কষ্টে আছে নুয়ে পড়া মানুষ ॥ অর্থনীতিতে ঘিরে থাকা চ্যালেঞ্জগুলো খোলাসা করে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন
॥ উসমান ফারুক॥
একটানা কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এখনো ভোগাচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও স্বল্পআয়ের কর্মজীবীরা উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে নুয়ে পড়েছে। অর্থপাচার, অপচয় ও অনিয়মের পাহাড়সম বোঝা নিয়ে ডলার সংকট থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি দেশ। এতে সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা জেঁকে বসেছে, তার কোনো কূল-কিনারা দেখছে না আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বিশ্বব্যাংকও। সংস্থাটি গত সপ্তাহে ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও হতাশার চিত্র তুলে এনেছে। রিজার্ভ কমে যাওয়া, বিনিময় হার নির্ধারণে এখনো কোনো আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে না যাওয়া, তারল্য সংকট, ব্যাংকে খেলাপির উচ্চহার, শিল্পের কাঁচামাল আর মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ধস ও অর্থনীতিতে এর প্রভাব, ক্রমাগত বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সংস্কার কর্মসূচিতে সরকারের বিলম্ব ও কর্মসংস্থান কমে যাওয়ায় অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হারানোর মতো বিষয়গুলো বর্ণনা করেছে বিশ্বব্যাংক।
প্রতিবেদনে পরামর্শ দিয়ে সংস্থাটি বলেছে, আর্থিক খাত ও মুদ্রানীতিতে জোরালো সংস্কার প্রয়োজন। এ সংস্কারটি যতটা সম্ভব দ্রুত করার আহ্বান করেছে বাংলাদেশের কাছে। দ্রুত সংস্কারে গিয়ে বাস্তবায়ন করতে না পারলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে লেনদেন করতে আস্থা হারাবে বাংলাদেশ। সংস্থাটি সতর্ক করে বলেছে, বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার মান দিন দিন দুর্বল হচ্ছে। প্রকৃত অবস্থা বিদেশি বিনিয়োগকারীরা জানে। যদি দ্রুত সমস্যার সমাধান না হয়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতি বিদেশিদের আস্থা কমে যাবে।
বিশ্বব্যাংক মূলত দেশগুলোর অর্থনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করে। অর্থনীতি নাজুক হলে এর পেছনের কারণগুলো পরোক্ষভাবে তুলে ধরে। সেখানে সংস্থাটি প্রথমেই যেটিতে নজর দেয়- তা হলো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলোয় কী কী পরিবর্তন হয়েছে। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক পরিবেশ কেমন ছিল- তার মূল্যায়ন। এ দুটি বিষয়ের ওপর ভর করে পরামর্শ দিয়ে থাকে।
এবারের প্রতিবেদনটিতেও দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ বিবেচনায় নিয়ে আর্থিক খাতের সংস্কারের কথা বলেছে সংস্থাটি। যেখানে তারা জোর দিয়েছে জাতীয় বাজেট প্রণয়নের সময়ে ঘাটতি কমাতে। আর রাজস্ব আয় বাড়াতে বলেছে বিশ্বব্যাংক। এ দুটি করতে প্রয়োজন সরকারি দলের রাজনৈতিক অঙ্গীকার। কিন্তু বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনলে প্রথমেই তথাকথিত বড় ব্যয়ের প্রকল্প বাদ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, রাজস্ব আয় বাড়াতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আনতে হবে। এজন্য প্রয়োজন বিনিয়োগকারীদের নির্ভয় আশ্বাস। এ দুটির কোনোটিতেই সরকারের তেমন একটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে প্রথমটি চাইলে করতে পারবে, কিন্তু দ্বিতীয়টি সরকারের সাধ্যের মধ্যে নেই।
কারণ হচ্ছে, সংস্কার কার্যক্রম শুরু করলে বন্ধ হবে আর্থিক অনিয়ম ও লুটপাট, যা সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করবে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা সেই জবাবদিহি করতে চাচ্ছে না। আবার রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিরোধীদলকে কোণঠাসা করে রাখায় তারাও কোনো প্রকার চাপ দিতে পারছে না। ফলে দৃশ্যত দেশের আর্থিক খাতের সংস্কার শুধু বুলি আওড়ানোয় সীমাবদ্ধ থাকছে।
অর্থনীতির এমন বাস্তবতায় বিশ্বব্যাংক বলেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট হয়েছে বাংলাদেশ। ক্রমাগত বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি, আর্থিক খাতের দুর্বলতা, ব্যাংকে তারল্য সংকট, শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। এতে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হতে পারে সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ শতাংশ। অথচ সরকার এবারো বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরেছে সাড়ে সাত শতাংশ।
অর্থনীতিতে এত সব চ্যালেঞ্জের মধ্যে ঈদের সময়ে প্রথমবারের মতো কমেছে রেমিট্যান্স। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন প্রকাশের পর রেমিট্যান্স তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যে একেবারে নাজুক অবস্থানে গেছে, তা বোঝা যায় ঈদের কেনাকাটাতেও। এবার ঈদের কেনাকাটায় শপিংমলগুলোর বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। আর্থিক সংকটে থাকা মানুষ কোনোভবে মূল্যস্ফীতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে অর্থনীতি অনেকটা থমকে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনীতি ছোট হলেও কাগজে বাড়ানোর গল্প
গত কয়েক বছর থেকেই অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে আসছে বাংলাদেশের। মূলত রিজার্ভ সংকটে আমদানিতে লাগাম টেনে ধরেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বছর তিনেক পূর্বেও বাংলাদেশে প্রতি মাসে গড়ে ৮ থেকে সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলারের আমদানি হতো। এখন সেখানে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৫ থেকে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলারে। এ আমদানির মধ্যে অনেক দায় ব্যবসায়ীরা পরিশোধ করতে পারছে না। বাধ্য হয়ে বকেয়া পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে চলছে দিনের পর দিন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, গত এক বছরে দেশে ভোগ্যপণ্য আমদানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ, মূলধনী যন্ত্রাংশ প্রায় সাড়ে ২৫ শতাংশ, শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য ৯ শতাংশ, পেট্রোলিয়াম পণ্য ৮ শতাংশ ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ২৫ শতাংশ।
এভাবে কোনো কোনো খাতের পণ্য আমদানি কমেছে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ। গত এক বছরে কখনো কখনো তা অর্ধেকে নেমেছিল। আমাদের দেশের অর্থনীতি মূলত আমদানিনির্ভর। হালকা থেকে ভারী শিল্প ও চাল, ডাল, তেলসহ তৈরি পোশাকের ৭০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। আমদানির ওপর নির্ভর করে দেশের সার্বিক অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। অর্থনীতি কেমন যাচ্ছে, তা এসব সূচকই জানান দেয় নিয়মিত। গত কয়েক বছর ধরে প্রধান প্রধান এসব খাতে আমদানি কমে যাওয়ায় দেশের অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে আসছে। সরকার তা প্রথমদিকে স্বীকার না করলেও বছর শেষের প্রতিবেদনে নগ্নভাবে উঠে আসছে।
করোনা মহামারির পূর্বে সর্বশেষ গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। এরপর থেকেই জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে আসছে। পরের বছর ২০১৯-২০ তে নেমে যায় ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। সর্বশেষ গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সরকার বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। কিন্তু প্রাথমিক হিসেবে ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ অর্জিত হওয়ার তথ্য দিলেও সরকার পরবর্তীতে জানায় চূড়ান্ত হিসাবে জিডিপি হয়েছে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
এবার তা আরো কমে যাবে বলে পূর্বাভাস দিল বিশ্বব্যাংক। গত কয়েক বছরে সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। এ কারণে সরকারের পরিকল্পনাকে ‘উচ্চাভিলাষী’ বলে আসছেন অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতির আকার সংকুচিত হয়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যে কমে যাচ্ছে, তার আরেকটি প্রমাণ হচ্ছে রাজস্ব আয়ের চিত্র। সরকারের আয়ের প্রধান খাত হচ্ছে রাজস্ব আদায়। পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় শুল্ক আদায়ে ধস নেমেছে। অন্যদিকে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ায় কমেছে উৎপাদন। মূলত চাহিদা কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা আমদানির পরিমাণ কমিয়ে চলেছেন। এ কারণে চলতি অর্থবছরে ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণও গতবারের তুলনায় কমেছে। এতে মুদ্রানীতিতে যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে বেসরকারি ঋণপ্রবাহে।
কারখানার উৎপাদন সক্ষমতার ৩০ শতাংশ এখন অলস অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এতে বিক্রি কমে যাওয়ায় এ খাত থেকে সরকারের ভ্যাট আদায় কমেছে। অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী, পণ্য বিক্রি যত বেশি হবে, ভ্যাট আদায় তত বেশি হবে। জাতীয় রজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এর তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের আট মাসে রাজস্ব আদায় ঘাটতি ১৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এতে বাধ্য হয়ে ব্যাংক ঋণে ফিরছে সরকার।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের কর্মক্ষম জনশক্তি অনেক বেশি। কিন্তু বাংলাদেশ এ জনশক্তিকে ব্যবহার করতে পারছে না। জনশক্তির বড় অংশই শ্রমবাজারে নেই। তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এ সুযোগকে হাতছাড়া করছে। যদি শ্রমশক্তি অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো ব্যবহার করতে পারলে অর্থনীতির আকার এখনই ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যবসায়ীরা দীর্ঘ মেয়াদে ২০ বছরের অধিক সময়ের জন্য বিনিয়োগ করে থাকেন। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক পরিবেশ খুঁজছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে অনেক ব্যবসায়ী শুধু রাজনৈতিক কারণে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারছেন না। এতেও অর্থনীতিতে তাদের অবদান কমে গেছে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় কারখানার উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হচ্ছে না আশানুরূপ। এতে মূলধন আটকে গিয়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না ব্যবসায়ীদের অনেকে। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়ে দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময়ে নীরব দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে বাংলার আকাশে। তাই রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানেই লুকিয়ে আছে অর্থনৈতিক সংকট সামলানোর উপায়। সরকারের উচিত হবে, জনগণের কল্যাণে কাজ করতে রাজনৈতিক সংকট সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া।
এ পাতার অন্যান্য খবর
- সকল বাধা উপেক্ষা করে সত্যের পথে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে হবে
- মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সিংহভাগ তামাকসেবী
- উৎপাদন ও সরবরাহে কমতি নেই, তবে দাম ঠিকই বাড়তি
- ক্যাম্পাসগুলোয় ভিন্নমতাবলম্বী সংগঠনকে কাজ করতে দিচ্ছে না
- ধনী ও দরিদ্রের ঈদে ব্যবধান ঘুচবে কীভাবে
- আমরা জামায়াত-অজামায়াত বুঝি না, প্রার্থী প্রার্থীই : ইসি রাশেদা
- ৩০ জুন এইচএসসি পরীক্ষা
- রুমা ও থানচিতে ব্যাংকে হামলা লুট অঙ্গুলি কুকি-চিনের দিকে
- সাপ্তাহিক সোনার বাংলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিনের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা