কবি হাসান আলীম ও তার কাব্যে কুরআন


১৬ অক্টোবর ২০২৫ ১৪:১২

॥ তাজ ইসলাম ॥
‘বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি, সাহিত্য সমালোচক, নজরুল গবেষক এবং সমাজচিন্তক হাসান আলীম ছড়া, কবিতা, গীতিকবিতা, প্রবন্ধ, গবেষণা, ছোটগল্প, নাটকসহ বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করেন।
তার ৫০-এর অধিক গ্রন্থ বের হয়েছে এবং এর মধ্যে ৩২টিই কবিতা গ্রন্থ। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে কবিতা লিখলেও তার মূল বিষয় বিশ্বাস এবং আধ্যাত্মিকতা।’
হাসান আলীম বিশ্বাসী কবি। পবিত্র কুরআন মুসলমানদের পবিত্র ঐশি কিতাব। সারা পৃথিবীতেই সাহিত্যিকগণ নিজ মাতৃ ভাষায় এর অনুবাদ করেছেন আবেগ ও বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করে।
হাসান আলীমও কাব্যময় ভাষায় আল কুরআনকে অনুবাদ করেছেন। এটি বই আকারে প্রকাশিত। এ প্রসঙ্গে তিনি ‘লেখকের কথা’ বলে বাংলা ভাষায় কুরআন অনুবাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরেছেন। সেখানে তিনি কেন কুরআন অনুবাদে উৎসাহিত হয়েছেন, কীভাবে নিজেকে ক্রমে ক্রমে প্রস্তুত করেছেন সেসব কথা বলেছেন।
‘বাংলা ভাষায় কে সর্বপ্রথম আল কুরআন অনুবাদ করেন মৌলভী নাইমুদ্দীন। তিনি ১৮৩৬ সালে পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা ভাষায় গদ্য ফর্মে অনুবাদ কর্ম শুরু করেছেন মাওলানা আমির উদ্দিন বসুনিয়া বাংলাদেশের রংপুরের সন্তান তবে তার অনুবাদ আমপারায় সীমাবদ্ধ ছিল।… আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘কাব্য আমপারা’ (১৯৩৩) শিরোনামে পবিত্র কুরআন মাজিদের তিরিশতম পারার কাব্যিক অনুবাদ করেছেন। তিনি পয়ার ছন্দে এবং অক্ষরবৃত্ত ছন্দে এর অধিকাংশ কবিতা অনুবাদ করেছেন।
ইসলামী রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ ‘কুরআন মঞ্জুষা’ (২০২৩) শিরোনামে আমপারার অধিকাংশ সূরা এবং কুরআন মাজিদের আরও কিছু সূরার কাব্যিক ভাবানুবাদ করেছেন। তিনি অক্ষর বৃত্ত এবং মাত্রাবৃত্ত ছন্দে সূরাগুলোর মূলভাব অবলম্বনে ভাবানুবাদ করেছেন।
এখানে লেখক ২০২৩ লিখেছেন। কেন লিখেছেন তা বোধগম্য নয়। ২০২৩ সালে প্রকাশিত নাকি ভুলবশত তা স্পষ্ট নয়। সম্ভবত ফররুখের এই বইটি প্রকাশ হয়েছে ২০২৩ সালে।
এরপর তিনি নিজের বিষয়ে বলেছেন, ‘সূরা ফাতিহাসহ আমপারার ৩৮টি সূরার কাব্যিক ভাবানুবাদ করেছি পয়ার ছন্দে, অক্ষর বৃত্ত ছন্দে এবং স-মিল মুক্তক অক্ষর বৃত্ত ছন্দে। মাত্রা বৃত্ত ছন্দে, স্বরবৃত্ত ছন্দেও কয়েকটি সূরার ভাবানুবাদ করেছি। কোনো কোনো সূরার কাব্যিক ভাবানুবাদে ছন্দের এক মাত্রার কম বেশি করেছি কোনো কোনো পঙক্তিতে।’
লেখকের এমন বক্তব্যের পর পাঠকের কাছে মোটামুটি একটি বার্তা অবশ্য পৌঁছে যায়। আর কথা না বললেও চলে।
আগেই কবি হাসান আলীম সমন্ধে একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে। তিনি একজন অন্যতম কবি, সব্যসাচী লেখক। একজন বিশিষ্ট ছন্দ বিজ্ঞানীও তিনি।
তার এই সৃজন কর্মে ছন্দ নিয়ে খেলা করেছেন। একই সূরা একাধিক ছন্দে লিখেছেন।
সূরা ফাতিহাকে প্রথম লিখেছেন
‘অক্ষর বৃত্ত পয়ার ছন্দে চৌদ্দ মাত্রা’র ফর্মে।
তারপর আবার লিখেছেন ‘মাত্রা বৃত্ত ছন্দে’
একই সূরাকে তিনি লিখেছেন ‘স্বরবৃত্ত ছন্দে’।
আবার সূরা নাস লিখেছেন ‘স-মিল মুক্তক অক্ষর বৃত্ত ছন্দে’
‘স-মিল মুক্তক মাত্রা বৃত্ত ছন্দে’
‘স্বরবত্ত ছন্দে’।
একই সূরাকে একাধিক ছন্দে লিখে নিজের শ্রম, ধৈর্য ও প্রায়োগিক দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। পরবর্তী নবীন পাঠকের জন্য এটি একটি নমুনা গ্রন্থ, গবেষণার জন্য রেফারেন্স যোগ্য অনন্য একটি গ্রন্থ হিসেবে চিহ্নিত হবে। লেখার সময় কাব্য মান, স্বতঃস্ফূর্ততা, সাবলীলতার প্রতি তিনি ছিলেন সতর্ক প্রহরী।
‘গবেষণা করো তুমি পরম প্রভুর নামে, মানুষ বানিয়েছেন যিনি জরায়ুর চামে’। (সূরা আল আ’লাক)।
চমৎকার বিষয় হল সূরাগুলোর নামেরও অভিনব নাম নির্বাচন করেছেন। যেমন সূরা আ’লাক এর নাম রেখেছেন ‘তরল জলের ভ্রƒণ’।
সূরা আল ফজর: ঊষার কসম।
এই সূরাটির কাব্যময় রূপের সূচনা ‘কসম ঊষার সুকোমল ফজরের/ কসম পবিত্র সেই দশটি রাতের’।
‘মধ্য যুগের প্রখ্যাত কবি শাহ মোহাম্মদ সগীর ১৩৮৯ সালে বাংলা ভাষায় কাব্যিক ফর্মে সর্বপ্রথম কুরআন মাজিদের অনুবাদ করেছিলেন।’ এরপর শত কবি অনুবাদ করেছেন নিজস্ব কাব্য শক্তি দিয়ে। হাসান আলীম বাংলাদেশের অন্যতম কবিদের একজন। তিনি ছন্দ বিজ্ঞানী। তিনিও কুরআন শরীফের কাব্যানুবাদ করেছেন। তার মতে, ‘অনেকে সূরা ফাতিহার যে অনুবাদ করেছেন তাতে কাব্যের ছন্দমান ক্ষুণ্ন হয়েছে।’ তিনি নিজে যখন কাব্যানুবাদ করেছেন তখন ছন্দ ও গতিময়তার প্রতি ছিলেন সজাগ। তার শ্রম সার্থক করে তুলতে তিনি অবশ্যই চেষ্টা চালিয়েছেন। অবশিষ্ট বিচার পাঠকেরা নির্ধারণ করবে।
আল কুরআন কাব্যে অনুবাদ করতে গিয়ে ছন্দের বিভিন্ন ফর্মকে প্রয়োগ করে একটি নজির রাখতে সক্ষম হলেন। অনেক সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েই তিনি এই কাজ সমাপ্ত করেছেন।
কাব্যানুবাদে অন্য কবিরা আরও বেশি সম্পৃক্ত হোক। একেক কবির ছন্দ, তালে ভিন্নতা পাবে তখন পাঠক। এই গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটি প্রকাশ পেয়েছে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ এ। প্রকাশ করেছে আমিনাহ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। প্রচ্ছদ শিল্পী বশির আহমেদ। মূল্য রাখা হয়েছে ৩০০ টাকা। আমরা তার বইটির বহুল প্রচার কামনা করি।
কবি হাসান আলীমের কবিতা গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য
শ্বাপদ অরণ্যে অগ্নিশিশু (১৯৮৩), নিঃসঙ্গ নিলয় (১৯৮৭), মৃগনীল জোসনা (১৯৯০), সবুজ গম্বুজের ঘ্রাণ (১৯৯১), তোমার উপমা (১৯৯৪), যে নামে জগৎ আলো (১৯৯৭), কাব্য মোজেজা (১৯৯৮/৯৯), ফানাফিল্লাহ (২০২৩), মায়ের জন্য এলিজি (২০২৪), গণঅভ্যুত্থান চব্বিশ (২০২৫)।
তার প্রায় ২৪টির মতো কবিতা গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে।
ছড়া ও কিশোর কবিতা ৭টি।
তার মধ্যে
পান্না সোনা কান্না
কচি কাঁচার আসর
কিশোর কলি
অন্ধ ঘোড়া
লাল জোনাকি চাঁদ সোনা কি
নতুন ছন্দের ছড়া উল্লেখযোগ্য।
এগুলো ২০০৪ সাল থেকে ২০২৪ সালের বিভিন্ন সময় প্রকাশিত।
গল্পগ্রন্থ দুটি, গবেষণা, সমালোচনা সাহিত্যে হাসান আলীম বাংলা সাহিত্যে বিশেষ আসনে অবস্থান করেছেন। ‘কাব্য চিন্তা’, ‘ছন্দ বিজ্ঞান ও অলঙ্কার’ কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার নন্দনতত্ত্ব ‘বিজ্ঞ মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তিনি কবি ফররুখ আহমদ ও কবি আল মাহমুদ সাহিত্য নিয়েও মূল্যবান গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেছেন। আশির দশক ও নব্বই দশকের কবি ও কবিতা নিয়ে তার আছে পৃথক গ্রন্থ। হাসান আলীম বহুমাত্রিক লেখক। তিনি সংগীতের পৃথক গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। বিজ্ঞান ভিত্তিক গল্প কাহিনী নিয়েও বই রচনা করেছেন। হাসান আলীম দক্ষ একজন সম্পাদকও। তার সম্পাদনায় প্রকাশ হয়েছে ‘আশির দশকের নির্বাচিত কবিতা’, রসূল (সা.)-কে নিবেদিত কবিতা স্মারক’ ‘হামদ নাত কবিতা সন্ধ্যা স্মারক’। কাব্যে কুরআন তার অন্যমাত্রার সংযোজন। এই গ্রন্থটি কবি হাসান আলীমকে সাহিত্যিক মহলে অন্য এক হাসান আলীম পরিচয়ে চিহ্নিত করতে সহায়ক।
আশির দশকের বহুমাত্রিক লেখক হাসান আলীমের জীবন, কর্ম, সাহিত্য নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মাধ্যমে তাকে পাঠকের সামনে হাজির করা শিল্প সাহিত্যের জন্যই জরুরি। আমরা আশাবাদী তাকে বাংলা ভাষার বিশাল পাঠক সমাজে তুলে ধরতে এগিয়ে আসবে সাহিত্যপ্রেমিক কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।
লেখক : কবি।