এটিএম আজহার মুক্ত
২৯ মে ২০২৫ ০৯:৫৪
স্টাফ রিপোর্টার: জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলে তাকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। গত মঙ্গলবার (২৭ মে) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। গত বুধবার (২৮ মে) সকাল ৯টা ৫ মিনিটে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিরত অবস্থায় কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। আজহারুল ইসলামের মুক্তির আগে তাকে বেকসুর খালাস দিয়ে আপিল বিভাগের রায়ের কপি ২৭ মে বিকালেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পৌঁছে। তারা অনুলিপি পাওয়ার পরপরই কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। রাতেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে (কেরানীগঞ্জ) এসে রায়ের কপি পৌঁছায় বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। সেখানে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শেষে কারা কর্তৃপক্ষ আজহারুল ইসলামের মুক্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। ঢাকা বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন্স) মো. জাহাঙ্গীর কবির তার মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, সকাল ৯টা ৫ মিনিটে হাসপাতাল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় আজহারুল ইসলামকে।
এর আগে গত ৮ মে মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে এটিএম আজহারুল ইসলামের আপিলের ওপর শুনানি শেষ হয়। ওইদিন শুনানি শেষে রায়ের জন্য ২৭ মে দিন ধার্য করেন আদালত। তারই ধারাবাহিকতায় রায় ঘোষণা করা হয় গত ২৭ মে মঙ্গলবার। ২০১২ সালের ২২ আগস্ট মগবাজারের বাসা থেকে আজহারুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। তখন থেকেই তিনি কারাগারে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি আপিল করেন আজহার। শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। পরে রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করেন এ জামায়াত নেতা। ২০২০ সালের ১৫ মার্চ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর তা পুনর্বিবেচনা চেয়ে ওই বছরের ১৯ জুলাই আপিল বিভাগে আবেদন করেন আজহারুল ইসলাম। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ রিভিউ শুনে ফের আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত দেন। এটাই প্রথম মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা, যেটি রিভিউ পর্যায়ে আসার পর ফের আপিল শুনানির অনুমতি পায়।
আদালতে জামায়াত নেতা আজহারের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। তাকে সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট রায়হান উদ্দিন ও ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন। তার আগে গত ৬ মে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলের প্রথম দিনের শুনানি শেষ হয়। পরবর্তী শুনানির জন্য ৮ মে দিন ধার্য করেন আপিল বিভাগ। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার ২০১২ সালের ২২ আগস্ট রাজধানীর মগবাজারের বাসা থেকে আজহারকে গ্রেফতার করেছিল। তখন থেকেই তিনি কারাগারে ছিলেন।
আজহারের রায়ে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ
গত মঙ্গলবার (২৭ মে) প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার সময় প্রধান বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘এ মামলায় ফৌজদারি আইনের মৌলিক নীতিগুলো না মেনে ‘গ্রস মিসক্যারেজ অব জাস্টিস’ হয়েছে। আপিল বিভাগের পূর্ববর্তী জাজমেন্টে ফৌজদারি মামলায় সাক্ষ্য-প্রমাণের যথাযথ স্ট্যান্ডার্ড মানতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এ মামলার দণ্ড ও রায় বহাল থাকতে পারে না।’
আপিল বিভাগের চার পর্যবেক্ষণ
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে বেকসুর খালাস দিয়ে চারটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বিভাগ। আদালত বলেছেন, দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, যেসব তথ্য-প্রমাণ হাজির করা হয়েছিলো আগের আপিল বিভাগ তা সঠিকভাবে পর্যালোচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে এটিএম আজহারুল ইসলামকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। আজহারের ফাঁসির রায় ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে বিচারের নামে অবিচার। মঙ্গলবার সকালে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ এ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। বেঞ্চের অন্য ছয়জন হলেন- বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি ইমদাদুল হক, বিচারপতি মো. আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। শিশির মনির আপিল বিভাগের চার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। এক. এ উপমহাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার পদ্ধতি ও রীতিনীতি পাল্টে দেয়া হয়েছিলো। দুই. সাক্ষ্য-প্রমাণ এ্যাসেসমেন্ট ছাড়াই আজহারুল ইসলামকে ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছিল। তিন. নজিরবিহীনভাবে বিচারের নামে অবিচার করা হয়েছিলো। চার. দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, যেসব তথ্য-প্রমাণ হাজির করা হয়েছিলো আগের আপিল বিভাগ তা সঠিকভাবে পর্যালোচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে এটিএম আজহারুল ইসলামকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে।
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের প্রতিক্রিয়া
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, নির্দোষ প্রমাণ হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছেন জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম। এ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির কৃতিত্ব জুলাই গণআন্দোলনের অকুতোভয় নেতৃত্বের। গত ২৭ মে মঙ্গলবার দুপুরের দিকে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে আসিফ নজরুল এসব কথা বলেন।
এ পোস্টে তিনি বলেন, নির্দোষ প্রমাণ হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছেন জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম। দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে তার করা রিভিউ সর্বসম্মতিতে মঞ্জুর করেছেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় এবং মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে এর আগে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে আজকের রায়ে। আসিফ নজরুল বলেন, ‘এ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টির কৃতিত্ব জুলাই গণআন্দোলনের অকুতোভয় নেতৃত্বের। এ সুযোগকে রক্ষা করার দায়িত্ব এখন আমাদের সবার।’
আমীরে জামায়াতের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এটিএম আজহারের রায়ে সুবিচার হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ থেকে তাঁকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে। এ মামলাগুলো পরিচালনা করতে গিয়ে সীমাহীন জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তাঁর বইয়ে এটা স্বীকার করেছেন, কীভাবে বিচার বিভাগ ও সরকার মিলে বিচার করা হয়, এবং ঠাণ্ডামাথায় খুন করার ছক আঁকা হয়। একটি পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, যেন কেউ প্রতিবাদ করতে না পারেন।’ জামায়াত আমীর আরও বলেন, একেকটা রায়ের পর পরিবারের সদস্যদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। এতে পরিবারগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।
শফিকুর রহমান বলেন, “এ মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে ‘ইন্টারন্যাশনাল কাস্টমারি ল’ কিংবা ‘ডমেস্টিক কাস্টমারি ল’ অনুসরণ করা হয়নি। সেদিন সংবিধান বা আইন কোনো বিষয় ছিল না। যাঁদের ইশারায় কোর্ট পরিচালনা হতো, তাঁদের ইচ্ছাই এখানে মুখ্য ছিল। সেটি বৈধ হোক কিংবা অবৈধ। জামায়াত আমীর বলেন, ব্রিটেনের উচ্চ আদালত তাঁদের রায়ে বলেছেন, এ মামলাগুলো ছিল বিচারের নামে ‘জেনোসাইড অব দ্য জাস্টিস’। বিচারকে গণহত্যা করা হয়েছে। তাঁরা ‘কিলিং অব দ্য জাস্টিস’ বলেননি। কারণ সিঙ্গেল কেস হলে কিলিং বলতেন। এখানে ছিল একাধিক কেস। বাংলাদেশের আদালত আজ তাঁদের রায়ে বলেছেন, ‘মিসক্যারেজ অব দ্য জাস্টিস’। এটা নেতৃত্ব গণহত্যা ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দলকে নেতৃত্বশূন্য করা। তবে জামায়াত প্রতিশোধ নেয়নি, ন্যায়বিচার চেয়েছে।”
বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ এটিএম আজহারুল ইসলাম
বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সময় মিথ্যা ও সাজানো মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে ছিলেন ১৩ বছর। তিনি গত ২৭ মে মঙ্গলবার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বেকসুর খালাস পেয়েছেন। এটিএম আজহারুল ইসলামের পুরো নাম আবু তোরাব মোহাম্মদ আজহারুল ইসলাম। বাবার নাম ডা. নাজির হোসেন আহমেদ। এটিএম আজহারুল ইসলাম রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার বাতাসিওন গ্রামে ১৯৫২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইতিহাসে এমএ পাস করেন। ছাত্রজীবন শেষে তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন। তিনি সবসময় ইসলামী আন্দোলনের জন্য নিবেদিত থাকতেন। তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা মহানগর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি ও আমীর ছিলেন। এরপর জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় লিখতে পড়তে এবং কথা বলতে পারেন।
এটিএম আজহার বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন। তিনি দৈনিক সংগ্রামের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি একাধারে মারুফ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, রংপুরের আল-আমিন ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান, তা’মীরুল মিল্লাত ট্রাস্টের সদস্য, বদরগঞ্জ উন্নয়ন সমিতির চেয়ারম্যান, বদরগঞ্জ ইসলামী পাঠাগার ও সমাজকল্যাণ সমিতির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
‘আমাদের আজহার ভাই এখন মুক্ত বাতাসে’
অবশেষে মুক্তি পেলেন জামায়াতে ইসলামীর নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম। গত বুধবার (২৮ মে) সকাল ৯টা ৫ মিনিটে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিরত অবস্থায় কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। এ সময় সকালে তাকে দেখতে শাহবাগ ও বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে ভিড় করেন জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা। মুক্তি পাওয়ার পর হাসপাতালের ই-ব্লকে তাকে ফুলেল সংবর্ধনা দেন জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমানসহ দলটির শীর্ষনেতারা।
হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মুতাসিম বিল্লাহ সাহেদী। তিনি বলেন, লাখো ভাইয়ের রক্ত, ঘাম আর বহুমুখী ত্যাগের বিনিময়ে আজহার ভাই মুক্তি পেয়েছেন। আমাদের আজহার ভাই এখন মুক্ত বাতাসে।