গল্পটা ফিলিস্তিনের


২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৯:১৩

॥ নাজিয়া তুল ফাতাহ ॥
রাত বেশ হয়েছে, বাইরে অন্ধকার, মেঘের আড়ালে চাঁদ লুকানো। মশারির ভেতর শুয়ে একদিকে চেয়ে আছে সাকিব। এসেছে মামার বাড়ি বেড়াতে। ভালোভাবেই খাওয়া-দাওয়া করেছে। তুষ্ট মনে সৃষ্টিকর্তার নিকট শুকরিয়া জানাচ্ছে। ঘরে হারিকেন জ্বালানো। বাতিটা নিভু নিভু। সাকিব যেন ঘুমাতেই পারছে না। কানে বাজছে সেই বোমার আওয়াজ, ধুম। ওর মনে পড়ছে, ওদের একটা বাড়ি ছিল। সেখানে ও আর ওর বোন হেসে-খেলে ভালোই কাটাচ্ছিল। ওরা ফিলিস্তিনি। আজ ওদের সেই বাড়ি আর নেই। বোমার আঘাতে সব আজ ধ্বংসস্তূপ। সেদিন বাবা তার জন্য একটা বল আর তার ছোট বোনের জন্য একটা বাঁশি কিনে এনেছিলো। সেটা দিয়ে আশপাশের সবার সাথেই তারা খেলে বেড়িয়েছে কতো! আজ সেই প্রতিবেশীরাই নেই। কোথায় হারিয়ে গেছে, তা আপনাদের জানা। এগুলো ভাবতে ভাবতে সাকিবের দু’চোখের কোণে অশ্রু জমে গেলো।
বোনটা ঘুমিয়ে পড়েছে। বাঁশিটা বালিশের পাশেই পড়ে আছে। যাক, ওর বোনটা তো ওর পাশেই আছে, হাবিবের মেজো বোনটা তো মারাই গেছে। হাবিবের পা নাকি নেই, শুনেছে। খুব কষ্ট লাগছিল ওর। ঘুমাতে হবে, ভাবলো না থাক, একটু তাহাজ্জুদের নামাজটাই পড়ে নিই। সব ফিলিস্তিনের জন্য দোয়া করবে। সে উঠে নামাজ পড়লো। পরের দিন সকালে উঠে সে দেখে, মা চায়ের পানি ফুটিয়েছে। খাবার তো আছে। শুনেছে, বাকিরা নাকি খাবারও পাচ্ছে না। ভাগ্যিস মামার মনটা বড়! আল্লাহ রিজিকে ভালো খাবার রেখেছে। কিন্তু খেতে গিয়েই ওর রাইমার কথা, বেলাল এর কথা মনে পড়লো। ও কিছু একটা করবে করবে ভেবে মায়ের এন্ড্রোয়েড ফোন থেকে ওদের অবস্থা ভিডিও করবে ভাবলো। সে চললো, সেই ধ্বংসস্তূপের দিকে, গিয়ে একটা ভিডিও বানিয়ে অঝোরে কাঁদলো এবং অর্থ সাহায্য চাইল।
হয়তো ওর জানা ছিলো না, ভিডিওটা ভাইরাল হবে, আর সে বেশকিছু টাকা পাবে।
সেদিন ঈদ। সাকিব তার ভিডিও থেকে যে টাকা পেয়েছে, তা তার এলাকায় গিয়ে নতুন জামা, ভালো খাবার বিতরণ করলো। এতে কিছু মানুষের মুখে সাময়িক হাসি ফুটলো।
বিকেলে বাইরে গাছটার নিচে সাকিব, তার বোনের সাথে বসে খেলছিলো, হঠাৎ, একটা পরিবার, একজন মা তার সন্তানদের নিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে, সাহায্য চাইলো, খাবার চাইলো। মামিকে জিজ্ঞেস করায় মামি হাসিমুখে খাবার দিতে চাইলো আর বললো, সেই মহিলাটা যদি তাদের বাসায় কাজ করে, তাহলে কিছু টাকা আর খাবার তারা পাবে। এটা শুনে তারা রাজি হলো, কারণ তার স্বামী বোমার আঘাতে মারা গেছেন। এরপর থেকে সে কাজ করা শুরু করলো।
সাকিবের খুব ঘৃণা হতো, যখন এ ধ্বংসাবশেষ থেকে কান্নার আওয়াজ আসতো। নিজেকে জিহাদের জন্য প্রস্তুত ভাবতো। ও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলো যে ওদের বিরুদ্ধে সে যুদ্ধ করবে, দরকার হলে প্রাণটাও দেবে।
মা অন্য এক চাচির বাসায় গেছে, তার ছোট বোনকে নিয়ে। এলাকাটা খুব বেশি নিরাপদ নয়। গেছে চাচির কাছ থেকে কিছু টাকা পেতো, সেটা নিতে। সাকিবের খুব চিন্তা হচ্ছিলো। তারপর তারা যখন ফিরে এলো, সাকিব আনন্দে কেঁদে দিলো।
সাকিব, হামিম, আসলাম বিকালে খেলছিলো। হামিমের মা গেছে, তার বড় ছেলের সাথে বাজারে।
হঠাৎই বিস্ফোরণে প্রাণ গেলো হামিমের মা আর বড় ভাইয়ের। এরপর শুধুই স্তব্ধতা। সাকিব খবর পেয়ে দৌড়ে গেলো। শুধুই ধোয়া আর আগুনের স্ফুলিঙ্গ, বাতাসে নীরবতা। পড়ে আছে হামিমের বড় ভাই আর মায়ের দেহ ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পাশেই পড়ে আছে হামিমের জন্য কিছু ফল। সাকিব তখন কান্নায় ভেঙে পড়লো। রাগে-ক্ষোভে ঘৃণায় সে চাইলো আজই শয়তানদের শেষ করে দেবে। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে ওই দস্যু সেনাদের পিছু নিয়ে তাদের সকল পরিকল্পনা মোবাইলে রেকর্ড করে পুলিশদের জানিয়ে দিলো। এতে সে এলাকায় যুদ্ধ ভেস্তে গেলো। মানুষ চরম আনন্দ পেলো সুরক্ষা পেয়ে। সাকিব খুবই মজা পেল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে ছোট বড় সবারই অংশ নেয়াটা খারাপ নয় বটে। রাতের আকাশে তারা দেখতে দেখতে ফিলিস্তিন যেন সুরক্ষা পায়, তাই ভাবছে সাকিব।
এরপর একটা ভয়ংকর সময় এলো, যখন সাকিবের মামার বাড়ির এলাকায় যুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলো। এখন সাকিবরা কোথায় যাবে, কী করবে, কোথায় খাবে, মামারাই বা কোথায় যাবে। তারা এলাকাটা ছেড়ে দিলো। প্রচ- রোদ, ধূ-ধূ রাস্তা, ওরা গাড়িতে। খাবার শেষ দুদিনেই। এখন ওরা কী খাবে, কোথায়ই বা যাবে, যাচ্ছে বটে। এক পরিচিতদের বাসায়, দুদিন থাকবে সেখানে। কিন্তু এ যাযাবর জীবনের শেষ কোথায়। হুম। আবার আসবে ফিরে তারা নিজ এলাকায়, যদিও বাসার চিহ্নমাত্র নেই। কিন্তু মনে বড় আশা সাকিবের, আবার ফিরে যাবে নিজ এলাকায়, নিজ বাসায়, সেই পুরোনো স্কুল আর খেলার সাথীদের ফিরে পাবে, ইনশাআল্লাহ। লেখক : ছাত্রী।