ইহুদি ও মুনাফিকদের চরম ধৃষ্টতা
২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৯:১৪
॥ এম. মুহাম্মদ আব্দুল গাফফার ॥
আল্লাহর দীন এ জমিনে একটাই- আর তা হলো দীনে ইসলাম, যাকে দীনে হক বলা হয়েছে। আহলুল কিতাব অর্থাৎ ইহুদি-খ্রিস্টানরা এ দীনে ইসলামকে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী পরিবর্তন করে নিজেদের খেয়াল-খুশি চরিতার্থ করে পৃথিবীতে শিরক-বিদ’আতের প্রচলনের মাধ্যমে সরাসরি কুফরি মতবাদের ধারক-বাহক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাদের এ আচরণের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘আহলে কিতাবদের (ইহুদি) অনেকেই প্রতিহিংসাবশত চায় যে, মুসলমান হবার পর তোমাদের কাফির বানিয়ে দেয়…।’ (সূরা আল বাকারা: ১০৯)। মহান রাব্বুল আলামিন ইহুদি-খ্রিস্টানদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহানবী (সা.)-কে আরো সতর্ক করে দিয়ে ঘোষণা করেন, ‘ইহুদি এবং খ্রিস্টানরা কখনোই আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত না আপনি তাদের ধর্মের অনুসরণ করেন…।’ (সূরা আল বাকারা: ১২০)। আহলে কিতাব অর্থাৎ ইহুদি সম্প্রদায়ের এ চক্রান্ত আবহমানকাল থেকে চলে আসছে, যা আজ পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। তারা নিজেদের আসমানী কিতাবের (মিথ্যা) জোর দাবিদার হয়েও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মনোনীত দীন ইসলামের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তারে কখনো কসুর করেনি।
এরপর যদি আমরা মুনাফিকদের বিষয় নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে দেখা যাবে তারা আল্লাহর দীনকে ধ্বংসের জন্য যে অপচেষ্টা চালিয়েছে, তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। মুনাফিকদের আচরণ সম্পর্কে মহান রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেন, ‘(হে রাসূল) মুনাফিকরা আপনার কাছে এসে বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল, আল্লাহ জানেন যে, আপনি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী। তারা তাদের শপথসমূহকে ঢালরূপে ব্যবহার করে। অতঃপর তারা আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করে, তারা যা করছে তা খুবই খারাপ।’ (সূরা মুনাফিকুন: ১-২)।
ইহুদি ও মুনাফিকদের বিষয় পবিত্র কুরআনুল কারীম ও হাদীসের গ্রন্থসমূহে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আমি এখানে সংক্ষিপ্ত কিছু কথার অবতারণা করে আলোচনার ইতি টানবো, ইনশাআল্লাহ। মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে মদীনাকে সকল ধর্ম ও শ্রেণি পেশার মানুষের জন্য একটি আদর্শ ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে মুসলমান অমুসলমান, আহলে কিতাব অর্থাৎ ইহুদি-খ্রিস্টানদের নিয়ে একটি সনদ তৈরি করে তাতে সকলের স্বাক্ষর নেন, যা ঐতিহাসিক মদীনা সনদ নামে খ্যাত। ওই সময় মদীনায় তিনটি প্রসিদ্ধ ইহুদি সম্প্রদায়ের বসবাস ছিলো। তারা হলো যথাক্রমে বনি কাইনুকা, বনি নাজির ও বনি কুরাইজা। এ তিনটি প্রসিদ্ধ ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে হিংসুটে ছিলো বনি কাইনুকা। এ গোত্রটি মদীনার মধ্যেই অবস্থান করতো। পেশার দিক দিয়ে তারা ছিলো স্বর্ণকার, কর্মকার ও পাত্র নির্মাতা। তাদের নিকট বহুল পরিমাণে সমরাস্ত্র মজুদ ছিল। তাদের যোদ্ধার সংখ্যা সাতশত ছিলো। তারা মদীনার সবচেয়ে বাহাদুর ইহুদি গোত্র বলে দাবি করতো।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বদর যুদ্ধে যখন মুসলমানদের বিজয় দান করলেন তখন তাদের বিরুদ্ধাচরণ চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। যেকোনো মুসলমানই তাদের বাজারে যেতেন তাঁরই সাথে তারা ঠাট্টা তামাশা এবং বিদ্রƒপাত্মক আচরণ করতো এবং মহিলাদের নিয়েও উপহাস ও ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করতে কসুর করতো না।
একদিন মদীনার আউস এবং খাযরাজ গোত্রের আনসার মুসলমানগণ একটি সমাবেশে মিলিত হয়ে বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনায় রত ছিলেন। ঐ সময় শামস ইবনে কায়স নামক এক কুচক্রী ও কূটকৌশলী ইহুদি ওই মজলিসের পাশ দিয়ে যাবার সময় বুআস যুদ্ধে আউস ও খাযরাজের মধ্যে যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছিলো, তা উসকে দেয়ার উক্তি করছিলো। এতে আউস খাযরাজ উভয় সম্প্রদায় আবার পরষ্পরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হবার প্রস্তুতি গ্রহণ করলো। মহানবী (সা.) এ সংবাদ অবগত হওয়া মাত্র ওই স্থানে গমন করে উভয় গোত্রের আনসার মুসলমানদের উদ্দেশ্যে এক হৃদয়স্পর্শী ভাষণে বলেন, ‘হে মুসলিম সম্প্রদায়! আল্লাহ ক্ষমা করুন, এ কী হচ্ছে? আমার জীবদ্দশাতেই জাহেলিয়াতের চিৎকার? অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে মুসলিম করেছেন, ইসলামের দ্বারা জাহেলিয়াতের মূলোৎপাটন করে তোমাদেরকে কুফর হতে মুক্ত করে তোমাদের পরস্পরের হৃদয়কে একে অপরের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছেন। বিশ্বনবী (সা.)-এর এ হৃদয় উজাড় করে দেয়া ভাষণে আউস ও খাযরাজ আনসার মুসলমানদের সুস্থ বুদ্ধির উদয় হলো এবং তাঁরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে গলায় গলায় মিলে ক্রন্দন এবং তাওবা করে তাঁরা সবাই আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর একান্ত অনুগত হয়ে স্ব স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খ- : ৫৫৫-৫৫৬ পৃ.)।
ইহুদি বনি কাইনুকার এসব চরম সীমালঙ্ঘনমূলক আচরণ থেকে তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য আল্লাহর রাসূল (সা.) স্বয়ং বনি কাইনুকার বাজারে উপস্থিত হয়ে ইহুদিদের ডেকে নানা প্রকার হিতোপদেশ প্রদান করলেন। কিন্তু এ উপদেশে তাদের স্বভাবের কোনো পরিবর্তন তো হলোই না, বরং তাদের হিংসা, ক্রোধ আরও বৃদ্ধি পেলো। (সূত্র: আর রাহীকুল মাখতুম, আবু দাউদ)।
বনু কাইনুকার দুবৃত্তরা মহানবী (সা.)-এর মুখের ওপর বলতে শুরু করলো ‘হে মুহাম্মদ! কতিপয় আনাড়ি কুরাইশকে হত্যা করেছো বলে গর্বিত হয়ো না, যুদ্ধ সম্পর্কে তারা একেবারে অনভিজ্ঞ ছিলো। কিন্তু আমাদের সাথে যখন যুদ্ধ হবে, তখন বুঝবে যে ব্যাপারটি কত কঠিন। (ইবনে আব্বাস, গ্রন্থ আবু দাউদ)। এসব ঘটনার পরও রাসূল (সা.) ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছিলেন কিন্তু একজন মুসলিম মহিলা বনি কাইনুকার এক স্বর্ণকারের দোকানে গেলে স্বর্ণকার কৌশলে তাকে উলঙ্গ করে, ফলে সবাই হাসি তামাসা করতে থাকে। ঐ সময় একজন মুসলমান মহিলাটির সাহায্যে এগিয়ে এলে ইহুদির সাথে তাঁর সংঘর্ষ হয় এবং ইহুদি নিহত হলে অন্য ইহুদিরা মুসলমানটিকে হত্যা করে। (সিরাতে ইবনে হিশাম)।
এ ঘটনার পর বিশ্বনবী (সা.) বনি কাইনুকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং হযরত হামযা ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের হাতে সমর পতাকা তুলে দিয়ে আল্লাহর সৈনিকদের নিয়ে বনি কাইনুকার দুর্গ অবরোধ করেন। বনি কাইনুকার বিরুদ্ধে সমর অভিযানের তারিখটা ছিলো দ্বিতীয় হিজরীর ১৫ শাওয়াল শুক্রবার। বনি কাইনুকার সবাই দুর্গের অভ্যন্তরে আশ্রয় গ্রহণ করে। দীর্ঘ ১৫ দিন কঠিন অবরোধের পর জিলকদের চাঁদ উদয় হওয়ার সাথে সাথেই বনু কাইনুকা মহানবী (সা.)-এর নিকট আত্মসমর্পণ করে। মহানবী (সা.)-এর নির্দেশক্রমে তাদেরে বেঁধে ফেলা হয়। মহানবী (সা.) পরাজিত বনি কাইনুকাদের শাস্তির রায় দানের ব্যাপারে কিছুটা বিলম্ব করছিলেন। ইতোমধ্যে মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাই যে কিছুদিন হলো মুসলমান হয়েছে সে আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর নিকট এসে বনি কাইনুকার প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শনের জন্য বার বার চাপ দিতে শুরু করলো। সে পীড়া-পীড়ি করতে থাকলো আল্লাহর রাসূল (সা.) তার হতে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। সে রাসূল (সা.)-এর জামার অংশ বিশেষ ধরে বলতে লাগলো আপনি তাদের প্রতি দয়াপরবশ হোন। চারশ জন খোলা দেহের যুবক এবং তিনশজন বর্ম পরিহিত যোদ্ধাকে আপনি মৃত্যুদ- দেবেন অথচ তারা আমাকে কঠিন বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিলো। আল্লাহর রাসূল (সা.) আব্দুল্লাহ বিন উবাইর ওপরে বনি কাইনুকার ব্যাপারে ফয়সালার দায়িত্ব এ শর্তে অর্পণ করেন যে, সে যেন এ ইহুদি গোষ্ঠীকে মদীনা হতে বহিষ্কার করে দেয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক বনি কাইনুকা সিরিয়ার দিকে চলে যায়।
তৃতীয় হিজরিতে উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মদীনার গোয়েন্দা বাহিনী মক্কার মুশরিকদের আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মদীনা আক্রমণের তথ্য দিলে মহানবী (সা.) বিশিষ্ট সাহাবীদের নিয়ে গঠিত মজলিসে শূরার অধিবেশন আহ্বান করেন। বৈঠকে আল্লাহর রাসূল (সা.) মদীনায় অবস্থান করেই শত্রুদের প্রতিহত করার পক্ষে মত প্রকাশ করলে মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই তা সমর্থন করে। এক্ষেত্রে তরুণ, সাহসী ও শাহাদাতের আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত সাহাবীগণ মদীনার বাইরে গিয়ে কাফির বাহিনীকে প্রতিহত করার পক্ষে মত পেশ করেন। কারণ মদীনার ভেতরে থেকে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিলে দুশমনদের সাহস বৃদ্ধি পাবে এবং মুসলমানদের ভীরুতা প্রকাশ পাবে। মহানবী (সা.) অধিকাংশ সাহাবীদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে মদীনার বাইরে সমর অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। শাওয়াল মাসের শুক্রবারে জুমার সালাত আদায়ের পর মুজাহিদ বাহিনীকে নিয়ে তিনি উহুদ অভিমুখে রওনা হন। মদীনা এবং উহুদের মধ্যস্থলে পৌঁছে সন্ধ্যা হলে তিনি যাত্রা বিরতি করেন এবং মাগরিব ও এশার সালাত একসাথে আদায় করেন। ফজর হওয়ার কিছু পূর্বে আল্লাহর রাসূল (সা.) রওনা হয়ে শাওত নামক স্থানে পৌঁছে ফজরের সালাত আদায় করেন। এখানে রাসূল (সা.) শত্রুদের কাছাকাছি ছিলেন এবং উভয় সেনাবাহিনী একে অপরকে দেখছিলো। এখানে মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এবং তার সমর্থক তিনশ জন সৈন্য নিয়ে একথা বলতে বলতে ফিরে গেলো যে, অযথা কেন জীবন দিতে যাবো? রাসূল (সা.) তার মতামত না মেনে অন্যদের কথা রাখলেন। আসলে রাসূল (সা.) তার কথা রাখেনি এটা কোনো অজুহাতই হতে পারে না, কারণ তাহলে তার বিশ্বনবীর সাথে এতদূর আসার প্রয়োজনই বা কী ছিলো? সেনাবাহিনী যাত্রা করার পূর্বেই তার পৃথক হয়ে যাওয়া উচিত ছিলো। আসল কথা হলো সংকটময় মুহূর্তে পৃথক হয়ে গিয়ে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা যখন শত্রুরা তাদের প্রতিটি কাজ কর্ম লক্ষ্য করছিলো। মুসলিম বাহিনীর মধ্যে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করাই তার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো। মূলত তার এ ব্যবস্থাপনা ছিলো রাসূল (সা.)-এর সৈনিকদের উদ্যম ও সাহস ভেঙ্গে পড়ার অপকৌশল যাতে শত্রুদের সাহস বেড়ে যায়। আব্দুল্লাহ বিন উবাইর এ ঘৃণ্য অপচেষ্টা ছিলো মহানবী (সা.) ও তাঁর সঙ্গীদের শেষ করে দেয়ারই এক অপকৌশল মাত্র। আল্লাহ তাদের এ জঘণ্য কার্যক্রমকে কখনো সফল হতে দেননি।
আজও ইহুদি ও মুনাফিকদের অপচেষ্টার কোনো কমতি নেই। যার উদাহরণ ফিলিস্থিনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লক্ষ করে থাকি। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুনÑ এ প্রার্থনা রেখেই কথা শেষ করছি। আমীন।
লেখক : সদস্য, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, দরগাহ রোড, সিরাজগঞ্জ।