নতুন বাংলাদেশ গড়ার রোলমডেল হতে পারে
৪ জুন ২০২৫ ১০:৫৩
॥ মো. তাসনীম আলম॥
২০০১ সালের কথা। একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে চারদলীয় জোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। তৎকালীন চারদলীয় জোটে ছিল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট এবং জাতীয় পার্টি (নাজিউর রহমান মঞ্জুর)।
চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় বিএনপি ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দল থেকে শুধু জামায়াতেরই দুজন মন্ত্রী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীসহ বাকি মন্ত্রীরা ছিলেন বিএনপির। অন্য দলের কাউকে রাখা হয়নি। জামায়াতের দুজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর একজনকে প্রথমে কৃষি মন্ত্রণালয় পরে শিল্প এবং অন্যজনকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।
জামায়াত সম্পর্কে একশ্রেণির মানুষের ধারণা ছিল, জামায়াত নেতারা মন্ত্রণালয়ের কী বুঝবেন? তারা তেমন সুবিধা করতে পারবেন না। কিন্তু জামায়াতের দুজন মন্ত্রী সরকার পরিচালনার এ দায়িত্বকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে দক্ষতা ও যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। জামায়াত সাংগঠনিকভাবেও এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হয়।
জামায়াতের দুজন মন্ত্রী শুরুতেই কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেন, যার ফলে ইতিবাচক ফল জাতি দেখেছে এবং পেয়েছে।
এক : জনশক্তিকে জানানো হয় যে, মন্ত্রী মহোদয় মন্ত্রণালয়ে জামায়াত নেতা ও কর্মীদের সাথে সাক্ষাৎ দেবেন না। সাক্ষাৎ চাইলে পার্টি অফিস অথবা বাসায় সাক্ষাৎ করতে হবে। এর ফলে মন্ত্রণালয়ে দলীয় কর্মীদের যে ভিড় লক্ষ করা যায়, তা বন্ধ হয়ে যায়। তদবির বাণিজ্যও কমে যায়। প্রাথমিকভাবে কর্মীদের মধ্যে কিছু প্রতিক্রিয়া হলেও পরবর্তীতে কর্মীরা আনন্দের সাথে তা মেনে নেন। মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে শুরু করে কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে কাজ করার সুযোগ পান। আমাদের দেশে আমলাদের ব্যাপারে যেমন নেতিবাচক কথা আছে, তেমনি দলীয় নেতা-কর্মীদের অন্যায় চাপ ও দাবির বিষয়টিও লক্ষণীয়। এ পথ ধরেই সুপারিশের নামে তদবির বাণিজ্যের পথ থেকে জামায়াত রক্ষা পায়। সরকারের অংশ হিসেবে জামায়াত নানাবিধ বৈধ কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেও বড় বিপদ থেকে রক্ষা পায়।
দুই : দুই মন্ত্রী দ্বিতীয় যে কাজটি করেন, তা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়। তারা ব্যাপকভাবে মন্ত্রণালয়ের কাজে সারা দেশে সফর করেন। মন্ত্রীদের সফর সাধারণত জেলা প্রশাসক ম্যানেজ করেন। মন্ত্রী, মন্ত্রীর সাথের সফরসঙ্গী ও দলীয় নেতা-কর্মীর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার জন্য সরকারি কোনো ফান্ড নেই। ফলে জেলা প্রশাসককে বিভিন্ন উপায়ে তা ম্যানেজ করতে হয়। এ ম্যানেজ প্রক্রিয়ায় ঢুকে পড়ে দুর্নীতি। সাধারণত ব্যবসায়ী, ঠিকাদার এদের সহযোগিতা নেয়া হয়। বিনিময়ে কী হয়, তা সচেতন সকলেরই জানা। জামায়াতের দুই মন্ত্রী অন্য মন্ত্রীদের চাইতেও বেশি সফর শুরু করেন। সফরে দুপুর পর্যন্ত তারা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাজ, মিটিং ইত্যাদি করেন। এর যাবতীয় খরচ মন্ত্রণালয় বহন করে। বাকি সময় বিকেলে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড; যেমনÑ কর্মী সমাবেশ, জনসভা, সুধী সমাবেশ ইত্যাদি কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে থাকেন। দুপুরে মন্ত্রী মহোদয়, মন্ত্রীর সফরসঙ্গী, স্থানীয় মেহমানবৃন্দ তাদের খাওয়া-দাওয়া ও মেহমানদারির সব দায়িত্ব জামায়াত বহন করে। স্থানীয় জামায়াত আনন্দের সাথে মন্ত্রী মহোদয় ও স্থানীয় মেহমানবৃন্দকে আপ্যায়ন করে। এর ফলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ম্যানেজ করার প্রয়োজন পড়ে না। এতে স্থানীয় জামায়াত নেতৃবৃন্দের সাথে প্রশাসন ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের একটি সুন্দর সম্পর্কও গড়ে ওঠে। দুর্নীতির পথও বন্ধ হয়। প্রশাসনও বিব্রতকর অবস্থা থেকে রেহাই পায়।
সফরে দুজন মন্ত্রী মাঠপর্যায়ে চলে যান। কৃষিমন্ত্রী শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেব ধানের ক্ষেতে নেমে কৃষকদের সাথে কথা বলেন। স্থানীয় কর্মকর্তাবৃন্দ খোলামেলাভাবে কথা বলারও সুযোগ পান। তার সফর সবার জন্য আনন্দময় হয়ে ওঠে। আমাদের দেশে কৃষি মন্ত্রণালয় এমনিতেই এক বড় ও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। তদুপরি মাওলানা নিজামী সাহেবের সংস্পর্শে এসে তা নবজীবন যেন ফিরে পায়। নিজামী সাহেব অত্যন্ত দূরদর্শী এবং মেধাবী মানুষ ছিলেন। তার চোখকে ফাঁকি দেয়া সহজ ছিল না। তিনি সময়মতো অফিসে যেতেন। ফলে অনেকেই বিব্রত অবস্থায় পড়ে যেত।
অপর মন্ত্রী শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ছিলেন দৃঢ় প্রকৃতির মানুষ। প্রচুর পরিশ্রম করতে অভ্যস্ত ছিলেন। তার সফরসঙ্গীরা তার সাথে চলতে হাঁফিয়ে উঠতেন। তিনিও ব্যাপকভাবে সফর করেন। ফলে অতীতে তার মন্ত্রণালয়ের তেমন কোনো সুনাম ও পরিচিতি না থাকলেও তার সংস্পর্শে মন্ত্রণালয় নতুনরূপে আবির্ভূত হয়। জেলাগুলোয় সফরে গেলে তিনি প্রথমেই শিশু সদনের রান্নাঘরে চলে যেতেন। শিশুদের বিছানাগুলো চেক করতেন। কোনো অনিয়ম দেখতে পেলে অ্যাকশন নিতেন। এরপর এসে মিটিংয়ে বসতেন। বিকেলে নিজামী সাহেবের মতোই সাংগঠনিক প্রোগ্রামে অংশ নিতেন।
সুন্দরভাবে দেশ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন সততা ও দক্ষতা- শহীদ মতিউর রহমান নিজামী এবং শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এ দুই গুণে গুণান্বিত ছিলেন। ফলে দীর্ঘ পাঁচ বছর সফলভাবে মন্ত্রণালয় পরিচালনা করলেও দুই টাকার দুর্নীতি করেননি। অথচ দুই মন্ত্রীরই সুযোগ ছিল প্রচুর অর্থ কামানোর। তাদের চরম শত্রুরাও তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনতে পারেনি।
শহীদ মতিউর রহমান নিজামী ও শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ সরকার পরিচালনার রোলমডেল হতে পারেন। বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে প্রয়োজন নিজামী ও মুজাহিদ সাহেবের মতো মন্ত্রী ও যোগ্য এমপির। জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, তা বাস্তবায়ন করতে হলে নিজামী-মুজাহিদদের বড় প্রয়োজন ছিল। স্বৈরাচার-ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকার নিজামী, মুজাহিদসহ জামায়াত নেতৃবৃন্দকে ফাঁসি দিয়ে এবং জেলখানায় হত্যা করে জাতির সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে। আমরা শহীদ নিজামী-মুজাহিদকে আর পাব না, কিন্তু তাদের সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর লাখকোটি কর্মী ও সমর্থক ইনসাফভিত্তিক দেশ গড়ার কাজ করছে। জামায়াত শহীদ নিজামী ও শহীদ মুজাহিদের মতো সাহসী আল্লাহভীরু, যোগ্য নেতা তৈরি করেছেন। এখনো তৈরি করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে, ইনশাআল্লাহ। এভাবেই একটি ইনসাফভিত্তিক মানবিক বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।
তাই আজকে প্রয়োজন শহীদ মতিউর রহমান নিজামী ও শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের কর্ম ও জীবন নিয়ে সর্বস্তরে আলোচনা। দেশের মানুষের কল্যাণে তারা কীভাবে কাজ করেছেন, তা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। যারা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যাদের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন হয়েছে।