সুন্দরবনের দুবলারচরে ছয় মাসে ৩০০ কোটি টাকার বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসেবার বাইরে ৩৫ হাজার মানুষ
৯ অক্টোবর ২০২৫ ১৪:২৫
আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা : বাংলাদেশের সুন্দরবনের অভ্যন্তরে সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার মায়ায় জেগে ওঠা আশ্চর্য একটি দ্বীপভূমি দুবলারচর। কুঙ্গা ও মরা পশুর নদের মাঝে অবস্থিত বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপটি এখন পর্যটকদের পদচারণায় মুখর। ক্রমেই এটি হয়ে উঠেছে সুন্দরবনের একটি পর্যটন কেন্দ্র। এখানে দেখা মেলে লাল বক, মাছরাঙা, মদনটাক পাখির মতো নানা প্রজাতির পাখির, যা পর্যটকদের বাড়তি আকর্ষণ করে। এছাড়া এখানকার সৌন্দর্যের আরেকটি দিক হচ্ছে হরিণের ঘাস খাওয়ার দৃশ্য। সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলার প্রান্তঘেঁষে সুন্দরবনের শেষ সীমায় বঙ্গোপসাগরের তীরে গড়ে ওঠা দুবলারচর বাংলাদেশের জন্য এখন একটি হীরকখণ্ড হয়ে উঠেছে।
সুন্দরবনের জেগে ওঠা এই দ্বীপটির প্রধান পরিচয় হচ্ছে, এটি প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর। সুন্দরবনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সামুদ্রিক মাছের শুঁটকি উৎপাদনের প্রাণকেন্দ্রও এটি। সমুদ্রসম্পদ কাজে লাগিয়ে মাত্র ছয় মাসের জন্য ওই চরে গড়ে ওঠে শুঁটকিপল্লী। অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত সাগর কম উত্তাল থাকায় বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ ধরে সেখানে শুকানো হয়। সরাসরি সাগর থেকে নিয়ে এসে কোনো রাসায়নিক ছাড়া তাৎক্ষণিক রোদে শুকাতে দেওয়া হয় বলে স্বাদ ও গুণাগুণে অনন্য ওই শুঁটকি।
মাছ শিকার, শুঁটকি প্রস্তুতি এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে দুবলারচর বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। এটি হরিণ দেখা এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত, যা এখানকার পর্যটন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অবদান রাখে। আর ওই শুঁটকিপল্লী থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাছ যায় ২৫০ কোটি টাকারও বেশি। প্রতি বছর এ কাজে যুক্ত থাকেন ৩৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। দেশে শুধু মাছের চাহিদা পূরণই নয়, সরকারও প্রতি বছর বড় অঙ্কের রাজস্বও পেয়ে থাকে ওই চর থেকে।
খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলার সাড়ে ৬৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ দ্বীপটি একটি মৌসুমি মাছ ধরার গ্রাম এবং বাংলাদেশে শুঁটকি মাছ উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে বিখ্যাত। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমের পরে অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, চট্টগ্রাম এবং কক্সজারের মতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার জেলে এখানে অস্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। এ জেলেরা মূলত মাছ ধরা এবং শুঁটকি মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণে নিযুক্ত হন।
প্রতি বছর কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ভরা পূর্ণিমায় সুন্দরবনের দুবলারচর আলোরকোলে ৩ দিনব্যাপী রাসমেলা বসে। প্রতি বছরের মতো এবারও রাস পূর্ণিমা উপলক্ষে সুন্দরবনের দুবলারচরে আগামী ১৪ থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত তিন দিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী রাসমেলা অনুষ্ঠিত হবে। সুন্দরবনের দুবলারচরে শুরু হয়েছে প্রায় দেড়শ বছরের ঐতিহ্যবাহী রাস উৎসব। দুবলা জেলেপল্লী টহল ফাঁড়ির আওতাধীন অফিস কিল্লা-মাঝের কিল্লা, মেহেরআলীরচর, আলোরকোল, নারিকেলবাড়িয়া ও শেলারচরে শুঁটকি প্রক্রিয়ার কাজ শুরু হবে ১৪ নভেম্বর থেকে। শুঁটকিকে কেন্দ্র করে উপকূলীয় হাজার হাজার জেলে ও মৎস্যজীবীর আনাগোনায় মুখরিত থাকে এ চরগুলো। তবে এখনই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে জেলেরা।
জেলেদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে এলাকায় অস্থায়ী বাজার স্থাপন করা হয়- যেখানে খাদ্য, পোশাক এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করা হয়। এই অস্থায়ী গ্রামগুলোয় জেনারেটরের মাধ্যমে সীমিত বিদ্যুৎ সরবরাহও রয়েছে। তবে সুপেয় পানি এবং স্বাস্থ্যসেবার অভাব এখানে বসবাসকারী মানুষের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। শ্রমিক ও কর্মীরা দ্বীপে জেলেদের বিরুদ্ধে শিশুশ্রম ব্যবহারের অভিযোগ করেছেন। দুবলারচরে একটি বাজার আছে যার নাম দুবলারচর নতুন বাজার। এখানে কোনো ব্যাংকের শাখা নেই। তবে বিকাশ, নগদ, শিওরক্যাশ এবং টেলিটক টেলিপে-এর মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টরা আছেন। মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টরা টেলিটক নেটওয়ার্কের ওপর ভিত্তি করে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করেন। কারণ এখানে কেবল টেলিটক ইন্টারনেট এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়।
যেসব জেলেদের তিন থেকে পাঁচটি নিজস্ব মাছ ধরার ট্রলার রয়েছে, তাদের বলা হয় মহাজন। আর যাদের ট্রলারের সংখ্যা অনেক বেশি, তাদের বলে বহরদার। এসব বহরদার ও মহাজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত লইটা, তেলফ্যাসা, ছুরি, বৈরাগী, চাকা চিংড়ি, রূপচাঁদা মাছের শুঁটকি করা হয়। মাছ শুকাতে সময় লাগে তিন থেকে পাঁচ দিন। গড়ে ৫০০ টাকা কেজি দরে পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন তারা। ওই চর থেকেই পাইকাররা শুঁটকি কিনে নিয়ে যান।
তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গত বছর প্রায় ২৫০ কোটি টাকার শুঁটকি বিক্রি হয়েছে ওই চর থেকে, তার আগের বছর যা ছিল ২১০ কোটি টাকা। এ বছরও প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার মতো মাছ আহরণ করা হবে সেখান থেকে।
তবে চরটিতে কোনো আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় ঝুঁকিতে থাকেন জেলেসহ অন্যরা। ছয় মাসের জন্য চরটিতে অবস্থান করা মানুষ জটিল কোনো রোগ ব্যাধিতে ভুগলেও কোনো চিকিৎসা পান না। বছরের ওই ছয় মাসের জন্য এলাকাটিতে একটি ভাসমান হাসপাতাল রাখারও দাবি জানিয়ে আসছেন তারা।