আরাকানে প্রত্যাবর্তনই রোহিঙ্গা মুসলিমদের রক্ষার সঠিক পথ


২৩ অক্টোবর ২০২৫ ২০:০০

॥ মুহাম্মদ আল্-হেলাল ॥
হাজার বছরের পুরনো জাতিসত্তার অনুসন্ধান করলে রোহিঙ্গাদের নাম উঠে আসে। আজ সেই রোহিঙ্গাদের জাতিসত্তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত মিয়ানমারের বৌদ্ধ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদের ছোবলে নিশ্চিহ্ন হবার পথে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পরও রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের পৃথিবীর মানচিত্রে রক্ষা করতে এখন সময় এসেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে বিকল্প চিন্তা করার।
রোহিঙ্গার নৃতাত্ত্বিক পরিচয়
রোহিঙ্গাদের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। জাতিগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ওপর আরব, মুঘল ও পর্তুগিজদের প্রভাব রয়েছে। প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যীয় মুসলমান ও স্থানীয় আরাকানীদের সংমিশ্রণে সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। পরবর্তীতে চাটগাঁইয়া, রাখাইন, আরাকানি, বার্মিজ, বাঙালি, ভারতীয়, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষদের মিশ্রণে উদ্ভূত এই শংকর জাতি ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পঞ্চদশ শতাব্দী হতে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আরাকানে রোহিঙ্গাদের নিজেদের রাজ্য ছিল। ঐতিহাসিকভাবে এটি প্রতিষ্ঠিত যে, ব্রিটিশরা বার্মায় শাসক হিসেবে আসার কয়েক শতাব্দী আগে হতেই রোহিঙ্গারা আরাকানে জাতিগোষ্ঠী হিসেবে বিকশিত হয়েছিল। ১৭৯৯ সালে ব্রিটিশ নথিতে ‘রুইঙ্গা’ হিসেবে তাদের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। তারা ‘রুয়াইঙ্গা’ বা ‘রোহিঙ্গা’ ভাষায় কথা বলে। রোহিঙ্গারা মূলত স্বাধীন আরাকান রাজ্যের অধিবাসী ছিল, যা ১৮২৬ সালে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে এবং ১৯৪৮ সালে মিয়ানমারের এক অংশে পরিণত হয়। সাংস্কৃতিক বিবেচনায় রোহিঙ্গারা মুসলিম তবে কিছুসংখ্যক হিন্দুও রয়েছে।
বিভিন্ন কারণে জাতিগোষ্ঠী রোহিঙ্গা আজকের সঙ্কটাপন্ন জাতিতে পরিণত হয়েছে।
আরাকান রাজ্য
রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মি যেভাবে শক্তি বাড়িয়ে বিভিন্ন এলাকা দখল করে নিয়েছে, তাতে করে বিচলিত হয়ে পড়েছে মিয়ানমার সরকার। তবে ওয়াং ম্রা নাইং নামে আরাকান আর্মির এক প্রভাবশালী সামরিক নেতার একটি ইন্টারভিউ থেকে জানা যায়, তারা রাখাইন প্রদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়ছে না। ওয়াং ম্রা নাইংয়ের মতে, ‘১৯৭১ সালে এ অঞ্চলে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু ৫০ বছর পর পরিস্থিতি ভিন্ন। আশপাশের শক্তিশালী (ভারত ও চীন) দেশগুলো কেউ চাইছে না এ অঞ্চলে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হোক।’ আরাকান আর্মি পরিষ্কার ভাষায় বলেছে, চীন ও ভারতের সঙ্গে আরাকান আর্মির যোগাযোগ আছে। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার স্বীকার করি। কিন্তু বার্মিজ মিলিটারিকে বিশ্বাস করা যায় না। তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত বদল করে।’ যদিও রোহিঙ্গাদের ওপর তাদের অত্যাচারও অব্যাহত রয়েছে। ইউরোপে সিরীয় শরণার্থী, কেনিয়ায় সোমালি শরণার্থী, পাকিস্তানে আফগান শরণার্থী- তারা সবাই একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পালিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছিল। অনেক শরণার্থী সমস্যা আবার প্রথমবারের মতো সৃষ্টি হয়েছিল। সেদিক থেকে রোহিঙ্গা সমস্যা ভিন্ন, যা একটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সহযোগিতায় একপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ফলে সৃষ্ট। তারা কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে পলায়নপর কোনো উদ্বাস্তু নয়। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও ইউএনএইচসিআর মানবিক সহায়তার মাধ্যমে ক্যাম্পে স্থায়ীকরণে ও স্থানীয়করণে উদ্বুদ্ধ করে শরণার্থী জনগোষ্ঠীকে আশ্রয়দাতা দেশের সংস্কৃতি, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে নানাবিধ বিনিয়োগ সহায়তা করে থাকে।
ঐতিহাসিক বৈষম্য: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের পক্ষে থাকা রোহিঙ্গা মুসলিমরা জাপানের মিত্রপক্ষ হিসেবে থাকা রাখাইন বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এরপর থেকে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস ও শত্রুতা বৃদ্ধি পায় এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সন্ত্রাসবাদের ছোবলে রোহিঙ্গারা জ্বলতে জ্বলতে বিপন্ন হওয়ার প্রান্তে।
সামরিক দমন-পীড়ন: দীর্ঘসময় ধরে মিয়ানমারের সামরিক সরকার স্থানীয় বৌদ্ধদের সহযোগিতায় রোহিঙ্গাদের ওপর নানা ধরনের নিপীড়ন চালিয়ে এসেছে। ১৯৭৭-৭৮ সালে ‘অপারেশন ড্রাগন কিং’-এর মতো সামরিক অভিযানগুলো ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক এলেইন পিয়ারসন বলেছেন, ‘আরাকান বা রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর যে ধরনের নিপীড়ন চালিয়ে আসছে, আরাকান আর্মিও ঠিক সেরকম দমননীতি অনুসরণ করছে। তাদের উচিত, এ বৈষম্যমূলক ও নিপীড়নমূলক আচরণ বন্ধ করে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা।’ (৩০ জুলাই ২০২৫; প্রথম আলো)।
রোহিঙ্গাদের বিয়ে করার জন্যও স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নেয়া লাগে। দুটির বেশি সন্তান নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রশাসনের অনুমতি না নিয়ে বিয়ে করায় ও দুজনের বেশি সন্তানের জন্ম দেয়ায় রোহিঙ্গা পরিবারের সন্তানদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। এসব পরিবারের সন্তানরা সরকারের ‘গ্যাটো ব্যবস্থা’ তালিকাভুক্ত নয়, ফলে এদের জীবন ফোড়ার ওপরে বিষ ঘা-এর মতো হয়ে উঠেছে। এরা গ্যাটোগুলোয় থাকতে পারে না। আবার গ্যাটোর বাইরেও থাকতে পারে না, কারণ, মিয়ানমারের নাগরিক নয় ওরা। অবস্থাটা ওদের এমন যে, মিয়ানমার সরকার ওদের কোনো অস্তিত্বই স্বীকার করে না। এসব পরিচয়হীন রোহিঙ্গারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের পথে পা বাড়ায়। নৌপথে সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে অসংখ্য রোহিঙ্গা সলিল সমাধি হয়।
ভারতের মানবতাবিরোধী অবস্থান
ভারত সরকার; বিশেষ করে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি, রোহিঙ্গাদের ‘অবৈধ বিদেশি’ হিসেবে গণ্য করে, শরণার্থী হিসেবে নয়। ভারত শরণার্থীদের সুরক্ষায় কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো রোহিঙ্গাদের ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখাচ্ছে। এ নীতি হিন্দু জাতীয়তাবাদী ও ইসলামবিদ্বেষী ধারণার সঙ্গে জড়িত বলে মনে করা হয়। যদিও রোহিঙ্গাদের মধ্যে কিছু হিন্দু ধর্মাবলম্বী রয়েছে। ভারত সরকার একাধিকবার বলপূর্বক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করেছে, সেখানে তাদের ওপর নিপীড়ন ও সহিংসতার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত নৌবাহিনীর মাধ্যমে কিছু রোহিঙ্গাকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার মতো অমানবিক পদক্ষেপ নেওয়ার ঘটনা মিডিয়ায় উঠে এসেছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক ফোরামে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অবস্থান, আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগ এবং জান্তা সরকারকে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে দেশটির বিরুদ্ধে।
নাগরিকত্বহীনতা: ১৯৮২ সালের মিয়ানমার নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। মিয়ানমার সরকার ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, রোহিঙ্গারা এ তালিকার অন্তর্ভুক্ত নয়। ফলে তারা রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে, যাদের কোনো আইনি অধিকার নেই। যদিও ইতিহাস বলে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাস করে আসছে।
SLORC: ১৯৯১-৯২ সালে The State Law and Order Restoration Council (SLORC) এর মাধ্যমে মিয়ানমার সরকার উত্তর আরাকান বা রাখাইন স্টেটে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধন শুরু করে।
২০১৭: অপারেশন ক্লিয়ারেন্স, যেখানে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এছাড়া মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য ‘গ্যাটো’ জাতীয় বিশেষ ধরনের ব্যবস্থা করেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য বেশ কয়েকটি বিশেষ বসবাসের স্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা থেকে তারা অনুমতি ছাড়া বের হতে পারে না। সেই গ্যাটোগুলোর ভিতরে আবদ্ধ মানবেতর জীবনযাপন করে রোহিঙ্গারা। চিকিৎসা, শিক্ষা ও উপযোগ সেবার ব্যবস্থা গ্যাটোগুলোয় তেমন নেই।
রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনে আন্তর্জাতিক ভূমিকা
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অংশীজন রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনে ইতোমধ্যেই কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে আরো কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের আর্থিক, কূটনৈতিকসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে থাকে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় এবং মানবিক সহায়তা দেওয়ার জন্যও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেছে। (২৫ আগস্ট ২০২৫; প্রথম আলো)।
সামরিক বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা: ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর ইইউ মিয়ানমারের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জোরদার করেছে। এ নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য সামরিক বাহিনীকে প্রভাবিত করা, সাধারণ মানুষের ক্ষতি করা নয়।
মুসলিম বিশ্বের ভূমিকা
রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিয়ে মুসলিম বিশ্বের ভূমিকা মিশ্র এবং জটিল। একদিকে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, যেমন বাংলাদেশ, ওআইসিভুক্ত দেশসমূহ এবং ইসলামিক এনজিওগুলো মানবিক সহায়তা এবং আশ্রয় প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মুসলিম বিশ্ব সম্মিলিত এবং সুসংহতভাবে প্রায়োগিক শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে পারেনি। যদিও এ সংকট একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ইস্যু। অনেক মুসলিম দেশ আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে, যা রোহিঙ্গাদের জীবনধারণ ও মানবিক সেবায় ব্যয় হয়েছে।
রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা
বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তিনটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সম্মেলনের আয়োজন করছে। প্রথমটি অনুষ্ঠিত হয় ২৫ আগস্ট ২০২৫ সোমবার কক্সবাজারে। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বাকি দুই সম্মেলনের একটি ৩০ সেপ্টেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হয়। অন্যটি হবে আগামী ৬ ডিসেম্বর কাতারে। সম্মেলনে রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস স্মরণে অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। (২৫ আগস্ট ২০২৫; প্রথম আলো)।
ক) মানবিক আশ্রয় ও মৌলিক পরিষেবা : বাংলাদেশ কক্সবাজারের ৩৪টি শিবিরে ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। এই আশ্রয় প্রদানকে সাম্প্রতিক ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মানবিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়। ইউএনএইচসিআর প্রধান বলেন, ‘অসংখ্য চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনো রোহিঙ্গার আশ্রয় দিয়ে বিশ্বের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
খ) ভাসানচরে স্থানান্তর: কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোর ওপর চাপ কমাতে বাংলাদেশ সরকার প্রায় ৩০,০০০ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরিত করেছে। জাতিসংঘের সহায়তায় এই দ্বীপে আশ্রয়, খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মতো মৌলিক পরিষেবা নিশ্চিত করা হয়েছে।
গ) কূটনৈতিক প্রচেষ্টা: রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য বাংলাদেশ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তিনটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে বিভিন্ন কূটনৈতিক প্রচেষ্টা রেখে দেশের অভ্যন্তরে তাদের যথাসম্ভব মানবিক সহায়তা প্রদান করছে।
ঘ) মানবিক করিডোর: জাতিসংঘের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, ১৯৯০ সালের আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীনে মানবিক করিডোর একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি চুক্তি, যা যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো সংকটময় পরিস্থিতিতে নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা, ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানো, চিকিৎসা ও আহতদের সরিয়ে নেওয়া, শরণার্থীদের নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়। নিরাপত্তা ইস্যু থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর কল্যাণে এমন মানবিক করিডোর দিতে সম্মতি জানিয়েছে। যদিও এমন মানবিক করিডোর দেওয়ার উদাহরণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রয়েছে।
রোহিঙ্গা প্রভাবিত বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক: বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী ৭৫ বছর ধরে দেশটির কোথাও না কোথাও নিজ জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত আছে। ২০২২ সালে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী বাংলাদেশের দিকেও মর্টার ও গুলি ছুড়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে। তথাপিও বাংলাদেশ আশা করে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সফল রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন সম্ভব এবং সে উদ্দেশ্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। (৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪; কক্সবাংলা ডটকম)।
সম্ভাব্য সমাধান
২০২৪ সালে রোজার মাসে আশ্রয়শিবিরে গিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসকে পাশে রেখে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, আগামী পবিত্র ঈদুল আজহার নামাজ রোহিঙ্গারা আরাকানে পড়বে। তাঁর কথায় রোহিঙ্গারা খুশি হয়েছিল। কিন্তু অগ্রগতি নেই বললেই চলে। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কেবল মিয়ানমারের ভেতরেই সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) ফিলিপ্পো গ্রান্ডি। বাংলাদেশ জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মুসলিম বিশ্বসহ বিভিন্ন অংশীজনদের সমন্বয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন করার চেষ্টা করছে, তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত মিয়ানমারের বৌদ্ধ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদের ছোবলের কারণে সম্ভব হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর নিরাপত্তা দিতে না পারলে অচীরেই এই জাতিগোষ্ঠী বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সুতরাং পৃথিবীর মানচিত্রে রোহিঙ্গা জাতিসত্তাকে টিকিয়ে রাখতে মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন ছাড়া বিশ্বের সামনে অন্য কোনো বিকল্প নেই। সর্বোপরি আরাকানে প্রত্যাবর্তনই রোহিঙ্গা মুসলিমদের টিকিয়ে রাখার একমাত্র সঠিক পথ।
লেখক : এমফিল গবেষক (এবিডি), আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]