উপরের হাত নিচের হাত থেকে উত্তম


১ মে ২০২৫ ১৭:৩৫

॥ একেএম রফিকুন্নবী ॥
আল্লাহর নবী মুহাম্মদ সা. বলেছেন, উপরের হাত নিচের হাত থেকে উত্তম। আমরা নিজেরা, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের সর্ব ক্ষেত্রে যদি এর আলোকে কাজ করতে পারি, তবে মানুষের নাই নাই ভাব কমে যাবে। মানুষকে দেয়ার কথা বার বার মনে আসবে। কারণ আমরা উত্তম জিনিস সবাই কামনা করি।
দুনিয়াব্যাপী আমেরিকা থেকে শুরু করে ছোট দেশ গিনি পর্যন্ত সবাই খালি চাই আর চাই। বিশেষ করে বড় দেশগুলো ছোট দেশগুলো থেকে লুটেপুটে তাদের সম্পদ কীভাবে নিজের দেশে নিয়ে যাওয়া যায়, তার দিকে খেয়াল করে।
ব্রিটিশরা ব্যবসা করার জন্য উপমহাদেশে আসে। পরে দেশ শাসনের ভার নিয়ে গিয়েছিল। প্রায় ১৯০ বছর পর ১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসন থেকে মুক্ত হয় এ পাক-ভারত-বাংলাদেশ এলাকা।
২৪ বছর পাকিস্তানের শাসন এবং বাংলাদেশের ৫৪ বছর শুধুই খাওয়া আর খাওয়ার গল্প। জনগণকে দেয়ার খবর আমরা পাই না, দুঃখজনক। দুনিয়ায় মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষ পাঠিয়েছেন আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে। সৃষ্টির সেরা জাতি হিসেবে। মানুষসহ দুনিয়ার অন্যান্য সৃষ্টিজগতের দেখভাল করার জন্য আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে নবী ও সেই এলাকার উপযোগী জীবনবিধান পাঠিয়েছিলেন। যারা নবী ও জীবন বিধানের অনুসারী হিসেবে চলেছে তারা দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ পেয়েছে। আর যারা নবী ও জীবনবিধানের বিরোধিতা করেছে, তারা দুনিয়াতেই শাস্তি পেয়েছে আবার আখিরাতে সীমাহীন জীবনে পাবেÑ শাস্তি আর শাস্তি। আমরা শেষ নবী মুহাম্মদ সা.-এর অনুসারী হিসেবে তাঁকে এবং তাঁর কাছে আসা আল-কুরআন মেনে চলব এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করে দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ পাওয়ার আশা রেখে আমাদের জীবন গড়ব।
আমাদের আলোচ্য বিষয় উপরের হাত নিচের হাত থেকে উত্তম। আমরা ব্যক্তি জীবনে চলার পথে সব ক্ষেত্রে এর বাস্তবায়ন করতে চাই। হাসিমুখে কথা বলা, ফকির-মিসকিনদের সহযোগিতা করা, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা, দেশ-জাতির কল্যাণে দিকনির্দেশনা দিয়েও আমরা ভালো কাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই। আল্লাহর নবী মুহাম্মদ সা.-এর কাছে একজন সাহায্য প্রার্থী সাহায্য চাইলে তিনি তাকে কিছু নগদ অনুদান দিয়ে বলেছিলেন, ‘অনুদানের অর্ধেক দিয়ে খাদ্য কিনবে আর বাকি অর্ধেক দিয়ে একটি কুঠার কিনে পাহাড়ে যাও, লাকড়ি আহরণ করে বাজারে বিক্রয় করে তোমার চলার পথ করবে।’ এই যে উপদেশ, তা হলো কাজ করে খাও। পরের কাছে হাত বাড়াবে না।
আমাদের দেশের বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা দেশে ও বিদেশে বক্তৃতা দেয়ার সময় আল্লাহর নবীর উপদেশকে সামনে রেখে বলে বেড়াচ্ছেন, তোমরা চাকরির পেছনে না ঘুরে উদ্যোক্তা হও। অর্থাৎ কাজ করে খাও। ব্যবসা কর, তা যত ছোটই হোক না কেন? প্রয়োজনে চায়ের দোকান দাও। পুকুরে মাছ চাষ কর, মুরগি-গরু-ছাগল পালন কর। আস্তে আস্তে বড় হবে। সদ্ভাবে জীবনযাপন কর। চাঁদাবাজি বা দখলবাজি নয়।
আমাদের একটি ব্যবসা সংগঠন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট অ্যান্ড বিজনেস ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন তাদের ঘোষণায় বলেছে, টাকা মাত্র দশ হাজার, খুলবে ব্যবসার দ্বার। গ্রাম-গঞ্জ-শহর-বন্দরে ছোট ছোট ব্যবসা করে মানুষকে পুরুষ-মহিলাসহ সবাইকে স্বাবলম্বী করার ব্যবস্থা করতে হবে। চাওয়ার হাত থেকে দেওয়ার হাত বাড়াতে হবে।
আপনারা জেনে খুশি হবেন যে, গত কয়েকদিন পূর্বে আমাদের প্রধান উপদেষ্টা কাতারে সফর করলেন। কাতারের কাছে দেনা ছিল এলএনজি কেনা বাবদ, সব দেনা-পাওনা দিয়ে দিয়েছেন। কাতারের সরকার বাংলাদেশ সরকারকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিয়েছেন। গত স্বৈরাচারী সরকার চোরতন্ত্রের মাধ্যমে দেশের টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করেছে আর অন্য দেশের পাওনা পরিশোধ করেনি। এ সরকারের আমলে একদিকে রিজার্ভ বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে। আবার আইএমএফের সাহায্য ছাড়াই দেনা পরিশোধের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। আলহামদুলিল্লাহ।
আমাদের দেশের প্রায় দুই কোটি বেকারের হাতকে উৎপাদনের কাজে লাগিয়ে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নিতে হবে। বেকারভাতা দিয়ে কর্মীর হাত অলস করা যাবে না, কর্মীর হাতে রূপান্তরিত করতে হবে। তারেক রহমানের বেকারভাতা দেয়ার ঘোষণাকে ৮৪ শতাংশ লোক বিরোধিতা করেছে। মিডিয়ায় প্রকাশ, মানুষ কাজ করে খেতে চায়Ñ ভাতা চায় না।
আমাদের দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত কর্মক্ষম মানুষ কাজ জানে। তাদের একটু গাইড করতে পারলে দেশে-বিদেশে কাজ করে তাদের জীবন ধন্য করতে পারবে।
আমার দেশে ও বিদেশে কর্মীদের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। একজন রিকশাওয়ালাও মফস্বল থেকে শহরে এসে রিকশা চালিয়ে তার সন্তানদের শিক্ষিত করার ব্যবস্থা করেছে। তারা সদ্ভাবে, গায়ের ঘাম ফেলে টাকা কামাই করে সংসার চালাচ্ছে, সন্তানের শিক্ষার ব্যবস্থা করছে। বিদেশে রাস্তা ঝাড়– দিয়ে, গাড়ি পরিষ্কার করে, মধ্যপ্রাচ্যে রোদের মধ্যে তপ্ত বালুর মধ্যে বিদ্যুতের লাইন বসিয়ে টাকা কামাই করছে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছে। আবার সারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে শিক্ষা বিভাগ, ইঞ্জিনিয়ার বিভাগ, বৈজ্ঞানিক কাজে যোগ দিয়েও বৈদেশিক মুদ্রা কামাই করছে। ভিক্ষা নয়, নিজ হাতে কাজ করে টাকা উপার্জনের ব্যবস্থা হয়েছে। তাই বলতে চাই, ভিক্ষার জাতি নয়, দান করার মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ হতে চাই। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা হাতে-কলমে মানুষ গড়ার ব্যবস্থা করতে পারলেও দেশে ও বিদেশে বৈধভাবে আয়ের বড় উৎস বানানো সম্ভব। আজাদ-কাশ্মীরের লোকদের সাথে আলাপ করে জেনেছি, তাদের বাজেটের সিংহভাগ আয় আসে বিদেশে কর্মরত কর্মকর্তাদের মাধ্যমে। আমরাও আল্লাহর নবীর কথা অনুযায়ী উপরের হাত অর্থাৎ দানের হাত প্রস্তুত করব, আর ভিক্ষার হাত বা নিচের হাত বর্জন করব।
গত আগস্ট বিপ্লবের পর দেশের মানুষ আসল স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করছে। রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে সব পেশার লোক হাঁফ ছেড়ে স্বাধীনভাবে নিশ^াস নিতে পারছে। এখনো বিগত স্বৈরশাসক হাসিনার দোসররা বিভিন্ন বিভাগে রং বদলিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছে। সরকারের সেক্রেটারি থেকে শুরু করে অফিসের পিয়ন পর্যন্ত ঘাপটি মেরে বসে আছে। স্বৈরশাসকের পুনর্গঠনের স্বপ্ন দেখছে, যা আদৌ বাস্তব নয়। ঘুষ, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি কিছু কমলেও জনগণ আশানুরূপ ফল পাচ্ছে না। রূপ বদলিয়ে পূর্বের চোরতন্ত্রের কুপ্রভাব সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা এর অবসান চাই। পরিবেশ ভালো হলেই মানুষ স্বাধীনতার ফল ভোগ করতে পারবে। জনগণের আয়ের উৎস ফলদায়ক হবে। উপরের হাত শক্তিশালী হবে। সমাজ ভালোর স্বাদ পেতে শুরু করবে। খাওয়া পার্টির দৌরাত্ম্য থেকে সমাজকে তুলে আনতে হবে। মানুষের আয়-রোজগারে সততা ও দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ পেয়ে আয় বাড়বে। দান-খয়রাতের হাত প্রসারিত করতে পারবে। আল্লাহর নবীর সবক উপরের হাত নিচের হাত থেকে উত্তম, প্রমাণ করার সুযোগ পাবে। আমরা সে পরিবেশের চেষ্টায় রইলাম।
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের ৯ মাস চলছে। দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি সবই ভেঙ্গে পড়েছিল। দীর্ঘদিনের এ অব্যবস্থাপনা গোটা জাতিকে ধ্বংসের কিনারায় পৌঁছে দিয়েছিল। ছিদ্রগুলো বন্ধের কাজ ইউনূস সরকার অনেকটাই করতে পেরেছে। ব্যাংক ডাকাতি, বিদেশে টাকা পাচার, ঘরে ঘরে চোরতন্ত্রের দোসরদের রাক্ষসী থাবা কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে এগিয়ে যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বকালের সর্বোচ্চ মানে পৌঁছাতে শুরু করেছে। ব্যক্তি ড. ইউনূসের দেশে-বিদেশে প্রভাব-প্রতিপত্তি চরিত্রের মাধুর্যের কারণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির প্রসার হচ্ছে। পাশের দেশের লোকেরাও বাংলাদেশের এ ভাবমূর্তি বাড়ায় ঈর্ষায় জ¦লছে। এ দেশকে তারা যে করদ রাজ্যের মতো ব্যবহার করেছে, তার ছেদ পড়েছে। সীমান্তে হত্যা বন্ধ না হলেও বাংলাদেশ চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে ভারতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। আমাদের বিমানবন্দরগুলো মালামাল বিদেশে রফতানি করতে শুরু করেছে। কয়েকদিন পূর্বে সিলেটে বিমানবন্দর থেকে ফ্রান্সে কার্গোবিমান উদ্বোধন করেছেন, বিমান উপদেষ্টা শেখ বশির। তিনি বলেছেন, কার্গো শিপমেন্টে ৩৭ ভাগ শুল্ক কমে শিপমেন্ট করা যাবে। ভালো উদ্যোগ। দেশের ব্যবসা বাড়লেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। মানুষের দানের হাত বাড়বে।
প্রধান উপদেষ্টা ইতোমধ্যেই বিদেশি মুদ্রা অর্জনকারীদের জন্য বিমানবন্দরে ভিআইপি মর্যাদা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এর প্রভাব বিদেশে কর্মরত লোকদের মধ্যে মর্যাদার ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। চোর-বাটপারদের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। স্বাধীনতার ফল ভোগ করতে পেরে মানুষ আশায় বুক বেঁধে দেশের কল্যাণে কাজ করার উৎসাহ পাচ্ছে।
একদল চাঁদাবাজি করে পূর্বের স্বৈরশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। নির্বাচন নির্বাচন করে পেরেশানিতে পড়েছে। দেশের মানুষ আগস্ট বিপ্লবে মানুষ হত্যার কুশীলবদের বিচার আগে চায়। আগস্ট বিপ্লবের স্লোগান এবং দেয়াল লিখনের ভাষার আলোকে দেশকে আগে রাহুমুক্ত করতে হবে। সংস্কারের মাধ্যমে দেশে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করেই সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
আগস্ট বিপ্লবের শহীদ ও আহতদের চাহিদা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করেই নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করে নির্বাচন দিতে হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় নির্বাচন আগে দিতে হবে। কারণ ছোট ছোট জায়গায় নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা সহজ হবে। নির্বাচন কমিশনেরও পরীক্ষা হয়ে যাবে। আমাদের বিশ^াস, নির্বাচন কমিশন সেভাবে এগোতে পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমরা সব জায়গায়ই ভালো পরিবেশ চাই। মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার সব রাস্তা খুলে দিতে চাই। প্রকৃত স্বাধীনতার সুবাতাস গ্রহণে উৎসাহ দিতে চাই। উপরের হাতকে শক্তিশালী করতে চাই। নিচের হাতকে দূরে ফেলে দিয়ে উপরের হাতকে উত্তম করার সম্ভাবনার সব দরজা খুলে দিতে চাই। দেশের ভালো চাই। মন্দ দূরীভূত করতে চাই। সবার সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়ানোর আহ্বান জানাতে চাই।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।