ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

ঝিনাইদহ-৪ আসনে একক প্রার্থীর সুবিধায় জামায়াত, বিভাজিত বিএনপি


৩০ অক্টোবর ২০২৫ ১৮:০১

মিজানুর রহমান, ঝিনাইদহ : ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গন ক্রমেই সরগরম হয়ে উঠছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও নিচ্ছে প্রস্তুতি, প্রার্থী বাছাই, মনোনয়ন, জনসংযোগসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এমন নির্বাচনী আবহ ঝিনাইদহেও বিরাজ করছে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর ঝিনাইদহ-৪ আসনে আগ্রহ বাড়ছে তরুণ ভোটারদের মাঝে। প্রথমবারের মতো এবার ভোট দেবে তরুণ প্রজন্মের বড় একটি অংশ।
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ঝিনাইদহ-৪ আসনের রাজনীতিতে বেশ প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। বিশেষত তরুণ ভোটারদের মাঝে, তাদের সচেতনতা ও আগ্রহও নজরকাড়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা নিয়মিত মতামত ও বিশ্লেষণ দিচ্ছেন। এ আসনের এক-তৃতীয়াংশ ভোটার তরুণ, যারা এবারই প্রথমবার ভোট দেবেন। স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যে প্রার্থী তরুণদের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারবেন, তাকেই জয়ের পথে এগিয়ে যেতে দেখা যাবে।
নির্বাচনী এলাকাটি কালীগঞ্জ উপজেলা এবং ঝিনাইদহ সদরের ফুরসন্ধি, নলডাঙ্গা, ঘোড়শাল ও মহারাজপুর ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এ আসনে মোট ৩ লাখ ২৩ হাজার ৩৬ জন ভোটারের মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৬৪ হাজার ৩৩৮। আর নারী ভোটার ১ লাখ ৫৮ হাজার ৬৯৩ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ৫ জন।
দেড় দশক পর নির্বাচনী মাঠে সক্রিয়তা বাড়িয়েছে জামায়াত। চষে বেড়াচ্ছে পথ-প্রান্তর। দলটির প্রার্থী ও নেতাকর্মীরা ভোটারদের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জামায়াতের মনোনীত প্রার্থী কালীগঞ্জ উপজেলা শাখার নায়েবে আমীর, প্রবীণ রাজনীতিক মাওলানা আবু তালিব। ইতোপূর্বে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও তিনি প্রার্থী ছিলেন। তিনি নিয়মিত নির্বাচনী মতবিনিময় সভা, কর্মী সমাবেশ ও কৌশলগত পরামর্শে ব্যস্ত সময় পার করছেন। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীসহ সাধারণ মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ও সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছেন। জামায়াতের সমাবেশে ভিন্ন ধর্মের মানুষের উপস্থিতিও এখন দৃশ্যমান, যা দলটির ইনক্লুসিভ রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ। জাগিয়েছে নতুন আশাও। শুধু অংশগ্রহণ নয়, ভিন্নধর্মাবলম্বী নেতাদের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে জামায়াতের পক্ষে বক্তব্য দিতেও দেখা যাচ্ছে। অনেকটা আশাবাদী হয়ে দলটির কর্মীরা মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। ব্যাপক সাড়াও পাচ্ছেন বলে দাবি দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের।
কালীগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক মাওলানা ওলিউর রহমান বলেন, “ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কালীগঞ্জেই তিনজন শহীদ হয়েছেন, নেতাকর্মীরা অসংখ্য মামলা ও হামলার শিকার হয়েছেন। তবুও কেউ আদর্শ থেকে সরেনি এক চুলও। কর্মীদের এই ‘দৃঢ়চিত্ত অবস্থানে’ সাধারণ মানুষের মাঝে জামায়াতের প্রতি সহানুভূতির জায়গা তৈরি হয়েছে। ফলে বিগত ১৭ বছরে জামায়াতের কর্মী-সমর্থক বেড়েছে কয়েকগুণ।”
তিনি আরও দাবি করেন, ‘জামায়াতের বিরুদ্ধে ক্রমাগত মিথ্যাচার হচ্ছে, আমীরে জামায়াতকে নিয়ে চলছে মিথ্যাচার, চলছে তার চরিত্র হননের অপচেষ্টা। শুধুমাত্র জাতীয়ভাবেই নয় স্থানীয় নেতাদের নিয়েও গভীর ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে, জামায়াতকে নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা আজ আর টিকে না।’
মাওলানা ওলিউর রহমান বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবপরবর্তী তরুণদের কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ বিনির্মাণে জামায়াত অগ্রণী ভূমিকা রাখায় তারা জামায়াতের প্রতি আস্থাশীল। নারীর প্রতি জামায়াত কর্মীদের সম্মানজনক আচরণ নিয়ে নারীরাই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভূয়সী প্রসংশা করছেন। তারাও জামায়াতকে ক্ষমতায় দেখতে চাচ্ছেন। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও এখন পরিবর্তন চায় এবং তারা জামায়াতকে বিশ্বাস করছে। জামায়াতের অমুসলিম শাখায় সদস্য সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া জামায়াতের কর্মীরা সন্ত্রাস, ধর্ষণ বা চাঁদাবাজিতে জড়িত নয়Ñ এটাই আমাদের বড় শক্তি। ফলে আগামী নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী এ আসনে বিজয়ী হবে, ইনশাআল্লাহ।’
এ আসনে জামায়াতের ভোটার সংখ্যা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঝিনাইদহ-৪ আসনে আমাদের নিজস্ব জনশক্তির রুকন ও কর্মী সংখ্যা ৩ হাজার ৬৬২, সমর্থক ১ লাখ ৪২ হাজার ১১৪ জন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের এই ১ লাখ ৪৫ হাজার ৭৭৯ জন ভোটারই নয়, যুক্ত হবে সাধারণ ভোটও। ফলে এ আসনে আমাদের প্রার্থীর জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী এবং আমরাই নির্বাচিত হবো। ২০০১ সাল থেকে জামায়াত এ আসনে এককভাবে নির্বাচন করতে পারেনি, ফলে মোট ভোটার সংখ্যা দেশবাসীর জানার সুযোগ হয়নি। ১৯৯৬ সালে বর্তমান প্রার্থী আবু তালিব ফলাফলে তৃতীয় স্থানে ছিলেন। বর্তমানে জামায়াতের ভোট বেড়েছে কয়েকগুণ। অনেক পরিবার বিএনপি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও তারা গত কয়েক দশকে পুরো পরিবার এখন জামায়াতের রাজনীতি করেন। পরিবারগুলোয় বেড়েছে তরুণ ভোটারও। এ কথা দৃঢ়চিত্তে বলতে পারি অবাধ নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জামায়াত বিজয়ী হবে, ইনশাআল্লাহ।’
অন্যদিকে জামায়াত যখন গোছালো ও পরিকল্পিতভাবে মাঠ গুছিয়ে কাজ করছেন। নিজেদের অনুকূলে জনসমর্থন বাড়িয়ে চলেছে, তখন সংকট ও অনিশ্চয়তার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছেন বিএনপির প্রার্থীরা। কারণ তাদের প্রার্থী এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আছে দলীয় কোন্দল, প্রভাব বিস্তারে ব্যস্ত নানা গ্রুপ ও পক্ষ।
এমনি পরিস্থিতিতে এখনো প্রার্থী চূড়ান্ত করেনি বিএনপি। তবে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে বিভাজন স্পষ্ট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রার্থিতা নিয়ে দলটির কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, কালীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক হামিদুল ইসলাম হামিদ, জেলা বিএনপির উপদেষ্টা ও সাবেক এমপি মরহুম এম শহীদুজ্জামান বেল্টুর স্ত্রী মুরশিদা জামানের মধ্যে চলছে ত্রিমুখী লড়াই।
তিনজনই নিজ নিজ অবস্থান থেকে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা বিভিন্ন সামাজিক, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছেন, হাটবাজারে কুশল বিনিময় করছেন এবং কর্মীদের নিয়ে সভা-সমাবেশ করছেন।
তবে কালীগঞ্জ উপজেলা বিএনপিতে ‘অন্তর্দ্বন্দ্ব’ প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে সময়ে সময়ে। জামাল ইউনিয়নে বিএনপির এক পক্ষের দুই সহোদর হত্যাকাণ্ডে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এই ঘটনায় বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ডা. নুরুল ইসলামসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। ফলে উপজেলার পূর্বাঞ্চলে বিএনপির কার্যক্রমে স্থবিরতা এসেছে এবং সাধারণ মানুষের আস্থা কিছুটা কমেছে।
মনোনয়ন নিয়ে বিএনপির স্ব-স্ব গ্রুপের নেতাদের প্রত্যাশা দল তাকেই প্রার্থী হিসেবে নির্ধারণ করবেন। তবে শেষ পর্যন্ত কে প্রার্থী হবেন তা হাইকমান্ড নির্ধারণ না করা পর্যন্ত কোনো কিনারা নির্ধারণ করার সুযোগ থাকছে না। উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক শহীদুল ইসলাম সাইদুল বলেন, ‘সাইফুল ইসলাম ফিরোজ একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, শিক্ষিত নেতা। জিয়া পরিবারের প্রতি তার রয়েছে অটল সমর্থন। বিপদে-আপদে নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন বলেই আজ তার জনভিত্তি দৃঢ়। সম্প্রতি সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ও বিভিন্ন ধর্মের লোকজন নিয়ে বেশ কয়েকটি সম্প্রীতি সমাবেশ করেছেন। মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তার স্পষ্ট অবস্থান। ফলে কালীগঞ্জের মানুষ আগামী দিনেও সাইফুল ইসলাম ফিরোজকে গ্রহণ করবে এবং দলও তার প্রতি আস্থা রেখে তাকেই মনোনয়ন দেবে বলে আশা করছি। ’
উপজেলা যুবদলের সদস্য সচিব মাহবুবুর রহমান মিলন বলেন, ‘হামিদুল ইসলাম হামিদ তৃণমূলের নেতা। প্রত্যেক নেতাকর্মী ও এলাকার মানুষের সঙ্গে তার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। লোকাল ছেলে হিসেবে তাকে সবসময় কাছে পাওয়া যাবে। এসব বিবেচনায় দল হামিদুল ইসলাম হামিদকেই মনোনয়ন দেবে বলে আমাদের বিশ্বাস। দল মনোনয়ন দিলে এ আসনে বিএনপি বিপুল ভোটে জিতবে বলে আমরা মনে করছি।’
কালীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও জেলা বিএনপির ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সম্পাদক ভিপি ইসরাইল হোসেন বলেন, ‘মুরশিদা জামান বেল্টু সাহেবের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারবেন। বিভক্ত বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ করতে তার বিকল্প নেই। আমাদের বিশ্বাস আসনটিতে বিজয়ী হতে কেন্দ্র আমাদের নেত্রী মুর্শিদা জামানকেই মনোনয়ন দেবে।’
তবে উপজেলা বিএনপির সাবেক সেক্রেটারি তবিবুর রহমান মিনি জানান, ‘দল যাকে মনোনয়ন দেবে, আমরা সবাই মিলে তার পক্ষেই কাজ করবো। মনোনয়নের পর বিভক্তি কেটে যাবে।’
অন্যদের মাঠে উপস্থিতি সীমিত
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মুফতি আহম্মদ আব্দুল জলিল প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। তবে তার কার্যক্রম অন্যদের তুলনায় সীমিত। গণঅধিকার পরিষদ থেকে প্রভাষক সাখাওয়াত হোসেন মনোনয়ন প্রত্যাশী হলেও দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। জাতীয় নাগরিক পার্টিও মাঠে অনুপস্থিত।