জাতীয় সনদ দ্রুত করে গণভোটে যাওয়া সময়ের দাবি
২৯ মে ২০২৫ ১০:৩৭
॥ একেএম রফিকুন্নবী ॥
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর দেশের সার্বিক অবস্থা সংস্কারের জন্য বিভিন্ন কমিশন করা হয়েছিল। প্রায় সব সংস্কার কমিশনের কাজ শেষ পর্যায়ে। আলী রীয়াজ সাহেব তার সংস্কার প্রস্তাবের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়েছেন। দেশের অন্য স্টেকহোল্ডারদের সাথেও মতামত নিয়ে দ্রুত সংস্কার সনদ তৈরি করে গণভোটের মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের পথে দ্রুত এগোতে হবে।
স্বৈরাচারের দোসররা বসে নেই। তারা বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার কথা বলে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। দেশের ভেতর ও বাইরের স্বার্থান্বেষীরা তাদের প্রভুদের মদদ এবং অর্থ সাহায্যে ‘মব’ সৃষ্টি করছে। দেশকে অস্থিতিশীল করে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবীদের ঐক্য নষ্ট এবং তারা শেখ হাসিনার বিচারকার্য ব্যাহত করার পাঁয়তারা করছে।
দেশ আমাদের সবার। আমাদেরই দেশের স্বার্থে সবাইকে দেশের উন্নয়নের কাজে সহযোগিতা করতে হবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের সুচিন্তিত পরামর্শ সবার মত নিয়ে প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা এ কমিশনের কাজের অগ্রগতি কামনা করি। দল-মতের ভিন্নতা কিছু থাকলেও কমন মতের বিষয় জাতীয়ভাবে স্বীকৃতির জন্য গণভোট একান্ত জরুরি। ৫৪ বছর দেশ চালিয়েছে যার যার মতো দলীয় কায়দায়। দলের লাভ হয়েছে, দলীয় লোকদের লাভ হয়েছে। আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। দেশের টাকা, ব্যাংকের টাকা নিজের মনে করে ব্যাংক খালি করেছে। টাকা দেশে না খাটিয়ে বিদেশে পাচার করেছে। এখন শেখ হাসিনাসহ লুটেরা অনেকেই দেশছাড়া। অনেকে জেলে বিচারের অপেক্ষায়। ইতোমধ্যেই ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার দোসরসহ তাদের বিচার শুরু হয়েছে। ফলে তাদের দোসররা দেশে ও বিদেশে ষড়যন্ত্র করে বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করছে। যখন-তখন সড়ক বন্ধ করে দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নামছে। দেশের লোকদের যাতায়াতের অসুবিধা হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে অপেক্ষা করতে হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেই অনুকূল নয়।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পক্ষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ ষড়যন্ত্র রুখতে হবে। বর্তমানের ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারকে সুযোগ দিতে হবে। সংস্কার ও বিচারের কাজ এগিয়ে নিয়ে ভালো একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে যাতে দ্রুত এ সরকার বিদায় নিতে পারে।
আমরা এ সময়ে কোনো ভেদাভেদ চাই না। কমন বিষয়ে একমত হয়ে নির্বাচনের দিকে যাওয়ার পথ আমরা প্রশস্ত করতে চাই। ইতোমধ্যেই সরকার বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ডান-বাম প্রায় সব দলের সাথে বৈঠক করে মতবিনিময় করেছে। সবাই মুহাম্মদ ইউনূস সাহেবের প্রতি আস্থা রেখে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে। গুজব ছড়ানোর লোকের অভাব নেই। বিশেষ করে পতিত ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষণে ক্ষণেই গুজব আবিষ্কার করছে। হাসিনা এসে গেল, ইউনূস সাহেব পালিয়ে গেল, আরো কত কি? সবই ভুয়া। পালানো পতিত ফ্যাসিস্ট হাসিনার এদেশে ফিরে আসার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। হয়তো বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি কার্যকরের জন্য তাকে এদেশে আনা হতে পারে। শেখ হাসিনা একাই নয়, তার সময়ের সব প্রেতাত্মা সামরিক, পুলিশ, আমলা, ব্যবসায়ী সবার বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সবাইকেই বিচারের আওতায় এনে ফাঁসি দেয়া হবে।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের শহীদ ও আহতরা এখনো কাতরাচ্ছে। তাদের ক্ষত-বিক্ষত পরিণতি সামনে রেখে কেউ ছাড়া পাবে না। এবার দেশের ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে ফ্যাসিস্টদের বিচার করেই নির্বাচনে যাবে এবং একটি দেশদরদি সরকার গঠনের ব্যবস্থা করবে। মহান আল্লাহর সাহায্য আসবে, ইনশাআল্লাহ।
ড. ইউনূস সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে হাসিনা ও তার দোসররা ফায়দা হাসিলের উদ্যোগ নিয়েছিল। মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে সময়মতো দেশের বিভিন্ন দলের নেতারা সরকারের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে হাসিনা ও তার দলের লোকদের আশা ভেঙে গেছে।
জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান সময়মতো দেশের সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সব দলের বৈঠক করার উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ কাজে লেগেছে। অভিযোগ আছে একটি বড় দলের কয়েকজন নেতা আওয়ামী লীগের টাকা খেয়ে ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু তা মাঠেমারা গেছে। আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল ছাড়া বিএনপি-জামায়াতসহ দেশের সব দল, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে এবং তার কাজের সাথে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে। আমরা এ উদ্যোগের প্রশংসা করছি এবং দেশের মানুষের ভালোর জন্য নেয়া সব কাজের সহযোগিতা করতে চাই।
আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, চীন, ইইউসহ সারা দুনিয়ার লোকেরা আমাদের সাথে আছে। মুহাম্মদ ইউনূস ৮৫ বছরের যুবক, যাকে সারা দুনিয়ার মানুষ চেনে কর্মঠ মানুষ হিসেবে। আমরা তার জন্য দোয়া করব এবং তাকে লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য সহযোগিতার হাত প্রসারিত করব।
আবার বলতে চাই, স্বৈরাচার হাসিনা ও তার এ দেশীয় দোসররা এবং ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদীরা কোনোভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা মেনে নেয়নি, আবার সুখে-শান্তিতে আমাদের বাস করতেও দেবে না। আমরা ১৮ কোটি দেশদরদি মানুষ আমাদের স্বাধীন দেশের আশা-আকাক্সক্ষায় আমরা কারো কাছে মাথানত করব না। আমাদের চিন্তা আমরাই করতে চাই। কারো প্রভুত্ব আমরা চাই না। ছাত্র-জনতা যেভাবে ২০২৪-এ ৫ আগস্ট ঘটিয়েছে, সেভাবেই এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বজায় রখার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর আমরা দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলে মহান আল্লাহর সাহায্য আসবেই, ইনশাআল্লাহ।
আবার বলতে চাই, বর্তমান সরকারের কাছে সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন ছাড়া কোনো দাবি-দাওয়ার জন্য মাঠে নামা যাবে না। আমরা হাসিনা সরকারের ১৬ বছরে দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নামিনি। বরং কিছু লোক দালাল সেজে হাসিনাকে স্বৈরাচার হওয়ার জন্য সহযোগিতা করেছে। বিচার বিভাগ বিচারের নামে মিথ্যা সাক্ষীর প্রভাবে দেশের প্রখ্যাত আলেম-ওলামাকে জেল-জরিমানা দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর প্রখ্যাত আলেম মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসি দিয়েছে। ফাঁসি দিয়েছে জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে, জনপ্রিয় নেতা আবদুল কাদের মোল্লা, মীর কাসেম আলী ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকেও তারা ফাঁসি দিয়েছে। জেলখানাতেই জামায়াত নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমকে মৃত্যুর কোলে ঢেলে দিয়েছে, আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে জেলের মধ্যে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢেলে দিয়েছে। ফলে শেখ হাসিনাও দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। ইউনিয়ন থেকে শুরু করে আওয়ামী এমপি, মন্ত্রী, আমলা সবাই এলাকাছাড়া। এখনো বিভিন্ন বিভাগে আওয়ামী দোসররা ঘাপটি মেরে বসে কলকাঠি নাড়াচ্ছে। তাদের খোঁজ নিয়ে প্রশাসনকে আওয়ামী ও ভারতের দালালমুক্ত করতে হবে। ৫৪ বছর তারা দেশটাকে সামনে এগোতে দেয়নি। এবারের ছাত্র-জনতার বিপ্লব দেশের মানুষকে সাহসী করেছে। আমরা যে পারি, তার প্রমাণ দিয়েছি। এ সাহস অব্যাহত রাখতে হবে। প্রয়োজনীয় গাইডলাইন অনুসারে সামনে ভূমিকা রাখতে হবে। কোনোভাবে এ বিপ্লব ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না। আমরা ঐক্যবদ্ধ ও আল্লাহর প্রতি ঈমান মজবুত থাকলে আমাদের বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।
দাবি-দাওয়ার নামে কোনোভাবেই মানুষের চলার পথ বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। একদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যেমন শক্ত হতে হবে; অন্যদিকে আমরা সাধারণ মানুষও এদের কুচক্রের চক্রান্ত রুখে দিতে হবে। দাবি-দাওয়া থাকতেই পারে। গত ১৬ বছর আমরা সহ্য করেছি। আর কিছুদিন সহ্য করতে হবে। নির্বাচিত সরকার এলেই আমাদের দাবি-দাওয়া পেশ করতে পারব। তারাও আমাদের দাবি-দাওয়া সমাধান করতে এগিয়ে আসবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবের ওপর গণভোট এবং স্থানীয় প্রশাসনের পালিয়ে যাওয়া জনপ্রতিনিধিদের খালি জায়গায় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা আশু প্রয়োজন। সরকরি কর্মকর্তারা স্থানীয় প্রশাসন চালাতে অপারগ। তাই স্থানীয় প্রশাসনের নির্বাচন স্থানীয়ভাবে করতে বেগ পেতে হবে না। ছোট ছোট জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োগ করে এ নির্বাচন করা সম্ভব হবে। সাথে সাথে এ কথাও বলতে চাই, বর্তমানে দলের কিছু কিছু নেতা, পাতিনেতা আওয়ামী কায়দায় চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত। জনগণ এ চাঁদাবাজদের চেনে। স্থানীয়ভাবে নির্বাচন হলে এ চাঁদাবাজরা ধরা খেয়ে যাবে। ভালো, সৎ, যোগ্য চাঁদাবাজমুক্ত লোকেরা নির্বাচিত হয়ে আসবে সে যে দলেরই হোক।
যারা ভালো লোকের শাসন চায় না, তারাই স্থানীয় নির্বাচনের বিরোধিতা করতে পারে। সব বাধা ডিঙ্গিয়েই স্থানীয় নির্বাচন দ্রুত দিতে হবে। নির্বাচন কমিশনও তাদের লোকদের পরীক্ষা নিতে পারবে। এ পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হতে পারবে তাদের দিয়েই জাতীয় নির্বাচন করা সম্ভব হবে। নির্বাচন কমিশনের প্রতি জোর আবেদন, দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে একটি ভালো নির্বাচনের প্রস্তুতি নিন। গত তিনটি ভুয়া নির্বাচন হওয়ার কারণে তাদের বিচার হবে। আপনারা ভালো নির্বাচন দিয়ে প্রমাণ করুনÑ আমরা ভালো কাজ করতে পারি। কারো প্রতি না ঝুঁকে সঠিক পথে চলে, বাংলাদেশে একটি নজির স্থাপন করেন- আমরাও ভালো নির্বাচন দিতে পারি। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের লোকেরা সততার মাধ্যমে এ কাজ করতে পারবেন বলে আমি আসা করতে পারি।
বিএনপি বড় দল। তাদের নেতা শহীদ জিয়া, বেগম জিয়া এদেশের মানুষের মনমানসিকতা বুঝে রাজনীতি করেছেন। ডান, বাম, ইসলামী, নন-ইসলামী সবার সাথে মিলেমিশে ভারতের তাঁবেদারি না করে দেশ চালাতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বর্তমানে কিছু নেতা ভারতের দালাল সেজে আওয়ামী লীগের টাকা পকেটে নিয়ে মাঝে মাঝে হুঙ্কার দেন, যা বিএনপির রাজনীতির সাথে মানায় না। গয়েশ্বর বাবুরা রাস্তায় নামার হুঙ্কার দেন, সালাহউদ্দিন সাহেব ড. ইউনূসের বিকল্প খোঁজেন।
একটি রাজনৈতিক দলের একজন সিনিয়র নেতা দুদু ভাই মুতে দেয়ার অসংলগ্ন কথা বলেন, রিজভী সাহেব বাম রাজনীতি থেকে এসে ‘র’য়ের ভাষায় কথা বলেন, যা এদেশের মানুষ আর খাবে না। পারলে শহীদ জিয়ার রাজনীতিতে ফিরে আসেন, জনগণের ভাষা বুঝে রাজনীতি করেন। দেশের একমাত্র ভরসারস্থল সেনাবাহিনীকে বিপথে নেয়ার চেষ্টা চলছে। আমরা আশা করি, সেনাবাহিনী কারো ফাঁদে পা দেবে না। যেমন জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে দেয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভেবেচিন্তেই অগ্রসর হচ্ছেন। ডানে-বাঁয়ে সব জায়গায় হাত না দিয়ে সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের দিকেই বেশি নজর দেয়ার অনুরোধ করব। কোনো দেশের দালালি করে বা আওয়ামী দোসরদের ফাঁদে পা দেয়া যাবে না। দেশ আমার-আপনার। দেশের কল্যাণই আমাদের কল্যাণ। আমরা দেশের উন্নতি-অগ্রগতির দিকেই এগিয়ে যাব, ইনশাআল্লাহ।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।