কবি ফররুখ আহমদ সম্পর্কে আরো কিছু কথা


১৬ অক্টোবর ২০২৫ ১৪:১৩
॥ তৌহিদুর রহমান ॥
কবি ফররুখ আহমদের শিশুকাল ছিল অনেক মধুময় স্মৃতিতে ভরপুর। মধুমতী নদীর উথাল-পাথাল ঢেউ কবির শিশুমনে ঢেউ তুলেছিল সেই শৈশবেই। নদী ভাঙার গান তাকে আজীবন সুর ও ছন্দে আন্দোলিত ও মোহিত করে রেখেছিল। তাই তো কখনো মধুমতীকে ভুলতে পারেননি কবি। স্রোতের টানে ভেসে চলা নৌকা, আর বিশাল বিশাল জাহাজ, লঞ্চ, স্টিমার সেই শৈশবেই কবি মনকে টাপুর-টুপুর করে তুলেছিল।
টাপুর টুপুর বিষ্টি পড়ে,
মিষ্টি মধুর বাজনা,
হাত নিশপিশ পা নিশপিশ
কে দেবে আর খাজনা।
মশাল জ্বেলে চলতে পথে
একশোটা বর যাত্রী
বরের দেখা পায় যদিও
পায় না খুঁজে পাত্রী।
টাপুর টুপুর বিষ্টি পড়ে,
মেজাজটা তাই ঠাণ্ডা,
পাওয়া যায় কিনতে পথে
মোহন মিয়ার পাণ্ডা। (বিপুর ছড়া)
বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদ বলেন, ‘তার কবিতা-ছড়া প্রভৃতির মিষ্টি ছন্দের আওয়াজ সোজাসুজি মনের আর কানের মধ্য দিয়ে রক্তের ভেতরে চলে যেতে থাকে। দু-একবার লেখাগুলো পড়লে সহজে আর ভোলা যায় না।’ (টাপুর টুপুর, ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, ১৯৭৩)।
প্রত্যেক কবির জীবনে নদী একটা অনুসঙ্গ বটে। আমাদের এই ষড়ঋতুর সোনালি দেশে নদী ও নারী সব সময় একই সমান্তারে চলে। নদী ও নারী আমার সোনার বাংলায় কান্না-হাসির প্লাবনের সাথে পলির আবির মাখা রং ছড়িয়ে বাংলা মায়ের আঁচলকে সদা-সর্বদা শ্যামল করে রাখে। তাই নারীর মতো নদীও বাংলার মানুষের মনে শান্তির পরশ বুলিয়ে যায় আবার কখনো অশান্তির রুদ্ররূপ বিস্তার করে। মহাকবি মাইকেল যেমন দূর প্রবাসে অবস্থান করেও কখনো ‘কপোতাক্ষ নদ’কে ভুলতে পারেননি কবি ফররুখ আহমদও তেমন মধুমতী নদীকে কখনো ভুলতে পারেননি। ‘এখানে রমণীগুলো নদীর মতো, নদীও নারীর মতো কথা কয়।’ নদীর সাথে নারীর এই মিলনের কলোকাকলি যুগ-যুগান্তর ধরে কাব্যরসে কবি মনকে সিক্ত করতে থাকে। তাই তো দেখা যায়, মধুমতীর পাড় থেকেই কবি ফররুখ আহমদ ‘সাত সাগরের মাঝি’র ডাক শুনতে পেয়েছিলেন।
‘কতো যে আঁধার পর্দা পারায়ে
ভোর হলো জানি না তা
নারঙ্গি বনে কাঁপছে সবুজ পাতা।’ (সাত সাগরের মাঝি)
তার শৈশবের দৃশ্য ছিল সুন্দর বাংলার গ্রামীণ সবুজ তৃণভূমি, দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ, নদীর কলরব আর পাখির গান। এই শৈশবের অভিজ্ঞতা অবশ্যই সহায়ক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে তার কাব্যমালায়Ñ যার ফলস্বরূপ শিশু ও কিশোরকাল থেকেই সফলভাবে লিখেছেন তিনি অনেক শিশুবান্ধব গান ও কবিতা। শিশুদের জন্য তাঁর লেখা সবসময় শিশুদের মন কেড়েছে। প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক প্যাট্রিক জোনাথন সুইফট ও মার্ক টোয়েন প্রমুখের সারিতে রাখা যায় কবি ফররুখ আহমদকে। জীবনের শুরুর দিকে লেখা কবির এই শিশুতোষ ছড়া এখনো তুমুলভাবে জনপ্রিয়। তার ‘মেঘ-বৃষ্টি আলোর দেশে’ ছড়াটি এখানে উদ্ধৃত করা হলো।
মেঘ-বৃষ্টি আলোর দেশে
সুরুজ ওঠে রাঙা বেশে,
পথের পাশে পদ্ম ফোটে,
মৌমাছিরা আপনি জোটে।
মেঘ-বৃষ্টি-আলোর দেশে
মনটা শুধু বেড়ায় হেসে,
শালিক ডাকে সজনে গাছে
ঝিঙে মাচায় ফিঙে নাচে।
মেঘ-বৃষ্টি-আলোর দেশে
বাদল ধনু হাওয়ায় মেশে
রোদ্দুরে রঙ ঝিলিক দিয়ে
হঠাৎ কোথায় যায় মিলিয়ে।
মেঘ-বৃষ্টি-আলোর দেশে
পলাশ ফোটে বনের কেশে,
শিমুল পারুল চম্পা ডাকে
কর্ণফুলী নদীর বাঁকে।
মেঘ-বৃষ্টি-আলোর দেশে
দূরের মানুষ দাঁড়ায় এসে,
আম-কাঁঠালের ছায়ায় ঘেরা
পায় যে কুটির মায়ায় ঘেরা।
মেঘ-বৃষ্টি-আলোর দেশে
সন্ধ্যা নামে দিনের শেষে।
কিসসা কথা সাজ আসরে
শুনি সকল ঘরে ঘরে। (মেঘ-বৃষ্টি আলোর দেশে, ফররুখ আহমদ)।
গ্যাসের আলো, ফুটপাতের দুর্ভিক্ষের কারখানা এবং সমস্যাসহ কলকাতা মেট্রোপলিটন শহর ছিল তার কৈশোর এবং যৌবনের অভিজ্ঞতার স্থান। তাই, তার প্রাথমিক কাজগুলো অপরিহার্যভাবে তারুণ্য এবং ল্যান্ডস্কেপের ক্ষেত্রে কলকাতা মহানগরের হৃদয়হীন পরিবেশ-পরিস্থিতি ও মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। ফররুখ আহমদের কলকাতা জীবনের শুরুর দিকের লেখাগুলোকে একটি সূচনা নোট হিসেবে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী উল্লেখ করেছেন। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, ‘ফররুখ তাঁর জীবনের প্রতি গভীর কৌতূহলী ও জিজ্ঞাসাবাদের মনোভাব যুক্ত করেছেন। সেখানে স্থান করে নিয়েছে বিশেষ ধরনের রোমান্টিকতা।’
অনেকের মতে, কবি ফররুখ আহমদ ইতিহাসের পথপরিক্রমায় মানুষকে চিরন্তন পথিক বলে মনে করেছেন। দেখা যায় যুদ্ধ-বিগ্রহ, দুর্ভিক্ষ, মানুষের অপমৃত্যু কবিমনকে সবসময় প্রভাবিত করেছে। প্রকৃতপক্ষে জীবনের এই বিশেষ সময়ে মানুষের মনে জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। এটি লেজার কাটারের মতো তাকে বার বার ক্ষত-বিক্ষত করেছে, ফলে তার লেখায় এটি প্রধান সারমর্ম হিসেবে কাজ করেছে। ‘লাশ’ কবিতা তারই প্রতিফলন। লাশ দ্বারা পরিবেষ্টিত কবি পথে-প্রান্তরে দেখতে পেয়েছেন মানবতার অপমৃত্যু। অসংখ্য মৃতদেহ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে তিনি জীবনের সমুদ্র সফেন অসীম সাগরের ইতিহাস এবং মিথের সন্ধান করেছেন। সবসময় মানবতার করুণ মৃত্যুর চিত্র তাকে এক বিশেষ ধরনের রোমান্টিসিজমে মোহগ্রস্ত করে রেখেছিল। বিশেষ করে শাসক-সৃষ্ট বিপর্যয় ও দুর্ভিক্ষ- কবির ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় এটি হলো মৃত্যুর অপর নাম। যদিও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি মানুষের এই ‘অপরিপক্ব মৃত্যু’ ইত্যাদি মানবিক বিপর্যয়কে মেনে নিতে পারেননি। অন্যদিকে মৃত্যুকে তিনি কখনোই জীবনের চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি বলে মনে করতেন না। জীবনের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ, দিশেহারা, বীতশ্রদ্ধ, হতাশ সংবেদনশীল কবিরা যেমনটি করেছেন কবি ফররুখ আহমদ সেদিক থেকে ছিলেন ধীর-স্থির-শান্ত। তার জীবন চলার পথ সবসময় সাগরের মতো উত্তাল তরঙ্গায়িত ছিল। তবে এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পাহাড়ের মতো অটল। যত প্রচণ্ড জোরে তরঙ্গমালা একের পর এক তার বুকে আছড়ে পড়েছে তিনি সবকিছু দৃঢ়ভাবে তা সামলে নিয়েছেন।
আমরা দেখতে পাই জীবনের প্রতি ক্ষুব্ধ, বীতশ্রদ্ধ, হতাশ সংবেদনশীল কবিরা মানসিক অস্থিরতা ও উন্মাদনার চাপ সহ্য করতে না পেরে যেমনটি করেছেন অর্থাৎ আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নিয়েছেন। যেমন- কবি সিলভিয়া প্লাথ, জন বেরিম্যান, নাট্যকার ইউজিন ওনিল এবং টেনেসি উইলিয়ামস প্রমুখ। অনেকে আত্মহত্যার আগে স্বীকারোক্তিমূলক ভাষ্য দিয়েছেন। এমনকি জীবনানন্দ দাশের কবিতায়ও আমরা বার বার ‘মৃত্যু অভিযান’ দেখতে পাই। সেজন্য অনেকে মনে করেন, জীবনানন্দের মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা নাকি আত্মহত্যা?
উপরে যে আলোচনা চিত্র আমরা পেলাম তা কবি ফররুখ আহমদ ‘নিজের রক্ত’ শিরোনামের লেখা এই কবিতায় যেন অনেকখানি ব্যক্ত করেছেন:
‘এবার দেখেছি নিজের রক্ত, দেখেছি আর
রক্ত নেবার পাশবিক মত্ততা,
এবার শুনেছি কোটি ফরিয়াদ, শুনেছি আর
শত মুমূর্ষু কণ্ঠের আকুলতা।
শুনেছি অযুত মানুষের আহাজারি-
শুনেছি দু’পাশে অসহায় হাহাকার;
নিজের রক্তে ভাসায়েছি এ পৃথিবী-
মৃত্যুর মুখে পথ নাই বাঁচিবার।
নিজের কণ্ঠ খুঁজেছি প্রেতের মতো,
করেছি অন্ধ নিজের ঘরেই চুরি;
বুঝি নাই কার আদেশে ভাগ্যহত
নিজের বুকেই নিজে চালিয়েছি ছুরি।
এখনো অন্ধ আঁধারে শিকার খুঁজি
নিজের জন্য ফাঁদ পেতে ধরা পড়ি;
হাসে ইবলিস মৃত্যুর জাল ফেলে-
জাগে চারপাশে শৃঙ্খল শর্বরী।
পেয়েছি নিজের রক্তের স্বাদ, পেয়েছি আর
রক্ত নেবার দুঃসহ সংবাদ;
কা’কে দিয়ে যাব এই দুঃসহ পাপের ভার-
এই ক্ষমাহীন আঘাতের অনুনাদ। (নিজের রক্ত, অগ্রন্থিত কবিতা, ২৭ অক্টোবর, ১৯৪৬)।
যাহোক, ফররুখের মৃত্যু-পূরবর্তী বিশ্বাস তার রচনায় একটি সুস্থ আশাবাদ যোগ করেছে। আপস বা আত্মহত্যার পরিবর্তে শূন্যতা, অপ্রাপ্তি, ধ্বংস, অশুভ প্রচারের পরিবর্তে কবি ফররুখ আহমদ জীবনের শুরু থেকেই প্রতিরোধের অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তার আশাবাদ পাঠকদের কাছে হস্তান্তরযোগ্য যা পাঠকের মনে নৈতিকতা বৃদ্ধি করে। (এই লেখার অধিকাংশ তথ্য কবিপুত্র এস এম ওয়াহেদুজ্জামান থেকে প্রাপ্ত)।