খোশনদপুর থেকে সন্তোষ
১৫ মে ২০২৫ ১৬:০১
॥ অধ্যাপক আশরাফ জামান ॥
বাংলাদেশের টাঙ্গাইল একটি উল্লেখযোগ্য জেলা। এখানে রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা। বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে তার ছোট-বড় অনেক নিদর্শন। টাঙ্গাইল শহর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দক্ষিণ ও পশ্চিমে রয়েছে ঐতিহাসিক কাগমারী ও সন্তোষ এলাকা। আজ যা পৌরসভার অন্তর্গত দুটি ওয়ার্ড মাত্র। অথচ এর পেছনে আছে এক ঐতিহাসিক রক্তাক্ত ঘটনা, যা শুধু বিস্ময়ের উদ্রেক করে।
আজকের যে সন্তোষ, তার নাম ছিল খোশনদপুর। দিল্লিতে বাদশাহ আওরঙ্গজেবের অভিষেক অনুষ্ঠান হয় ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে। অনুষ্ঠানে দাওয়াত পান ভারতের বিভিন্ন এলাকার জ্ঞানী-গুণী, পণ্ডিতসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ। এর মধ্যে ছিলেন রাজন্যবর্গ, সুসাহিত্যিক, শিল্পী, আলেম-দরবেশ অনেকেই। এ অনুষ্ঠানে দাওয়াত পান সুদূর কাশ্মীরের এক বিখ্যাত কামেল হযরত শাহজামান (রহ.)।
হযরত শাহজামান জৌলুসপূর্ণ অভিষেক অনুষ্ঠানে আনন্দ-উল্লাসের জন্য যাননি, গিয়েছিলেন দীনি আন্দোলনের ব্যাপারে সহযোগিতার মনোবাসনা বুকে নিয়ে। কারণ তিনি জানতেন বাদশাহ আলমগীর একজন আধ্যাত্মিক জ্ঞানী, আল্লাহর ওলি। তিনি ডেকেছেন নিশ্চয়ই এর মধ্যে দীন প্রচারের ব্যাপারে একটা বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত হবে।
ইমামুর রব্বানী শায়েখ আহমদ মোজাদ্দেদ আলফেসানী (রহ.) পরিকল্পিত ও তারই সুযোগ্য আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী খাজা মাসুম (রহ.) পরিচালিত মিশনারীর প্রস্তুতি নিতেই জমায়েত হয়েছিলেন অভিষেক অনুষ্ঠানে।
বঙ্গীয় এলাকার রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করে পরিষদবর্গ দেখলেন মোমেনশাহী এলাকায় কিছু জায়গা সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় থেকেই দেখাশুনার লোক নেই। এলাকাগুলোর জন্য রিইনফোর্সমেন্ট হিসেবে অন্তত একজনকে পাঠানো প্রয়োজন। এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। টাঙ্গাইল শহরের দক্ষিণ সংলগ্ন আটিয়া পরগনা এবং মধুপুর গড়ের বিস্তৃত এলাকা রসুলপুর পরগনা এ দুটির মাঝে খানে কাগমারী পরগনা। এখানে একজন প্রশাসক প্রয়োজন।
বাদশাহ আওরঙ্গজেব স্বয়ং হযরত পীর শাহজামান কাশ্মিরীকে (রহ.) এ এলাকার প্রশাসক নির্বাচন করলেন। মিশনারি কাজের ব্যয়ভার বহন করার জন্য তামার পাতায় লিখে দিলেন ওয়াকফ দানপত্র। বাদশাহ বাইশটি গ্রাম এতে ওয়াকফ করে দিলেন। এ বাইশটি গ্রামের একটি হলো খোশনদপুর।
॥ দুই॥
হযরত পীর শাহজামান কাশ্মিরী (রহ.) সুদূর দিল্লি থেকে চলে এলেন মোমেনশাহী জেলার টাঙ্গাইলের এক প্রত্যন্ত এলাকা কাগমারী পরগনায়। তিনি এসেই পার্শ্ববর্তী আটিয়া, রসুলপুর ও কেল্লা আতা (কালিহাতী) পরগনার তৎকালীন ইসলামী মিশনারি কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোপগ স্থাপন করলেন। তাদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে চারটি পরগনার মাঝখানে যেহেতু খোশনদপুর অবস্থিত, তাই এখানে কেন্দ্রস্থল হিসেবে ইসলাম প্রচার মিশনের কেন্দ্রীয় অফিস স্থাপন করলেনÑ যাতে করে সকলে একত্রে মিলিত হয়ে মিশনারি কাজের ব্যাপারে পরামর্শ বা বৈঠক ইত্যাদি করা যায়।
অল্পদিনের মধ্যে এলাকার লোকজন হযরতের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এলো। ওয়াকফের আয় থেকে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করলেন মসজিদ, মাদরাসা, মুসাফিরখানা, দাতব্য চিকিৎসালয়, পশু হাসপাতাল ইত্যাদি। কোনো কোনো দরিদ্র এলাকায় অস্থায়ীভাবে লঙ্গরখানাও প্রতিষ্ঠা করলেন।
হযরত শাহজামানের খানকায় হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষে ফার্সি, আরবী, সাহিত্য ও ধর্মশিক্ষা গ্রহণের জন্য আসতে লাগলো। মুসলিম ছেলেমেয়ে ও বয়স্ক লোকদের জন্য কুরআন ও হাদীস শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তুললেন পীর সাহেব।
খোশনদপুরের উত্তরে বাটলা গ্রামের এক এতিম কিশোরকে পেলেন পীর সাহেব শিষ্য হিসেবে। সে এসে শিক্ষা ও সাহচর্য লাভের জন্য এলো। তাকে দীক্ষা দিতে লাগলেন পীর সাহেব। তাকে পালক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করলেন। চিরকুমার পীর সাহেবের স্ত্রী-সন্তান ছিল না। একসময় ইসলাম ধর্মের প্রতি মুগ্ধ হয়ে ছেলেটি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। পূর্বে নাম ছিল ইন্দ্রনারায়ণ, ইসলাম কবুল করার পর তার নাম হলো শাহ এনায়েতউল্লাহ চৌধুরী।
এনায়েতউল্লাহর জন্মস্থান বলে পরিচিত বাটনা গ্রামের নাম রাখা হয় এনায়েতপুর।
এনায়েতউল্লাহ হলেন পীর শাহজামান (রহ.)-এর সুযোগ্য উত্তরসূরি। তাকে শেখানো হলো আরবী-ফার্সি ভাষা এবং ইসলামের শরিয়ত ও মারেফতের জ্ঞান। পুত্রস্নেহে লালন করেন পীর সাহেব। ধীরে ধীরে তাকে গড়ে তুললেন আধ্যাত্মিক ও জাগতিক সকল শিক্ষায়।
পীর সাহেবের বয়স হয়ে গেছে, কখন চলে যান মহান আল্লাহ তায়ালার আহ্বানে তাই এনায়েতউল্লাহকে মিশনের যোগ্য করে গড়ে তুললেন।
একদিন হযরত শাহজামান সম্রাট আওরঙ্গজেবের সাথে সাক্ষাৎ ও দোয়া-আশীর্বাদের উদ্দেশে পুত্রকে দিল্লি নিয়ে যান। জিন্দাপীর বাদশাহ আলমগীর খুব খুশি হন। তিনি সমগ্র কাগমারী পরগনাকে ওয়াকফ স্টেটের অন্তর্ভুক্ত করে এ ব্যাপারে মুর্শিদ কুলি খানকে সরাসরি নির্দেশ দান করেন।
মুর্শিদ কুলি খানের সঙ্গে হযরত শাহজামানের পূর্ব পরিচয় ছিল। তিনি মুর্শিদাবাদের নবাব পরিবারে এনায়েতউল্লাহকে বিবাহ করান। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে কাগমারী পরগনার প্রতিষ্ঠাতা হযরত শাহজামান (রহ.) এত আয়োজন, এত প্রস্তুতি গ্রহণ করার পর ১৭১৮ সালে ৯১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। এ সময় মাত্র ৩২ বছর বয়সে মিশনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শাহ এনায়েতেউল্লাহ চৌধুরী।
বিদায়কালে এনায়েতউল্লাহকে কাছে ডেকে মিশনের সকল দায়িত্বভার প্রদান করেন হযরত শাহজামান (রহ.)। হাত উঠিয়ে দোয়া করেন আল্লাহর দরবারে। আল্লাহ তোমাকে কর্তব্য পালনে সাহায্য করবেন।
॥ তিন॥
হযরত শাহজামান কাশ্মিরীর যোগ্য শিষ্য হয়ে উঠেছিলেন শাহ এনায়েতউল্লাহ চৌধুরী। কাগমারী পরগনার মিশনের কাজ অত্যন্ত কামিয়াবীর সঙ্গে এগিয়ে চলছিল। শাহজামানের অর্থানুকূল্যে এলাকার বিভিন্ন স্থানে ২২টি প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, পাঠাগার, দাতব্য চিকিৎসালয়, পশু হাসপাতাল, লঙ্গরখানা প্রভৃতির কাজ পুরো গতিতে চলছিল। দলে দলে নিম্নবর্ণের হিন্দু নারী-পুরুষ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিচ্ছিল। জনকল্যাণমূলক, সেবামূলক, শিক্ষা ও গবেষণায় হিন্দু-মুসলমান সমভাবে অংশ নিতে পারতো। এভাবে মিশনের সাফল্য তখন মধ্য গগনে।
এনায়েতেউল্লাহর আপন চাচা ব্রজমোহন চৌধুরীকে নিয়েছিলেন বৈষয়িক কাজ হিসাব-নিকাশ ও আয়-ব্যয়ের ব্যাপার দেখাশুনার জন্য ওয়াকফ স্টেটের নায়েব হিসেবে। তিনি ইসলাম গ্রহণ না করে নিজ ধর্মই পালন করতেন। এ ব্যাপারে কোনো অসুবিধা হতো না বা এনায়েতউল্লাহ কিছু মনে করতেন না।
কিছুদিন পর এনায়েতউল্লাহ পবিত্র হজব্রত পালন করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। ভাবলেন মহান আল্লাহর ঘর কাবা ও রাসূলের রওজা মোবারক যাওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। আল্লাহ তায়ালা তাকে যে পবিত্র দায়িত্ব দিয়েছেন তার জন্য শুকরিয়া জ্ঞাপন করবেন।
সেখকালে পবিত্র হজ পালন করতে অনেক সময় লেগে যেতো। কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো নদী বা সমুদ্রপথে নৌকা ও জাহাজে করে যেতে হতো। অর্থাৎ পবিত্র হজ পালন করতে এবং বাড়ি ফিরতে দু-তিন বছর সময় চলে যেত।
শাহ এনায়েতউল্লাহ (রহ.) হজে যাত্রাকালে এস্টেটের দেখাশুনার সার্বিক দায়িত্ব দিয়ে গেলেন তার চাচা ব্রজমোহন চৌধুরীকে। স্ত্রী ও একমাত্র শিশুপুত্র সন্তানকে রেখে গেলেন চাচার জিম্মায় খোশনদপুরে।
চাচা ব্রজমোহন ভাতিজার সব দায়িত্ব খুশি হয়ে গ্রহণ করলেন। পৈতা ছুঁয়ে শপথ করেন ও ধর্মগ্রন্থ গীতা স্পর্শ করে ওয়াদা করেন জীবনের বিনিময়ে হলেও ভাতিজার দেয়া সকল দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন।
কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। বাংলার এক নিভৃত গ্রাম খোশনদপুরে ঘটে গেল ইতিহাসের আরেক পলাশীর ঘটনা।
শাহ এনায়েতউল্লাহ চৌধুরী (রহ.) হজ সমাপন করে দেশের মাটিতে ফিরতে প্রায় তিন বছর চলে গেল। ইতোমধ্যে একের পর এক কূট ষড়যন্ত্রে খোশনদপুরে অনেক কিছু ঘটে গেল। খলনায়ক চাচা ব্রজমোহন স্বরূপে আবির্ভূত হলেন। ভাতিজাকে হত্যা করার জন্য গুপ্তঘাতক পাঠালেন। ঘাতকরা অনেকদিন থেকে তাকে অনুসরণ করছিল। হজ থেকে ফেরার পথে এনায়েতউল্লাহকে হত্যা করা হবে। যশোরের কোনো এক স্থানে দুজন ঘাতক নিরস্ত্র অবস্থায় এনায়েতউল্লাহকে নির্মমভাবে শহীদ করল। ঘটনাটি ঘটে ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে। বাংলার নবাব সিরাজ-উদদৌলা হত্যার ১৮ বছর পূর্বে।
॥ চার॥
রাজা রাজবল্লভ উমিচাঁদের আরেক পূর্বসূরী ব্রজমোহন এভাবে এনায়েতউল্লাহকে নির্মমভাবে হত্যা করে খোশনদপুরে প্রচার করলো ভাতিজাকে দস্যুরা হত্যা করেছে। মায়াকান্নাও জুড়ে দিল সে ও তার পরিবারবর্গ। এলাকার সাধারণ মানুষ জানতে পারলো না এর সত্য ঘটনা আর নায়েবের দ্বারা সংঘটিত পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের কাহিনী।
এখানেই শেষ নয়, এনায়েতউল্লাহর একমাত্র নাবালক শিশুপুত্রকে কৌশলে ঘাতক দিয়ে গোপনে হত্যা করল। প্রচার করে দিল এনায়েতউল্লাহর ছেলে কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। কতবড় নিষ্ঠুর হলে এ জাতীয় কাজ করতে পারে?
এনায়েতউল্লাহ চৌধুরীর স্ত্রী সন্তান হারিয়ে বিশ্বস্ত এক ভৃত্যের মাধ্যমে রাতের আঁধারে জীবনটুকু নিয়ে পালিয়ে যান।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকালে ১৭৩৯-৪০ এর সময়ে খোদ মুর্শিদাবাদে নবাবী নিয়ে মারামারি, কাটাকাটি চলছিল। তবে ব্রজমোহনকে এনায়েতউল্লাহ হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার করে মুর্শিদাবাদ নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস কারাধ্যক্ষ বিশ্বেশ্বর রায় কারসাজি করে ব্রজমোহনকে ছেড়ে দয়। বিনিময়ে খোশনদপুর এসে দুজন মিলে সেখানকার নগদ অর্থ-সম্পদ লুটপাট করে নেয়। এভাবে বাদশাহ আলমগীরের তামার পাতায় প্রদান করা ওয়াকফ সম্পত্তি আধ্যাত্মিক গুরু হযরত শাহজামান কাশ্মিরী (রহ.) ও তার প্রিয় পুত্র এনায়েতউল্লাহ চৌধুরী (রহ.) পরিচালিত মিশনের ইসলামী কাজ বন্ধ করে তা খলনায়ক ব্রজমোহনের কারসাজিতে পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত হয়। তারা পালাক্রমে পরিবারের বংশ পরম্পরায় ভোগদখল করে ১৯০ বছর। কখনো জমিদার, কখনো রাজা এবং মহারাজা উপাধি গ্রহণ করে পরে সম্পত্তি ভোগদখল করে বিলাসবহুল জীবন কাটায়। খোশনদপুরের নাম পরিবর্তন করে সংস্কৃত প্রতিশব্দে রাখে সন্তোষ।
অতীব দুঃখের ব্যাপার এই যে, সন্তোষের তথাকথিত রাজারা টাঙ্গাইল শহরে বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিল তাদের লোকজনদের নামে। কোথাও হযরত শাহজামান ও এনায়েতউল্লাহ চৌধুরীর নামে কিছু নেই। পীর শাহজামান শুয়ে আছেন নিভৃত কাগমারী কলেজের সামনে অবস্থিত মাজারে।
॥ পাঁচ॥
ফার্সি শব্দ ‘কাগ’ অর্থ কলম এবং মারী অর্থ কেন্দ্র যার নাম কাগমারী। যে নাম পীরে কামেল হযরত শাহজামান (রহ.)-এর দেয়া। মূলত কাগমারী সে সময় হয়ে ওঠে জ্ঞান চর্চাকেন্দ্র। ছোটবড় নারী-পুরুষ সকল মানুষের মধ্যে আরবী-ফার্সি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, ব্যাকরণ, ধর্ম ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান শিক্ষাদান করা হতো। পীর সাহেব তার ভাবশিষ্য এনায়েতউল্লাহকে যোগ্যতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলেছিলেন।
কাগমারী পরগনার জন্য দানকৃত বাদশাহ আলমগীরের দেয়া ওয়াকফ সম্পত্তি- যা ইসলাম প্রচারের ও প্রসারের জন্য দেয়া হয়েছিল, তা একসময় হিন্দু রাজাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হলো। প্রায় দুইশত বছর পর মজলুম জননেতা আধ্যাত্মিক পীর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৩৬-এ ব্যাপারটি অবগত হন। তারপর দীর্ঘদিন সন্তোষের দখলদার জমিদারদের সঙ্গে এ সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের জন্য আইনি প্রচেষ্টা চালান। ১৯৪৬ সালে এ সম্পত্তিগুলো উদ্ধার হয়।
১৯৭৩ সাল থেকে মওলানা ভাসানী হযরত শাহজামানের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নাম দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। সেখানে প্রাথমিক স্কুল, কুরআন হেফজখানা, এতিমখানা, সুচিকিৎসা, বালক-বালিকা স্কুল, উচ্চমাধ্যমিক কলেজ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করেন। এগুলোয় হযরত শাহজামানের ইসলামী মিশনের কর্মসূচি চালু রাখার চেষ্টা করেন।
জবরদখলকারী রাজা বা জমিদারগণ তাদের আপনজনদের নামে টাঙ্গাইল শহরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন যেগুলোর নাম রানী দীনমনি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সন্তোষ জাহ্নবী হাইস্কুল, বিন্দুবাসিনী বালক ও বালিকা হাইস্কুল উল্লেখযোগ্য।
টাঙ্গাইল শহরে এই নাম নিয়ে আজ অবধি মাথা উঁচু করে প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে আছে। দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন হলেও এর নাম পাকিস্তান আমলের ২৩ বছর ও বাংলাদেশ আমলের সময়গুলোয় পরিবর্তনের চিন্তা কেউ করেনি।
পরম দুর্ভাগ্যের ব্যাপার এই যে, মওলানা ভাসানী সন্তোষে ছোট-খাটো দু-একটি প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছিলেন হযরত শাহজামান পশু হাসপাতাল, এনায়েতউল্লাহ এতিমখানা ও ছাত্রাবাস ইত্যাদি।
টাঙ্গাইল শহর থেকে সন্তোষ পর্যন্ত প্রায় তিন-চার কিলোমিটার রাস্তাঘাটে কোথাও তাদের নাম পরিচয় নেই। দুঃখের ব্যাপার হলো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধীরে ধীরে তাদের নাম ভুলে যাবে। তারা জানবে না সন্তোষের রক্তাক্ত ইতিহাস।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় টেকনিক্যাল কলেজ, সন্তোষ, টাঙ্গাইল।