আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

মানবতাবিরোধী অপরাধের হুকুমদাতা শেখ হাসিনা

স্টাফ রিপোর্টার
১৫ মে ২০২৫ ১৪:৫২

স্টাফ রিপোর্টার : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় নিরস্ত্র, নিরীহ আন্দোলনকারীদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করতে রাষ্ট্রীয় সব বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসের শুরুতে দেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী সব অপরাধের প্রধান মাস্টারমাইন্ড (পরিকল্পনাকারী), হুকুমদাতা ও সুপিরিয়র কমান্ডার (সর্বোচ্চ নির্দেশদাতা) ছিলেন তিনি।
গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। তদন্ত প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার পাশাপাশি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (আইজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকেও আসামি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’সহ (শীর্ষ নেতৃত্বের দায়) বেশকিছু অভিযোগ আনা হয়েছে। এ মামলার তদন্তে সময় লেগেছে ৬ মাস ২৮ দিন।
ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের কাছে গত ১২ মে সোমবার সকালে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক (প্রধান) আনসার উদ্দিন খান পাঠান।
নিয়ম অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা প্রথমে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর চিফ প্রসিকিউটর সেই তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেন এবং আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আকারে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করেন।
তদন্ত প্রতিবেদন জমা হওয়ার বিষয়ে গত ১২ মে সোমবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে দাখিল করা তথ্য-প্রমাণাদি, আলামত সবকিছু বিশ্লেষণ করার পর যদি মনে হয় যথেষ্ট প্রমাণাদি পাওয়া গেছে, তাহলে সেসবের ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) ট্রাইব্যুনাল বরাবর দাখিল করবেন। ফরমাল চার্জ গঠনের পর আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে। ফরমাল চার্জ দাখিল করতে দুই থেকে তিন সপ্তাহ লাগতে পারে।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, গণঅভ্যুত্থানের সময় দেশব্যাপী সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, গুলি করে আহত করা, লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার মতো অমানবিক কর্মকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রধান মাস্টারমাইন্ড, হুকুমদাতা ও সুপিরিয়র কমান্ডার শেখ হাসিনা। গত জুলাই ও আগস্টে যত মানুষ শহীদ হয়েছেন, যত মানুষ আহত হয়েছেন, প্রতিটি ঘটনায় তার (শেখ হাসিনা) জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
তাজুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন কল রেকর্ড, অসংখ্য ভিডিও ফুটেজ, অডিও ক্লিপ, আহতদের শরীর থেকে উদ্ধার হওয়া গুলি, যেসব হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলোর ফ্লাইট শিডিউল (উড্ডয়ন-অবতরণ সূচি), হেলিকপ্টার থেকে ব্যবহার করা অস্ত্র, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে যুক্ত করেছে তদন্ত সংস্থা। আহতদের সাক্ষ্য, গ্রেফতার হওয়া আসামিদের স্বীকারোক্তি তদন্ত প্রতিবেদনে রয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় গণহত্যা নয়, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, এখানে যা হয়েছে, তা আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যা নয়।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে এখন পর্যন্ত দুটি মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হলো। প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয় গত ২১ এপ্রিল। গণঅভ্যুত্থানের সময় ঢাকার চানখাঁরপুল এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আটজনকে আসামি করে সেই প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। প্রসিকিউশনের (রাষ্ট্রপক্ষ) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের জন্য ২৫ মে সময় নির্ধারণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ১২ মে সোমবার দ্বিতীয় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হলো। এ মামলা ছিল পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে হওয়া প্রথম মামলা। এর আগে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় তিনবার বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ গত ২০ এপ্রিল এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় বাড়িয়ে আগামী ২৪ জুন নির্ধারণ করা হয়। অবশ্য এর আগেই প্রতিবেদন জমা দিল তদন্ত সংস্থা।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এ মামলা ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগ শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অপর মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। এর মধ্যে শাপলা চত্বরের মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ছিল গত ১২ মে। প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় আরও তিন মাস বাড়িয়ে আগামী ১২ আগস্ট সময় নির্ধারণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। আর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গুম-খুনের মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় নির্ধারিত আছে আগামী ২৪ জুন।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগ
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি অভিযোগের বিষয় সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা হয়।
প্রথম অভিযোগের বিষয়ে বলা হয়, শেখ হাসিনা গত বছরের ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’, ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ ও ‘রাজাকার’- এসব বলে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে উসকানি ও প্ররোচনা দিয়েছিলেন। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থাসহ রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর পাশাপাশি সহযোগী বাহিনী হিসেবে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ। হত্যা করে, আহত করে এবং অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে জড়িত হয়ে যায় তারা।
দ্বিতীয় অভিযোগ প্রসঙ্গে বলা হয়, হেলিকপ্টার, ড্রোন, এপিসিসহ মারণাস্ত্র ব্যবহার করে নিরস্ত্র, নিরীহ আন্দোলনকারীদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন বা নির্মূল করতে রাষ্ট্রীয় সব বাহিনীকে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তদন্ত সংস্থার জব্দ করা শেখ হাসিনার অনেকগুলো টেলিফোন কথাবার্তায় এসব বিষয় উঠে এসেছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বাকি তিনটি অভিযোগ বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আনা হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
দায় চাপাতে সরকারি স্থাপনায় আগুন দেওয়ার নির্দেশ
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় প্রায় দেড় হাজার মানুষকে হত্যা এবং ২৫ হাজারের বেশি মানুষকে গুলি করে আহত করা হয়েছে। সহিংসতা চালানো হয়েছে নারীদের ওপর। টার্গেট করে শিশুদের হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পর লাশ ও জীবিত মানুষ একসঙ্গে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে নিতে বাধা দেওয়া হয়েছে আহতদের। শহীদদের লাশ ময়নাতদন্ত করতেও বাধা দেওয়া হয়েছে।
চিকিৎসকদের চিকিৎসা দিতে বাধা দেওয়ার বিষয়টিও তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেন, হাসপাতালে শেখ হাসিনা গিয়ে চিকিৎসকদের বলেছিলেন, রোগীদের যেন চিকিৎসা না দেওয়া হয়। অনেক রোগী যন্ত্রণা সহ্য না করতে পেরে যখন হাসপাতাল ছাড়তে চেয়েছিলেন, তাদের চলে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি।
তদন্ত প্রতিবেদনে তদন্ত সংস্থা উল্লেখ করেছে, আন্দোলনকারীদের ওপর অপরাধের দায় চাপানোর জন্য বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় নিজেদের (আওয়ামী লীগ সরকার) লোকদের আগুন দিতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তার টেলিফোন নির্দেশ তদন্ত সংস্থার কাছে রয়েছে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
ট্রাইব্যুনালে ১৩ আসামি
২০১৩ সালে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরসহ সারা দেশে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের হত্যা-নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৯ আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার গত ১২ মে শুনানি হয়েছে ট্রাইব্যুনালের। আসামিদের মধ্যে পাঁচজন পলাতক। তারা হলেনÑ শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার, পুলিশের সাবেক আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার ও বেনজীর আহমেদ।
এ মামলায় গত ১২ মে সোমবার গ্রেফতার দেখানো হয়েছে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক, সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান ও পুলিশের সাবেক উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোল্যা নজরুল ইসলাম। তারা অন্য মামলায় গ্রেফতার ছিলেন। সোমবার তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
এছাড়া গণঅভ্যুত্থানের সময় উত্তরায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের এক মামলায় ঢাকা উত্তর সিটির সাবেক মেয়র মো. আতিকুল ইসলামসহ ৯ জন আসামিকে গত ১২ মে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এ মামলার মোট ১০ জন আসামি। এর মধ্যে ৯ জন গ্রেফতার আছেন।
আতিকুল ছাড়া এ মামলার বাকিরা হলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক সহকারী কমিশনার জাবেদ ইকবাল, উত্তরা পূর্ব থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুজিবুর রহমান, কনস্টেবল হোসেন আলী, উত্তরা পশ্চিম থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মনোয়ার ইসলাম চৌধুরী, উত্তরা পূর্ব থানা আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক শাহিনুর মিয়া, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন, উত্তরা-৬ নম্বর সেক্টর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. বশির উদ্দিন ও ঢাকা মহানগর উত্তরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের যুবলীগের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন।
এ মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ২০ জুলাই সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। এ আদেশ দেন বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্ব গঠিত ট্রাইব্যুনাল। এ ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। দুজনের মধ্যে বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ গত ১২ মে সোমবার অনুপস্থিত ছিলেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেকটি মামলার আসামি সাবেক মন্ত্রী লে: কর্নেল (অব:) ফারুক খানের জামিন আবেদনের ওপর গত ১২ মে সোমবার ট্রাইব্যুনালে শুনানি হয়। পরে ট্রাইব্যুনাল বলেন, কারা কর্তৃপক্ষ তার শারীরিক অবস্থার বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখুক। কারা কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদন পাওয়ার পর জামিনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।