Bangla Pars Today
homeabout usdeveloped by

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মো. তাসনীম আলম।

এটিএম সিরাজুল হক কর্তৃক হক প্রিন্টার্স ১০/৮ আরামবাগ, ঢাকা-১০০০ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত। যোগাযোগের ঠিকানাঃ ৪২৩ এলিফেন্ট রোড, বড় মগবাজার, ঢাকা - ১২১৭।

ফোন: ৮৮ ০২ ৪৮৩১৯০৬৫, ই-মেইল: sonarbanglaweekly@gmail.com, weeklysonarbangla@yahoo.com, সার্কুলেশন: ০১৫৫২৩৯৮১৯০, বিজ্ঞাপন: ৪৮৩১৫৫৭১, ০১৯১৬৮৬৯১৬৮, ০১৭৩৪০৩৬৮৪৬।