ইসলামে হালাল রুজি উপার্জনের তাগিদ
২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৯:১৬
॥ মনসুর আহমদ ॥
ইসলাম মানুষের জন্য অনন্য জীবনব্যবস্থা, আল্লাহ্র মনোনীত একমাত্র জীবনব্যবস্থা। আল্লাহ বলেছেন, ‘ইন্নাদ্দীনা ইনদাল্লাহিল ইসলাম-নিশ্চয়ই আল্লাহ্র মনোনীত একমাত্র ধর্ম ইসলাম।’ এ এমন এক জীবনব্যবস্থা, যা মানবজীবনে কোনো অর্থনৈতিক জটিলতা, সাংস্কৃৃতিক সংঘর্ষ, সমাজ, রাষ্ট্রে রাজনৈতিক স্বার্থ সংঘাত না ঘটে, তার পথনির্দেশনা প্রদান করে। মানুষের সত্তাকে সার্বিকভাবে আল্লাহ্র কাছে সোপর্দ করে তাঁর মনোনীত পথ অনুসরণ করে চলার এক নাম ইসলাম। ইসলামের পরিচয় দিতে আল্লাহর রাসূল ফরমান, ‘তুমি তোমার পরিপূর্ণ সত্তা আল্লাহ্র সমীপে সোপর্দ করে দাও, অন্যান্য উপাস্যকে পরিত্যাগ করো এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করো ও জাকাত আদায় করো’। এর নাম ইসলাম।
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ মঙ্গলময় ও শাশ^ত জীবনব্যবস্থার নাম। কালপরিক্রমায় এ দীনে কোনো ব্যাপারেই সংযোজন বা বিয়োজনের কোনো প্রয়োজন হবে না। আল্লাহর ঘোষণা, “আজ আমি তোমাদের দীন (জীবনব্যবস্থা) পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের ওপর আমার অনুগ্রহ পূর্ণত্বে পৌঁছে দিলাাম। আর এ ইসলামকেই তোমাদের জন্য একমাত্র ধর্ম হিসেবে মনোনিত করলাম।’ (সূরা আল-মায়েদা : ৩)। তবে জীবনপ্রবাহে সঙ্গতি স্থাপনে জীবন পদ্ধতি (দীন) অবলম্বনের ধারায় দীনের উৎস মূল থেকে নিঃসৃত যুগোপযোগী কানুন ইজতেহাদ ও ইজমার পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন নতুন পদ্ধতি অবলম্বনে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। হজরত যায়েদকে সিরিয়ানী ভাষা শিক্ষা গ্রহণের জন্য রাসূল সা.-এর উৎসাহ প্রদান তার একটি দৃষ্টান্ত। মানুষের প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করেই ইসলাম তার বিধান দিয়েছে। মানুষ জগতে আসে মুখ, পা, হাত প্রভৃতি নিয়ে। তাকে এ জগতে বেঁচে থাকতে তার খাদ্য অর্থ ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। তাই ইসলাম মানবজীবনের অর্থনৈতিক দিকটাকে কখনোই ছোট করে দেখে না। বরং কিছু মানুষই অর্থনৈতিক ব্যাপারে চিন্তার প্রান্তিক সীমায় অবস্থান করছে। কেউ সুখ-সম্ভোগে ডুবে থাকা, ধরণীর বুকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির ও বস্তুগত সাফল্যের অধিকারী হওয়াকেই জীবনের চরম লক্ষ্য বানিয়ে নিয়েছে। অবার কেউ আধ্যাত্মিক উন্নয়ন ও নির্বাণ লাভের পন্থা হিসেবে মানুষের জীবনে অর্থনীতির দিকটিকে উপেক্ষা করে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে জীবনটাকে নিপীড়নের জাঁতাকলে পিষ্ট করে থাকে, যা রাসূলের সুন্নাহ্র বিপরীত। হালাল উপার্জনে উৎসাহ জোগাতে রাসূল এরশাদ করেন, “সুতরাং আল্লাহ্কে ভয় কর ও রুজির তালাশে উত্তম পথ অবলম্বন কর। হালাল জীবিকা অর্জন করো এবং হারামের কাছেও যেও না। (ইবনে মাজাহ)।
মানবজীবনের জন্য ১. অপরিমিত অর্থ লিপ্সা, ২. অর্থনৈতিক দিক উপেক্ষা করা। এ দুটিই প্রান্তিক ধারণা। অপরিমিত অর্থলিপ্সা মানুষকে ভোগের দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে অনুপ্রেরণা জোগায়, যার ফলে সমাজে নেমে আসে জুলুম, নির্যাতন ইত্যাদি। অপরদিকে অর্থনৈতিক দিকটাকে উপেক্ষা করার ফলে সমাজে প্রগতি ও উন্নতির গতি মন্থর হয়ে আসে, ফলে মানবসভ্যতা ধীরে ধীরে ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়ায়। মানবতা ধ্বংসকারী প্রান্তিক চিন্তাধারা থেকে মানবতাকে মুক্তি দিতে এসেছে ইসলাম। ইসলামের অর্থনৈতিক চিন্তাধারা মানবতার কল্যাণের জন্য সঠিক পথ দেখায়।
রাসূলের বাণী, ‘আল্লাহকে ভয় কর এবং রুজির তালাশে উত্তম পথ অবলম্বন কর’ এর মাঝে রয়েছে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা অর্জনের পরিচ্ছন্ন নীতিনির্ধারক নির্দেশ। যেহেতু সব অর্থনীতিক উপাদনের মূল চাবিকাঠি আল্লাহর হাতে, তাই তাঁর নির্দেশিত পথ অবলম্বন করে অর্থনৈতিক উন্নতি লভের প্রচেষ্টাই মানবজীবনে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। যখন মানুষ আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করে, তখনই তার সামনে খুলে যায় অর্থনৈতিক কল্যাণ লাভের পথসমূহ। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘আর যদি জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং এবং তাকওয়া অবলম্বন করতো, তবে আমি তাদের প্রতি আসমানি ও পার্থিব নিয়ামতসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম।’ (সূরা আল -আরাফ : ৯৬)।
কুরআনের বিধান প্রতিষ্ঠার ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সমাজে নাজিল হয় বরকত ও অর্থনৈতিক প্রাচুর্য। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর তারা যদি ওরাত ইঞ্জিল এবং যা প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা পুরাপুরি পালন করতো, তবে তারা ওপর থেকে এবং পায়ের নিচ থেকে আহার্য লাভ করতো।’ (সূরা আল-মায়েদা : ৬৬)। মানবজীবনে অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের ধারা অলৌকিতার চেয়ে দীন প্রতিষ্ঠার বাস্তব ফল রূপে আসবে এটাই আল্লাহর নীতি। এ আয়াতগুলো দীন প্রতিষ্ঠার বাস্তব প্রতিফল হিসেবে জীবনকে প্রাচুর্যময় করার যেমন ইঙ্গিত প্রদান করে, তেমনি জীবনকে যথার্থ উপায়ে উপভোগের অনুপ্রেরণা প্রদান করে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ তোমাকে যা (সম্পদ) দান করেছেন তদ্বারা পরকালের আবাস অনুসন্ধান কর এবং ইহকাল থেকে তোমার অংশ ভুলে যেও না।’ (কাসাস : ৭৭)।
কুরআনের এসব আয়াত এবং রাসূলের হুকুম ‘জাকাত দাও’ এ সবের মধ্যে প্রচ্ছন্ন রয়েছে মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জনের একটি সদাজাগ্রত ইঙ্গিত। মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি কীভাবে আসবে। এ ব্যাপারে রাসূল সা. অনেক কথা বলেছেন। জীবিকার উদ্দেশ্যে প্রশস্ত জমিনে ছড়িয়ে পড়ার জন্য উপদেশ দিয়েছেন আল্লাহ্র রাসূল; তিনি ফরমান, ‘ওয়া সাফেরু তাসতাগনু এবং সফর কর তাহলে অন্যের কছে হাত পাততে হবে না।’ এত স্পষ্ট নির্দেশ থাকার পরও যারা জীবনে কর্মবিমুখ, সংসারবিমুখ হয়ে তথাকথিত জীবন পদ্ধতিকে মানবসমাজের জন্য মঙ্গলময় মনে করেন তারা জাহেলিয়াতের ভ্রান্ত ঘূর্ণিপাকে পড়ে মানবসভ্যতাকে ধ্বংসের আতল গহ্বরে ফেলতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ভ্রান্ত ‘তকদির বাদ’ নির্ভর চিন্তাধারা মুসলিম সমাজকে কর্মবিমুখতায় উৎসাহিত এবং দারিদ্র্যকে গৌরবের বিষয় মনে করতে শিখায়েছে, যা সুস্পষ্টভাবে ইসলামী বিধানের পরিপন্থী। এ ভ্রান্তির মূলে রয়েছে মুসলিম জাতীয় জীবনে কুরআন বর্জন করে বিভিন্ন জাহেলি দর্শন গ্রহণ এবং রাজনৈতিক জীবনে ভিন্ন জাতির গোলামি ও আদর্শ গ্রহণ। আল্লামা ইকবাল বলেছেন,
‘এ কুরআনের শিক্ষা দেখি আজ সংসার বৈরাগ্য
মুমিনকে করলো যে চন্দ্র ও সপ্তর্ষিম-লের প্রভু।
তকদীর মুখী আজ তাদের সমস্ত কাজের ধারা
যাদের সংকল্পে নিহিত ছিল তকদীর।
একদা মন্দ ছিল যা ধীরে ধীর তাই হলো ভালো।
কেননা দাসত্বে বদলে যায় জাতির বিবেক।’ (অনুবাদ- আব্দুল মান্নান তালিব)।
শুধুমাত্র তকদিরে নির্ভরতা নয় বরং জীবনে সচ্ছলতা অর্জনের জন্য পরিশ্রমকে উৎসাহিত করেছেন আল্লাহ্র রাসূল সা.। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ্ সেই মুসলমানকে ভালোবাসেন যে পরিশ্রম দ্বারা জীবিকা অর্জন করেন। (তারগীব)।
রাসূলের এ কথার সাথে দেখতে পাওয়া যায় তাঁর কাজের হুবহু মিল। রিসালত প্রাপ্তির পূর্ব জীবনে তাঁকে দেখা যায় ব্যবসায়ে নিয়োজিত এক সার্থক যুবক রূপে। তেজারত মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে অধিকতর সচ্ছলতা ও সুস্থতা আনতে পারে বিধায় রাসূল ব্যবসাকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন। সাহাবাগণও ব্যবসা পেশাকে তাঁদের জীবনের অন্যতম উত্তম অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। রাসূল সা.-কে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, সবচেয়ে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ উপার্জন কোনটি? রাসূল সা. উত্তর দিলেন, ‘ব্যবসার, যদি তার মধ্যে আল্লাহ্র না ফরমানির তরিকা অবলম্বন না করা হয় এবং নিজ কায়িক পরিশ্রমের উপার্জন।’ এছাড়া সৎ ও নির্ভরযোগ্য ব্যবসায়ীদের মর্যাদাকে সিদ্দিক, শহীদদের মর্যদার সমান করে বর্ণনা করেছেন রাসূল সা.।
যে ইসলাম মানবজীবনে এভাবে অর্থনৈতিক উন্নতির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে, তা অর্জনের সঠিক পথ সে বাতলিয়ে দিল, সেদিক থেকে বর্তমান মুসলিম সমাজ মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অলসতার যবনিকার অন্তরালে মুখ লুকিয়ে বৃথা শান্তি ও তৃপ্তি অর্জনে ব্যস্ত। সাধারণভাবে দারিদ্র্য মানুষকে খারাপ পথে পরিচালিত করে। বর্তমানসমাজ সংস্কৃতি ধর্মীয়ও রাজনৈতিক জীবনে এর প্রমাণ দিবালোকের মতো উজ্জ্বল। বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে ধন-সম্পদের ব্যাপারে সঠিক চিন্তাধারার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে পবিত্র হাদিসে। সুফিয়ান সওরী বলেছেন, এখন থেকে পূর্বে নবুয়্যতের জমানায় ও খেলাফতের জমানায় মালকে অপছন্দনীয় জিনিস হিসেবে গণ্য করা হতো। কিন্তু আমাদের সময় মাল মুমিনের ঢালস্বরূপ। তিনি বলেন, আজ যদি আমাদের কাছে দিরহাম ও দীনার না থাকতো, তাহলে বাদশাহ ও আমীররা আমাদের ‘রুমাল ’ বানিয়ে নিতো।
আজ যার কাছে কিছু দিরহাম ও দীনার আছে, তা কিছু কাজে লাগানো দরকার (যাতে মুনাফা ও মাল বৃদ্ধি পায়)। কারণ এখন জমানাটা এমন যে, মানুষ যদি অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তবে সে নিজের দীনকে বেচে দেবে। হালাল উপার্জন ও ব্যয় করার নাম অপব্যয় নয়। (মেশকাত)।
মুসলিম জাতীয় জীবনের বাস্তব রূপ ফুটিয়ে তুলে আমাদের করণীয় কীÑ এ ব্যাপারে আমাদের উপদেশ দিচ্ছে উপর্যুক্ত হাদিস। আজ অর্থের অভাবে অসংখ্য মানুষ মিশনারিদের তৎপরতার ফলে ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করছে, সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে বিত্তশালীরা সম্পদের অপব্যবহারের মাধ্যমে সৎ, যোগ্য, খোদাভীরুদের পদানত করে রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রাধান্য বিস্তার করে মানবসমাজকে রববিমুখী জীবনব্যবস্থার দিকে পরিচালিত করে চলছে। রাসূল ও তাঁর পরবর্তী সাহাবাদের জমানায় মানুষের ঈমান মজবুত ছিল। সব ধরনের অভাব-অনটনের মধ্যে তাদের ঈমান সব রকমের বিপত্তি থেকে নিরাপদ ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ের মুসলিম জিন্দেগিতে ঈমানী দুর্বলতা বিরাজ করছে, বিধায় দারিদ্র্য তাদেরকে অতি সহজেই বিপথে পরিচালিত করতে পারছে।
রাসূল (সা.)-এর হৃদয় ছিল ওহির আলোকে প্রজ্জ¦লিত। মুসলমানদের সমাজ জীবনে এ দুরবস্থা ঘটবে অনুমান করেই তাদের জীবনে সচ্ছলতা অর্জনে উৎসাহিত করে তিনি তাঁর শাশ^ত বাণী প্রকাশ করলেন, যেন মানুষ সভ্যতার শেষ সময় পর্যন্ত দারিদ্র্য ও দারিদ্র্য সঞ্জাত ক্ষতি থেকে মুক্তি পেতে পরে। এ ব্যাপারের একটি হাদিস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কাব বিন উজ্রা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ দিয়ে এক ব্যক্তি গেল। সাহাবারা তাঁকে জীবিকা অর্জনে খুবই তৎপর ও আকৃষ্ট দেখে রাসূল সা.কে বললেন, ‘যদি ওই ব্যক্তির দৌড়ঝাঁপ ও অনুরাগ আল্লাহ্র রাস্তায় হতো, তবে কতই না ভালো হতো! তাঁদের কথা শুনে রাসূল সা. ফরমান, ‘যদি এ ব্যক্তি নিজের ছোট ছোট সন্তানদের মতো দৌঁড়ঝাঁপ করে, তবে এ কাজ আল্লাহ্র রাস্তায় বলে গণ্য হবে। যদি সে বৃদ্ধ মাতা-পিতার পালনের জন্য সচেষ্ট থাকে তবে তাও আল্লাহ্র পথে বলে গণ্য হবে। আর যদি সে নিজের জন্য এ চেষ্টা করে এবং তাতে তার উদ্দেশ থাকে অন্য কারও কাছে হাত প্রসারিত না করা, তবে তার এ প্রচেষ্টা-তৎপরতা ও আল্লাহ্র পথে বলে গণ্য হবে। অবশ্য যদি তার এ পরিশ্রম অধিক ধন-সম্পদ অর্জন করে মানুষের ওপর নিজের বড়াই দেখানোর উদ্দেশ্যে হয়, তবে এ সব পরিশ্রম শয়তানের রাস্তায় বলে গণ্য হবে।’ (তারগীব)।
মহান আল্লাহ্র নিয়ন্ত্রণে গোটা বিশ^। মনুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও সচ্ছলতার চাবিকাঠি তারই হাতে। বিশে^র সব উপাদান মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্ট। এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ্র তরফ থেকে বিশে^র সব কিছুই তোমাদের বশীভূত করা হয়েছে।’ (সূরা আল-জাসিয়া : ১৩)। এ আয়াতের দিকে লক্ষ্য রেখেই প্রাথমিক যুগের মুসলমানরা সচেতনতার সাথে তাদের অর্থনৈতিক জীবনকে বিন্যাস করেছিলেন। আমাদেরও উচিত বিশে^র সব ধরনের সম্পদরাজিকে আমাদের কাজে লাগানো।
ইসলাম নৈতিক শক্তিকে মানবজীবনে প্রাথমিক গুরুত্ব প্রদান করে। এই নৈতিক শক্তির প্রতি যথাযথ দৃষ্টি প্রদান করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সচেষ্ট হলেই সমাজে শান্তি আসতে পরে। ইতিহাস প্রমাণ করে যে, হজরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ইসলামের মৌলিক নীতির ভিত্তিতে সমাজকে পুনর্গঠিত করে ছিলেন। যে কারণে তাঁর রাষ্ট্রে ইতিহাসের নজিরবিহীন প্রগতি সাধিত হয়েছিল। সমগ্র মুসলিম সমাজে সে সময় কেউ গরিব ছিল না। এছাড়া খোলাফায়ে রাশেদার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস কীভাবে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি পার্থিব সফলতা ও অর্থনৈতিক উন্নতির পথ খুলে দেয় তার নজির পেশ করেছিল। তাই খোদা ভীরুতার নামে দরিদ্রতাকে যারা উত্তম মনে করে তারা আসলে সুন্নতের পরিপন্থী চিন্তায় নিমগ্ন। রাসূল এরশাদ করেন, ‘লা বায়্সা বিল গিনা লিমানেত্তাকাল্লাহ- খোদভীরু লোকদের জন্য সম্পদশালী হওয়ায় কোন দোষ নেই।’
রাসূল যেমন আমাদের শিখিয়েছেন কুফরি থেকে বেঁচে থাকার, তেমনি শিখিয়েছেন দারিদ্র্য থেকে মুক্তি লাভের উপায়। তিনি যেমন মোনাজাত করেছেন সম্পত্তির নিরাপত্তার জন্য, তেমনি মোনাজাত করেছেন ঋণের গুরুভার থেকে মুক্তি লাভের জন্য। রাসূলের (সা.) এ প্রার্থনা তাঁর উম্মতের জন্য পথ চলার পাথেয়। বিশেষ করে আজ যখন বাতিল শক্তির আর্থিক প্রাচুর্যও জাগতিক উন্নতি মুসলমানদের জন্য হুমকি ও ঈমানের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে; তখন মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব রাসূলের (সা.) কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করা-‘আল্লাহুম্মা ঝিদ্ না ওয়া লা তান্কুছ্ না, ওয়া তাকরিমনা ওয়া লা তুহিন্না ওয়া আয়তেনা ওয়া লা তাহ্রেম না ওয়া আর্ছেনা ওয়া লাতুছের আলাইনাÑ হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে কম দিও না, অধিক মাত্রায় দাও। আমাদেরকে সম্মানিত করো অপমানিত করো না। আমাদেরকে দান করো আমাদেরকে বঞ্চিত করো না। আমাদেরকে অগ্রাধিকার দাও, আমাদের বিপক্ষে কাউকে অগ্রাধিকার দিও না।
রাসূলের দোয়া তাঁর কণ্ঠ সীমায়ই আবদ্ধ ছিল না, তাঁর দোয়া ও প্রচেষ্টা এক সত্তায় লীন হয়েছিল। আজ তাই আমাদেরও এ দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহ্র সামনে পেশ করার সাথে সাথে কর্মপ্রচেষ্টায় নিয়োজিত করা একান্ত প্রয়োজন।
সুখী ও সৎজনের ন্যায় জীবন (আইশাস্ সুয়াদা(য়) আমাদের কামনা হওয়া উচিত। কামনা মহৎ হলে, প্রচেষ্টা আন্তরিক হলে, বুদ্ধিতে জাগ্রত হলে এবং সাধনা নিরবচ্ছিন্ন হলে আল্লাহ্র করুণা আমাদের জন্য শিগগিরই আসবে। আল্লাহ্র কাছে জবাবদিহির সদা জাগ্রত চিন্তার সাথে দুনিয়া চালানের জন্য দক্ষ ও ধনী লোকদের প্রয়োজন। হে আল্লাহ্! তুমি আমাদের সর্বপ্রকার অপরাধ মার্জনা করো, সর্ব প্রকার দোষ ত্রুটি গোপন করো, সর্বপ্রকার দুশ্চিন্তা অপসারণ করো, সর্বপ্রকার ঋণ পরিশোধ করে দাও। দুনিয়া ও আখিরাতের এমন সব প্রয়োজন যাতে তুমি সন্তুষ্ট থাকো এবং যার মধ্যে আমাদের কল্যাণ নিহিত রয়েছে, তা তুমি পূর্ণ করো।