জুলাই বিপ্লব ভালোবাসার ফসল

॥ তৌহিদুর রহমান ॥
‘Final aim of all love intrigues, be they comic or tragic, is really of more importance than all other ends in human life. What it all turns upon is nothing less than the composition of the next generation. It is not the weal or woe of any one individual, but that of the human race to come, which is here at stake.’ – Schopenhauer.
অর্থাৎ ‘ভালোবাসা সকল ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত লক্ষ্য- তা কৌতুকময় আনন্দের বা দুঃখজনক হোক, মানবজীবনের অন্যান্য সমস্ত লক্ষ্যের চেয়ে সত্যিই তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটা পরবর্তী প্রজন্মের আকাক্সক্ষার চেয়ে কম কিছু নয়। এটি কোনো একক ব্যক্তির সুখ বা দুঃখ নয়, বরং ভবিষ্যৎ মানবজাতির সুখ বা দুঃখ, যা ঝুঁকির মুখে।’ -শোপেনহাওয়ার।
আসলে মানুষ যা কিছুই করুক না কেন, তা শুধুমাত্র ভালোবাসার তীব্র আকাক্সক্ষার কারণেই করে। তা হতে পারে দেশের জন্য ভালোবাসা, মানবতার জন্য ভালোবাসা, ব্যক্তির জন্য ভালোবাসা, সম্পদের জন্য ভালোবাসা ইত্যাদি। ভালোবাসার প্রচণ্ড টান অনুভব করলেই কেবল মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত হয়ে যায়। ভালোবাসার কাছে সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায়। ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবটা ছিল কোটি কোটি মানুষের দেশের প্রতি ভালোবাসার একটা চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। এটা ছিল বর্তমান প্রজন্মের একটা উপহার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। এই বিপ্লব শুধু কোনো একক ব্যক্তির সুখ বা দুঃখের বিষয় ছিল না, বরং এটা ছিল ভবিষ্যৎ বাংলাদেশিদের অনুকূলে সুখ বা দুঃখের একটা স্মৃতিসৌধ নির্মাণ। যখন স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব প্রবল ঝুঁকির মুখে ছিল। এটা ছিল একটা রাষ্ট্রের টিকে থাকার লড়াই। মানবাধিকারের লড়াই। স্বাধীকার ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াই। দেশের প্রতি ভালোবাসার এ লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছে লাখকোটি ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ-তরুণী- এটা সবাইকে মানতে হবে। ছাত্রদের নেতৃত্বেই সাধারণ জনতা এ লড়াইয়ে অংশ নিয়েছে। উত্তাল সেই দিনগুলোর একক কৃতিত্ব শুধুমাত্র ছাত্র-ছাত্রীদের। আর সেই প্রতিটি দিনই ছিল মহামূল্যবান।
যাহোক, প্রতিটা দিনের আলাদা একটা গুরুত্ব তো অবশ্যই থাকে। অনুভূতি থাকে, থাকে স্বপ্ন। মুহূর্তের এ স্বপ্ন মানুষকে পথ চলতে শেখায়। নতুন করে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। মুহূর্তের এ স্বপ্নগুলোর আলাদা এক একটা সুখ থাকে। থাকে রূপ, রস, গন্ধ। যেমন থাকে সব দিবসের। যেমন চৈত্রের আগুন-আকাশ- থমথমে হয়ে থাকে চারপাশ। রুক্ষ বাতাস। গাছেরা নুয়ে পড়ে ক্লান্ত হয়ে। যেন দোযখের উত্তাপ তপ্ত দুপুরে। ঐ সময়গুলো অনেকের জন্য যেন মন খারাপের একটা মৌসুম। মন খারাপের একটা লু হাওয়া কোথা থেকে আসে, কেন আসে? আবার কখনো মেঘযুক্ত বর্ষার আকাশ- মনটা গুমোট হয়ে থাকে। মানুষ কি ভেবে দেখে কখনো- এই যে রাত-দিন একই আকাশের নিচে পৃথিবী নামক একটি গ্রহের কন্দরে আমরা কাটিয়ে দিলাম অনেকটা সময়- কত আদর, কত সুখ, আশা, ভরসা, ভালোবাসা, ফেলে আসা সুগন্ধি স্বপ্ন- রক্তসাগর, দুঃখ, কষ্ট, বেদনায় নীল হয়ে যাওয়া আকাশ, আরও কত কী! স্মৃতিময় ফেলে আসা সেই দিনগুলো কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগে কারো কারো কাছে। আবার কারো কারো কাছে ধোঁয়ায় ধূসরিত গাঢ় অন্ধকার। আমরা কালো চাই না, আলো চাই। চাই সুবাসিত স্বপ্ন। একটা আলোকিত সিরাতুম মুসতাকিমের পথে এগিয়ে যেতে চাই। যেতে চাই হেরার রাজ তোরণের পথে।
২০২৪-এর ফেলে আসা সেই ধু-ধুময় দিনগুলোর কথা আমরা কখনো যেন ভুলে না যায়। তাহলে আমাদের সব স্বপ্ন সত্যি সত্যিই ফেলানির মতো কাঁটাতারে চিরদিন ঝুলে থাকবে। আলোয় আলোয় আর হয়তো কখনো হাসবে না আমার প্রিয় বাংলাদেশ।
২০২৪ জুলাই আন্দোলনের বেশিরভাগ সময় আমি ছিলাম ঢাকার বনশ্রী, ত্রিমোহনী, মেরাদিয়া, খিলগাঁও, বাসাবো, রামপুরা, বাসাবো বিশ্বরোড, মালিবাগ রেলগেট আর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার বিভিন্ন রাস্তাঘাট অলিগলিতে। কখনো পিকেটিং করেছি, কখনো মিশে গেছি আন্দোলনকারীদের সাথে, কখনো ফুটপাতে বসে ছিলাম। ছিলাম মসজিদে। নব্বইয়ের আন্দোলনের কথা স্মরণ করে আমি চুপচাপ ঘরে বসে থাকতে পারিনি। নব্বই আন্দোলনে একটানা ৭দিন মানে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে অবস্থান করেছিলাম বাংলামটরে। শুধু পাউরুটি আর কলা খেয়ে। তখন কিন্তু আন্দোলনের ওপর এভাবে গুলি চলেনি। নূর হোসেন হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল- শোনা যায় তাও ছিল বিশেষ একটা গোষ্ঠীর পরিকল্পিত। আর শহীদ হয়েছিল ডা. মিলনসহ কয়েকজন। যাহোক, ৯০-এ শিল্পী আবুল কাশেম ভাইয়ের দরাজকণ্ঠের গণসংগীত এখনো কানে বাজে- ‘বীর মুসলমান ধরো আল কুরআন, ফিরায়ে আনো সেই হারানো সম্মান- নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার’। ২০২৪-এর তুলনায় ১৯৯০-এর আন্দোলন ত্যাগের দিক দিয়ে বলা যায় অতি নগণ্য। তখন নারীসহ সাধারণ মানুষকে এভাবে ব্যাপকহারে আন্দোলনে যুক্ত হতে দেখিনি। মেয়েরা সেই আন্দোলনে রাজপথে ছিলই না বলা যায়।
আসলে যে যাই বলুক, জুলাই বিপ্লবের মূল নায়ক ছিল ছাত্ররা-ছাত্রীরা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে নার্সারি পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীরা বিপ্লবের অগ্নি মশাল হয়ে জ্বলে উঠেছিল। ২০২৪-এ এসে আমি দেখেছি আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী, মা-ভগ্নি-কন্যা, শ্রমিক-রিকশাওয়ালা সবাই রাস্তায় নেমে এসেছিল জীবনটাকে খেলারপুতুল হিসেবে হাতে নিয়ে। একমাত্র ফিলিস্তিন ছাড়া এভাবে লাখকোটি মানুষকে জীবন হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমে আসতে আমি আর কোথাও দেখিনি। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ছিল ২০২৪ আন্দোলনের সম্পূর্ণ উল্টো। তখন কিন্তু ২৪-এর মতো জনসম্পৃক্ততা ছিল না। ৭১-এ ২৫ মার্চ একটা গণহত্যা হয়েছিল। এরপর মানুষ শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। ফলে শহর বা আক্রান্ত এলাকা থেকে মানুষ দলে দলে পালিয়ে গিয়েছিল ভারতে। কিন্তু অতি আশ্চর্যের বিষয় ২০২৪-এর এই আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীরা এবং দেশের সাধারণ জনগণ কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। তারা খালি হাতে বুক চিতিয়ে অস্ত্রের সামনে বীরদর্পে দাঁড়িয়ে গেছে। যার ফলে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলতে বাধ্য হয়েছিলÑ ‘স্যার, গুলি করি। মরে একটা। একটাই যায়, স্যার। বাকিডি যায় না। এটাই স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের।’ খুনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে এভাবেই আন্দোলনের ‘সমস্যা’র কথা বর্ণনা করছিলেন এক পুলিশ। এতেই প্রমাণ হয়, জহির রায়হানের ‘আসছে ফাল্গুনে দ্বিগুণ হবো’ পড়ে বড় হওয়া প্রজন্ম তাঁর লেখাকেও অতিক্রম করে গেছে।
এভাবে সংলাপ লেখা সম্ভব ছিল না পৃথিবীর কোনো লেখকের পক্ষে, ‘গুলি করি। মরে একটা। একটাই যায়, স্যার। বাকিডি যায় না। এটাই স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের।’ এমন বাস্তব সংলাপ হাজার বছরে একবারই লেখা হয়। ইতিহাস যেন মনে রাখে, এই দেশে একটা বিপ্লব হয়েছিল। যেখানে কেউ বন্ধুর লাশ ফেলে জীবন নিয়ে পালিয়ে চলে যায়নি। বরং বন্ধুর গুলি খাওয়া দেখে আরো তীব্র আক্রোশে বুক পেতে দিয়ে বলেছিল, ‘বুকের ভিতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি, গুলি কর।’
এ আন্দোলনের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল মহিলাদের আশ্চর্যজনকভাবে অংশগ্রহণ। আমরা দেখেছি হাজার হাজার মা-বোনের সাহসী উচ্চারণ ও রাজপথের লড়াকু সৈনিক হিসাবে।
বনশ্রী এলাকায় শিশু কন্যাদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। সম্ভবত ১৯ জুলাই আমি ত্রিমোহনী দিয়ে পায়ে হেটে একপর্যায়ে বনশ্রী ডিপিডিসি বিদ্যুৎ অফিস পর্যন্ত গেলাম। রাস্তাঘাট সব বেরিকেড দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে, পিকেটিংও চলছে। রামপুরা টু ডেমরা প্রধান সড়ক একদম যানবাহন শূন্য। বিদ্যুৎ অফিসের ফিরোজ ভাই বললেন, সামনে যাওয়া ঠিক হবে না। প্রধান সড়ক বাদ দিয়ে চলে গেলাম গলির ভেতরে। বনশ্রী আবাসিক এলাকার ভেতরে ঢুকে দেখি এলাহীকাণ্ড। প্রতিটা গলিতে মা-বাবা, ভাই-বোন, শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই নেমে এসেছে রাস্তায়। এমনকি দুধের শিশুও। আমরা জানি বনশ্রী আবাসিক এরিয়ার রাস্তাগুলো অনেক প্রশস্ত। সব রাস্তা দেখছি বাঁশ আর রশি দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ। কারো হাতে পানি, কারো হাতে শুকনো খাবার এবং আশ্চর্যের বিষয় অধিকাংশের হাতে রংতুলি। সবাই রাস্তায় ও দেয়ালে আল্পনা আর গ্রাফিতি অঙ্কনে মহাব্যস্ত। পাশাপাশি চলছে স্লোগান। রাস্তায় লেখা হচ্ছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিজ, পানি লাগবে পানি, খুনি হাসিনা নিপাত যাক, কোটা না মেধা- মেধা মেধা, ছাত্র হত্যার বিচার চাই ইত্যাদি। জুলাই গণআন্দোলনে ছাত্র-ছাত্রী, শিশু, তরুণ-তরুণীসহ অনেকে সরকার ও সমাজের নানা অসঙ্গতি নিয়ে বিদ্রƒপাত্মক ভাষায় রাস্তা ও দেয়ালজুড়ে অনেক ধরনের স্লোগান লিখেছিল। ফ্যাসিস্ট সরকারের কুৎসিত ছবি এঁকেছিল রাজপথজুড়ে। ওয়াল ও রাস্তাজুড়ে ছিল খুনি হাসিনার রক্তখেকো বিকৃত ছবি। পুলিশের অত্যাচারের চিত্র। ছাত্রলীগের নির্যাতনের ছবি। সুদ, ঘুষ, খুন, চাঁদাবাজি, দুর্নীতির ছবিও ছিল প্রতিবাদের ভাষায়। ছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অসংখ্য কবিতার লাইন। নতুন এক বাংলাদেশকে পাওয়া গেল ২০২৪ বিপ্লবের দেয়ালে দেয়ালে। গ্রাফিতি আর ক্যালিওগ্রাফির অন্য এক বাংলাদেশকে দেখা গেল দেয়ালে-রাজপথে। আশ্চর্যের বিষয় পৃথিবীর ইতিহাসে এভাবে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনের প্রতিবাদ হিসেবে আরবি ক্যালিওগ্রাফি আঁকা যায় দেয়ালে দেয়ালে তা কেউ কোনো দিন কল্পনাও করতে পারেনি। এটা করেছিল সম্পূর্ণ মাদরাসার ছাত্ররা। এখনো নূর মসজিদ ও মালিবাগ জামেয়ার আশপাশে অনেক আরবি ক্যালিওগ্রাফি জ্বলজ্বল করছে। সারা বাংলাদেশজুড়ে একই ধরনের চিত্র এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে।
যে প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে খাতা-কলম, মোবাইল, ল্যাপটপ আর কম্পিউটারের সামনে রাত-দিন বুদ হয়ে বসে থেকে, ইউটিউব, ফেসবুক আর বিভিন্ন ওয়েবসাইটে, গেম খেলে-ফ্রি ফায়ার আর পাবজিতেÑ সেই তাদের হাতের কোমল স্পর্শে রক্তের রঙে রঙিন হয়ে উঠল বাংলাদেশের নগর-মহানগর, শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জের দেয়াল, গলিপথ থেকে রাজপথ। তারা এভাবে দেয়াল লিখন কখনো দেখেনি, নেই তাদের চিকামারার কোনো অভিজ্ঞতা। সে তো দেখেনি গত শতাব্দীর চিকামারার দৃশ্য। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই তো সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনও দেখেনি। নির্বাচনের চিকামারাও তারা বোঝে না। এই প্রজন্ম ড্রয়িং করে মাউস আর কী-বোর্ড দিয়ে কম্পিউটারের ক্যানভাসে। তারা ছবি আঁকে খাতার পাতায় আর মোবাইলে। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের এ সাধারণ যোদ্ধারা নতুন এক বাংলাদেশ নির্মাণে অসাধারণ বিপ্লব সাধিত করতে সক্ষম হয়েছে অমসৃণ খসখসে দেয়ালে দেয়ালে। কাগজ-কলম, রং-পেন্সিল ও তুলির আঁচড়ে যারা এতোদিন নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর খাতার মসৃণ পাতায় সীমাবদ্ধ রেখেছিল সেই তারাই দু’হাত প্রসারিত করে ডানা মেলে দিল রাজপথে, স্বপ্নের রঙিন আকাশেÑ নতুন স্বপ্নের, নতুন আশার আলোয় ভরিয়ে তুলল কোটি কোটি স্বাধীনতাকামী জনতার মন। প্রতিটা দেয়াল হয়ে উঠলো বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতার স্বপ্নের দলিল। এক একটা কংক্রিটের দেয়াল হয়ে উঠল বাংলাদেশের নতুন সংবিধানের এক একটি পাতা। ২০২৪-এর মহাবিপ্লবকে নতুন চিন্তায় ফুটিয়ে তোলার অসাধারণ কাজটি দক্ষতার সাথে করেছে লাখকোটি সাধারণ শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী গ্রাফিতির মাধ্যমে। রং তুলি আর ¯েপ্র রঙের অসাধারণ কারুকাজ এখনো ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে। কী নেই সেখানেÑ আছে সাম্যের কথা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা, বৈষম্যহীন সমাজের কথা, মানবিক মূল্যবোধের কথা, কৃষক, শ্রমিক, কুলি-মজুরের কথা। আছে মানবাধিকারের বয়ান। আছে ন্যায় বিচারের বয়ান। বিদ্রোহ আর প্রতিবাদের কথা।
আন্দোলনকারীদের মুখে ছিল ‘এক, দুই, তিন, চার, খুনি হাসিনা গদি ছাড়’, ‘এই বাংলায় হবে না, বৈষম্যের ঠিকানা’, ‘আঠারোর হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার’, ‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘এসো ভাই এসো বোন, গড়ে তুলি আন্দোলন’, ‘চলছেই চলবে, আমাদের আন্দোলন’-সহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন ধরনের স্লোগান।
তরুণদের এ আন্দোলনে আরেকটা বিষয় লক্ষণীয় ছিল। তা হলো আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সবার মুখে মুখে, দেয়ালে দেয়ালে, রাজপথে। ‘মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম’ ‘কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙে ফেল কররে লোপাট’; ‘বল বীর, চির উন্নত মম শির’; ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে’; ‘অরুণ প্রাতের তরুণ দল’; ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা; ‘ভয়ের দেয়াল ভাঙলো এবার’ ইত্যাদি। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা এ আন্দোলনে অসামান্য প্রেরণা জুগিয়েছে। তাঁর কবিতা, গান যেমন ছিলো আন্দোলনকারীদের মুখে মুখে। তেমনি দেয়ালজুড়েও লেখা হয়েছিল রক্তগরম করা তার কবিতার পঙক্তি। এটা সারা বাংলাদেশ জুড়েই ছিল।
আসলে রংপুরে আবু সাঈদের শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে জুলাই আন্দোলন সর্বাত্মক গণআন্দোলনে রূপ নেয়। মহাবীরত্বের সাথে রাইফেলের নলের সামনে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে যাওয়া ছিল জুলাই আন্দোলনের একটা প্রতীক। মুহূর্তেই এ প্রতীকরূপী আবু সাঈদের দুই হাত প্রসারিত করা ছবি বিশ্বময় ভাইরাল হয়ে যায়। বুকে পরপর চারটি গুলি লাগার পরও দৌড়ে পালিয়ে যাননি আমাদের মহান বীর আবু সাঈদ। তার এই বীরত্বগাথা ছবি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম, ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৌঁছে যায় ছাত্র-ছাত্রী তথা আন্দোলনকারীদের হৃদয়ে। আগুন ধরিয়ে দেয় রক্তে। মূলত তারপরই আন্দোলন সরকার পতনের এক দফায় গতি পায়। তাকে নিয়ে করা হয়েছে অসংখ্য দেয়ালচিত্র। প্রতিটি গ্রাফিতি বা দেয়াল চিত্রে দেখা যায় প্রসারিত দুই হাতসহ দণ্ডায়মান আবু সাঈদ। ছবির পাশে লেখা রয়েছে- ‘বুকের ভেতর দারুণ ঝড়/বুক পেতেছি গুলি কর’। এ মহাবিপ্লবের আরেকজন মহান নেতা মীর মুগ্ধ। মুগ্ধ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল তৃষ্ণার্ত ছাত্র-জনতাকে পানি খাওয়ানোর জন্য। বুকে ঝুলানো আইডি কার্ড। হাতে পানির বোতল। মুখে স্লোগান ‘পানি লাগবে পানি, কারো পানি লাগবে, পানি’। এ চিত্রটাও দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতিতে ব্যাপকভাবে স্থান পেয়েছে। দেয়ালে দেয়ালে মুগ্ধ পানির বোতল হাতে দাঁড়িয়ে আছে, সাথে লেখা আছে ‘পানি লাগবে, পানি?’।
আমি ২৪ জুলাই আবুল হোটেলের সামনে ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে ছিলাম। তিন দিক থেকে মারাত্মক আক্রমণ আসছিল আন্দোলনকারীদের ওপর। রামপুরা চৌধুরী পাড়ার দিক থেকে পুলিশ, বিজিবি ও যুবলীগ, মালিবাগ রেলগেটের দিক থেকে পুলিশ, র‌্যাব, আর্মি এবং আনসার ক্যাম্পের দিক থেকে পুলিশ, আনসার, ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ। শুধু নয়াটোলা ছাড়া কোনো দিকে যাওয়ার মতো উপায় ছিল না। একটা অগ্নিদগ্ধ পুলিশের গাড়ি দেখলাম আবুল হোটেলের সামনের রাস্তায় পড়ে আছে। একপর্যায়ে সাংঘাতিক গোলাগুলি, টিয়ার শেল আর সাউন্ডগ্রেনেডের হামলা শুরু হলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় লক্ষ করলাম সাধারণ মানুষ অধিকাংশ ছিল এই আন্দোলনের পক্ষে। গোলাগুলির মধ্যে আমরা কয়েকজন একটা বাড়ির গেটের ভিতর ঢুকে গেলাম। বাড়িরওয়ালা সবাইকে নিরাপদে সেল্টার দিলেন। পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেননি। যাহোক, ছাত্রদের এ মহান আন্দোলনে সঠিক ও ভুল অনেক কিছুই ছিল। প্রতিটি আন্দোলনেই এটা থাকে। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। সঠিক-ভুল এগুলো তো খুবই আপেক্ষিক বিষয়। আমার কাছে যা সঠিক, অন্যের কাছে তা ভুল মনে হতেই পারে। আবার অন্যের কাছে যা সঠিক আমার কাছে তা ভুল মনে হয়। এটার প্রধান কারণ, একের আর অন্যের মানসিকতার পার্থক্য। তাই কোনটা ভুল আর শুদ্ধÑ এমন তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করার প্রয়োজন নেই। তর্কে-বিতর্কে এর সমাধান কখনোই হবে না। আমাদের দরকার হলো একটি সহনশীল ও গঠনমূলক সমাজের ক্ষেত্র তৈরি করা। যেখানে সবাই সবার মতটা তুলে ধরতে পারবে। সবার জন্য যুক্তির দোয়ার উন্মোচন করা। এভাবেই সমাজ ও রাষ্ট্রকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে সিনা লিখেছেন, ‘বিতর্ক জ্ঞানীদের জন্য মেধার শাণস্বরূপ, মূর্খদের জন্য শত্রুতা তৈরির বীজ হিসেবে কাজ করে।’ আমরা আগামী প্রজন্মের জন্য একটা উর্বর ভিত্তিভূমি রেখে যেতে চায়। আর কতকাল আমরা চাণক্যনীতির আড়ালে পিষ্ট হতে থাকবো।
আগুনের হলকার মতো একটা আওয়াজ ভাসতে থাকে বাতাসে, ইথারে ইথারে, একটা ঘোষণা আসতে থাকে লু হাওয়ার সাথে সাথে। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিজ।’ তারপর থেকে এখনো পর্যন্ত চোখের সামনে যা কিছু দেখছি একদিন সব হয়তো উধাও হয়ে যাবে স্বপ্নের মতো। চাঁদের আলোয় কতই না বিশাল দেখা যায় এ পৃথিবীকে, এমন একসময় আসবে, তখন স্মৃতির আয়নায় এ পরিচিত পৃথিবীটাকে অনেক ছোট মনে হবে। আনন্দের আগমনী বার্তা নিয়ে এসেছিল যে ঘোষণা, সময়ের বিবর্তনে তা হয়তো একদিন মন খারাপের একটা যুক্তি নিয়ে হাজির হবে। তখন হয়তো কাউকে পাশে পাওয়া যাবে না। সবসময় স্মৃতির সাগর ডুব মেরে থাকে দিনের আলোয়। এমনকি সব স্মৃতিকেও মেঘ আড়াল করে রাখে। সাধারণত স্মৃতিতে থাকে বাস্তবতা বিবর্জিত আবেগ। আমাদের এ আবেগকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে ২০২৪-এর এ মহান জুলাই বিপ্লবকে আমাদের প্রকৃত স্বাধীনতার দলিলে স্থান দিতে হবে। তা জুলাই সনদ বা যে নামেই হোক। এবার যদি আমরা ব্যর্থ হই, তাহলে আমাদের এ বাংলাদেশকে আর কখনো আমরা সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো বলে মনে হয় না।
লেখক : কবি।