আমাদের একজন মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ছিলেন
৮ মে ২০২৫ ১৪:৩৬
॥ নূরুন্নাহার নীরু ॥
২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল রাত ১০.৩০ মিনিট। আমাদের প্রিয়জন মুহাম্মদ কামারুজ্জামান নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার স্মরণীয় দিন। তার এ চলে যাওয়া স্বাভাবিক নয়। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাহী আদেশে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশে ভিত্তিহীন অভিযোগে তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে আধিপত্যবাদী শক্তির দোসর আওয়ামী লীগ।
তিনি ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। তিনি ছিলেন একজন সাংবাদিক। কারাবন্দি হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি সাপ্তাহিক সোনার বাংলার সম্পাদক হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। আমার সাথে পরিচয় ৮০’র দশকে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। তখন থেকেই আমার লেখালেখি শুরু। দৈনিক সংগ্রাম, সাপ্তাহিক সোনার বাংলায় নিয়মিত লিখতাম।
একপর্যায়ে ওনার পরিবারের সাথেও পরিচিত হলাম। অবশেষে পড়ালেখা শেষে আমার বিয়ের পরে জানলাম, আমি তাঁদেরই এলাকার বৌ! সেভাবেই হৃদ্যতা আরো বেড়ে যায়। পারিবারিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হয়। আমার স্বামীর কাছ থেকে তাঁর মেধা ও প্রজ্ঞার গুণগান শুনেছি প্রচুর। ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর পরিমিত, পরিপাটি এবং সরল-সহজ জীবনযাপন যে কাউকে মুগ্ধ করত। তার তীক্ষè মেধার প্রভায় প্রভাবিত হতেন যে কেউ। পরিচিতি বাড়ার সাথে সাথে তিনি হয়ে ওঠেন আমাদের প্রিয় ভাই, কামারুজ্জামান ভাই।
তার শাহাদাতবরণ করার রাতেরÑ স্মৃতি আজও আমার কাছে জ্বল জ্বলে। আমি তখন চাকরি করি। দিন শেষে কর্মস্থল থেকে ফিরে বিষণ্নচিত্তে প্রহর গুনছিলাম। টিভিসেটের সামনেই সারাক্ষণ। কী হয়! কী হয়! প্রতীক্ষার প্রতিটা ক্ষণ ছিল আমার জন্য খুবই উদ্বিগ্ন আর হতাশার। সময়টা খুবই মর্মযাতনার। যেহেতু আমার স্বামীও তখন বাসায় নেই। তার আগেই তিনি মুহাজির হিসেবে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন। জালিমশাহীর অত্যাচারে, মিথ্যা অজুহাতে রুজি-রোজগার থেকে বঞ্চিত করে যাঁর ওপর চলছিল অন্যায় নিষ্পেষণÑ তাঁকে তখন বাধ্য হয়েই স্থানান্তরিত হতে হয়েছিল।
ছেলেমেয়েরাও কাছে নেই। যার যার মতো হল-হোস্টেলে অবস্থিত ওরা। বাসায় আমি প্রায় একাই। আমার সে সময়ের প্রতিটা মুহূর্ত ছিল খুবই অস্থিরতা ও বেদনার। সারা দিন চাকরিসহ দুনিয়াবী দায়িত্ব পালন, আর রাতে এসে পরম করুণাময় বিশ্বজাহানের স্রষ্টার সান্নিধ্য কামনা। এভাবেই চলছিল সময়ক্ষেপণ। এর মধ্যে পরপর চলছিল ফাঁসির বর্বরতা। একের পর এক বিদায় নিচ্ছিল দুনিয়া থেকে আমাদের প্রিয় ব্যক্তিত্বরা। এমন অবস্থায় কারো সাথে মন খুলে কথা বলারও কোনো সুযোগ ছিল না। তার ওপর ভয় ও আশঙ্কা তো ছিলই! বলা যায় সেই থেকেই এতদিন পরে হলেও সে রাত্রের কথা তুলে ধরতে চাচ্ছি, যা পারিনি ফ্যাসিবাদের রক্তচক্ষুর ভয়ে। তবে এখন না বললে যেন ইতিহাসের অংশবিশেষ অন্তরালে থেকে যাবে।
সেই রাত্রিতে যখন জামান ভাইয়ের শহীদি লাশের অ্যাম্বুলেন্স শেরপুরের দিকে পাড়ি জমিয়েছিল, তখন তা টেলিভিশনের মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছিলাম। অ্যাম্বুলেন্সটি এগোচ্ছে তো এগোচ্ছে। ঢাকার সীমানা ছাড়িয়ে যখন প্রায় ময়মনসিংহের চৌকাঠে, তখনি যেন হঠাৎ আল্লাহর আকাশ বৈরী হয়ে উঠলো। আল্লাহর কি হুকুম আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতে থাকল, বজ্রপাতে বজ্রপাতে আকাশ বিদীর্ণ হতে চলছিল। চারদিক কেমন থমথমে নিস্তব্ধ-নিঃসাড় অবস্থা। অন্য কোনো সাড়াশব্দ, হইচই নেই। হৃদয়তন্ত্রিতে একটা করুণ অনুভূতি কষ্টের সুরে বাজছিল শুধু। অথচ আকাশ যেন ভেঙে পড়ছে প্রচণ্ড হুংকারে।
অ্যাম্বুলেন্সটি যতই শেরপুরের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে, ততই যেন আকাশ বিদীর্ণ চিৎকারে ফেটে পড়তে চাচ্ছিল। জমিন ভিজে একাকার হচ্ছিল আকাশের ক্রন্দন। এ এক অবাক কাণ্ড প্রকৃতির সাথে সেদিনের সেই বাস্তবতার সম্মিলন কোনো মানুষের পক্ষেই তৈরি করা নয়। এ যেন স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে একটা নজির বিশেষ। কবির ভাষায় হয়তো বলা যাবে প্রকৃতি ও কাঁদছিল তার বিদায়ে। আমি টেনশনে ঘুমাতে পারছিলাম না। কারণ শুনেছি; আজ ওরা জামান ভাইয়ের লাশকে অপমানিত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আল্লাহ তুমিই হেফাজতকারী। ভাবতে ভাবতে টিভি খোলা রেখেই সেই রাতে আকাশ ও পৃথিবীর সন্ধিযুক্ত দৃশ্য অবলোকন করছিলাম বিষণ্ন হৃদয়ে।
লাশের গাড়ি যখন শেরপুরের কাছাকাছি চলে আসে; ইতোমধ্যে শেরপুরবাসীর একটা অংশের কিছু কুটিল জীব যারা সবসময়ই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করে থাকে। আমাদের দেশে এমন একটি দল সর্বদা সক্রিয়। এরা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে আজও আগবাড়িয়ে তাদের আবেগ ইচ্ছাকে চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ খোঁজে। এদের নিজস্ব কোনো অবলম্বন না থাকায় প্রধানত নৌকায় চড়েই এরা এদের স্বার্থসিদ্ধি করে থাকে। ঠিক সে রাতেও এমনই একটি অশুভ জীবাংশ আওয়ামী লীগের বিদ্বেষী ব্যক্তিদের সাথে হাত মিলিয়ে একটা দুরভিসন্ধিতে লিপ্ত হয়। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সেদিন কামারুজ্জামান ভাইয়ের আপন সম্বন্ধি অর্থাৎ স্ত্রীর বড় ভাই হীরু ভাই। তিনি ও তারা মিলে শহরে ঢোকার ফটকটিতে অবরোধ করে বসে ছিলেন সন্ধ্যা থেকেই; যাতে শহীদ জামান ভাইয়ের লাশের গাড়িটি প্রবেশ করতে না পারে। চক্রান্ত ছিল মোক্ষম কিছুর সুযোগ নেয়ার। বিদ্বেষভরা স্লোগানে মেতে ওঠে তাঁদের অপাঙক্তেয় গোষ্ঠীটি।
কিন্তু ওই যে বললাম, বৈরী আকাশ! আকাশ কেন বৈরী হয়ে উঠলো, কেন সেদিন তার এত হুংকার, এত প্রবল-প্রতাপ তাণ্ডব? পরে বুঝতে পেরেছি আকাশের সেই তাণ্ডব অর্থাৎ বজ্রপাত আর বজ্রধ্বনি দুরভিসন্ধিকারীদের ছাত্রভঙ্গ করে দেয়ার মোক্ষম অস্ত্র ছিল সে ক্ষণে। মহান আল্লাহর কৃপায় তারা নির্ধারিত সে স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ছত্রভঙ্গ হয়ে ভেঙে পড়ে তাদের দম্ভ, আক্রোশ, আস্ফালন। আল্লাহর বান্দাকে আল্লাহ স্বসম্মানে শহরে প্রবেশের সুযোগ করে দেন।
রাতদুপুরে লাশের গাড়ি শহরের ভেতর প্রবেশ করে যথারীতি এ রাস্তা, সে রাস্তা পেরিয়ে একেবারে যথাস্থানে এসে দাঁড়ায়। স্থানটি ছিল বাজিতখিলা নামক শহরতলির নামকরা একটি মাদরাসা প্রাঙ্গণ। মাদরাসাটি তাঁরই অভিভাবকত্বে গড়া। এতিম অসহায়-ছাত্রদের আবাসস্থল।
কিন্তু কী আশ্চর্য ছত্রভঙ্গ হয়নি জনতার মিছিল। পালিয়ে গা বাঁচায়নি শেরপুরের লক্ষ ভক্ত প্রাণ। উপরে আকাশের বৈরিতা আর নিচে জমিনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর প্রতিবন্ধকতাÑ কিছুই আঁটকাতে পারেনি লক্ষ প্রাণের মেলাকে। কী নারী, কী বৃদ্ধ, যুবা, বয়স্ক সবাই ছুটছে তো ছুটছে। গন্তব্য একটাই কামারুজ্জামানকে শেষ দেখা। মানুষ কতটা ভালোবাসতো তাঁকে সেদিনের সেই জলকাদায় একাকার হওয়া মানুষগুলোকে না দেখলে বোঝার উপায় ছিল না। পুলিশের ব্যারিকেডকে সম্মান জানিয়েই যে যেদিক থেকে এসেছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল জানাযার জন্য। অথচ মূল জানাযা হয়েছিল সীমিত কয়েকজনকে নিয়ে তড়িঘড়ি। পুলিশও অবাক হয়ে গিয়েছিল কাদা পানিতে, ক্ষেতে-ডোবায়, বন-বাদাড়ে দাঁড়িয়ে মানুষকে জানাযা পড়তে দেখে। জানা যায় বৃহত্তর ময়মনসিংহের জনগণ সেই রাত্রিতেই পুলিশের চোখরাঙানি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রচণ্ড বাধা ইত্যাদি উপেক্ষা করেই দলে দলে এসে সেই মাদরাসা প্রাঙ্গণে একত্রিত হয়েছিল।
দীর্ঘদিন শেরপুরে বসবাস করায় নিজ চক্ষে দেখা থেকে জানা ও বুঝতে পেরেছিলাম মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ভাই মানুষের হৃদয়ে কতটা আসন গেড়ে জীবন্ত ছিলেন। কারণ তিনি পরোপকারে সাধ্যাতীত কাজ করতেন। সে হোক হিন্দু, হোক মুসলিম। এ মানুষটাকেই নির্বাচনী খেলার প্যাঁচে ফেলে পরাজিত করে ফেলত ক্ষমতাসীন দল অন্যায় অসত্যের বেড়াজালে। অবশেষে এক সময় মিথ্যা মামলার অজুহাত দিয়ে অন্যায়ভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দুনিয়া থেকেই বিদায় করে দেয়। এ ফাঁসি ছিল মূলত একটা মেধার ফাঁসি।
শেরপুর জেলার এক আসনের এমপি আওয়ামী প্রার্থী আতিউর রহমান আতিক তথাকথিত নির্বাচিত এমপি। জঘন্য ষড়যন্ত্রপিয়াসী একটা মানুষ। দাম্ভিক, অহংকারী, ঔদ্ধ্যত। আজ কোথায়? কোথায় সেই দাপট? অবশ্য জুলাই বিপ্লবের পটপরিবর্তনের আগেই নিজের দলের লোকদের দ্বারাই ধরাশায়ী হয়েছেন তিনি। উবে গেছে তার অন্যায় আস্ফালন। এত ক্ষমতাও ভেঙে যেতে পারে? ভাবতে না ভাবতেই ৩৬ জুলাই প্রমাণ করে দিল তার নেত্রীর সিংহাসনসহ উবে যাওয়ার দৃশ্য। ওদিকে নকলা-নালিতাবাড়ী আসন থেকে একচেটিয়া বেগম মতিয়া চৌধুরী তো জেঁকেই বসেছিলেন। তবু তাদের কেন এত ভয়ছিল জামান ভাইকে নিয়ে! আগামীর তারকা কামারুজ্জামান না জানি ওদের ভীত নাড়িয়ে দেয়! নাড়াতে হয়নি, ধসিয়েই দিয়েছে মহান আল্লাহ স্বয়ং। আজ তারা কেউ রাজনীতির মাঠে নেই। মতিয়া চৌধুরীও বিদায় নিয়েছে রাজনীতি থেকে এবং এ পৃথিবী থেকে।
দুদিন পরে আমরা মহিলাদের একটা গ্রুপ সরেজমিন দেখার জন্য বাজিতখিলার সেই স্থানে উপস্থিত হই। কবর দেখি, মদরাসা ঘুরে দেখি। তখনো থমথমে পরিবেশ। ভীত চোখগুলো সবার আতঙ্কিত। আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখি তখনো লাশের কফিনে টকটকে লাল রক্ত জমে আছে। ভক্ত-ছাত্ররা সেই রক্তের ছাপ এঁকে রেখেছে দেয়ালে দেয়ালে। জীবন্ত কবরটি যেন মানুষকে কিছু বলছে, পথিককে কেঁদে কেঁদে জানাচ্ছে, এই মাটির বুকে শুয়ে আছেন যিনি, ইনি কোন চোর, ডাকাত, খুন, রাহাজানিতে ফাঁসিপ্রাপ্ত নন, শুধুই একজন নিরেট ধর্মপ্রাণ মুসলিম। যিনি শুধু ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেই নিয়োজিত করেছিলেন তার জীবন ও মেধাকে। আর কোনো চাওয়া পাওয়া ছিল না তাঁর। ছিল একটাই স্বপ্ন আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠিত হোক। কিন্তু ফ্যাসিবাদ স্বৈরাচাররা সেটা মেনে নিতে পারল না, তাদের আক্রোশ মেটাতে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে এ দুনিয়া থেকে চির বিদায় করে দিল তাঁকে।
এ বিদায়ই কি বিদায়? মহান আল্লাহ নিজেই বলেছেন, ‘শহীদদের মৃত বলো না’। ঠিক তাই কামারুজ্জামান মরেননি, বরং আছেন লাখো প্রাণের মণিকোঠায়। যে আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে ইতিহাস হয়ে গেছেন, আগামী প্রজন্ম উজ্জীবিত হয়ে উঠুক সেই আদর্শিক চেতনায়। আমরা আজও গর্ব করে বলি, আমাদের একজন নেতা ছিলেন। একজন সম্পাদক ছিলেন। আমাদের একজন মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ছিলেন।