৮ মাস ধরে শুনানির জন্য অপেক্ষা

জামায়াতের নিবন্ধন কবে ফেরত পাওয়া যাবে?

সাইদুর রহমান রুমী
২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৯:০৬

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের সাড়ে ৮ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। তৈরি হয়েছে এক নতুন বাংলাদেশ। কিন্তু এ সময়ে অনেক বিষয়ে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে গণমানুষের মাঝে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ও প্রতীক নিয়ে চলমান দীর্ঘসূত্রতা জনমনে তৈরি করেছে উদ্বেগ-হতাশা। প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, তাহলে কোথায় আটকে আছে নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার জটিলতা।
৫ আগস্ট হাসিনার পলায়নের পর ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বাতিল হওয়া নিবন্ধন ফিরে পেতে খারিজ হওয়া আপিল পুনরুজ্জীবিত করার আবেদনের শুনানির দিন ধার্য করেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ। যার এখনো পূর্ণাঙ্গ শুনানি সম্পন্ন হয়নি।
আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে আওয়ামী লীগ
২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ের পর ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। এর আগে জামায়াতকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে তরীকত ফেডারেশনের সেক্রেটারি সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ কথিত ২৫ জন ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেন। যার ফলে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্টের তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ। বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর (লার্জার) বেঞ্চ এ রায় দিয়েছিলেন। ওইসময় সংক্ষিপ্ত রায়ে আদালত বলেছিলেন, জামায়াতকে নিবন্ধন দেওয়া আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত। একই সঙ্গে আদালত জামায়াতকে আপিল করারও অনুমোদন দেন। তবে এ রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে জামায়াতে ইসলামীর করা আবেদন একই বছরের ৫ আগস্ট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের কুখ্যাত চেম্বার বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। পরবর্তীতে একই বছরের ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর নিবন্ধনের বিষয়টির প্রশ্ন আসলে নির্বাচন কমিশন জামায়াতকে সাময়িক নিবন্ধন দেয়। সেই সময়ও জামায়াতে ইসলামীর সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ও রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামের কথা ছিল। পরবর্তীতে রিটকারীরা এগুলো বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলে রিটে উল্লেখ করে। জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে রুল জারির পর ওই বছরের ডিসেম্বরে একবার, ২০১০ সালের জুলাই ও নভেম্বরে দুবার এবং ২০১২ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে জামায়াতে ইসলামী দুইবার তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়। এসব সংশোধনীতে দলের নাম ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করা হয়। তারপরও হাইকোর্ট ফরমায়েশি রায়ে জামায়াতে ইসলামীকে দেওয়া নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে দলটির করা আপিল ও লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর খারিজ করে দিয়ে আদেশ দেন আপিল বিভাগ, যা গত বছর ৫ আগস্টের পরে দেরি মার্জনা করে আপিল ও লিভ টু আপিল পুনরুজ্জীবিত চেয়ে দলটির পক্ষ থেকে পৃথক আবেদন করা হয়। এরপর গত বছর ২২ অক্টোবর আপিল বিভাগ আবেদন মঞ্জুর (রিস্টোর) করে আদেশ দেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ, যা এখনো শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে।
শেষ মরণকামড় হিসেবে আওয়ামী লীগ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারি করে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮(১) ধারায় জামায়াত, ছাত্রশিবিরসহ তাদের অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছিল। যদিও হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার ২৮ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
কবে পাওয়া যাবে নিবন্ধন
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বিষয়ে আপিল শুনানি শিগগিরই অনুষ্ঠিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বাদীপক্ষের আইনজীবী শিশির মনির। গত ২২ এপ্রিল মঙ্গলবার তিনি জানান, নিবন্ধনের বিষয়টি ইতোমধ্যে দুবার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। অর্থাৎ তা আংশিক শ্রুত হয়েছে। প্রধান বিচারপতি দেশের বাইরে চলে যাওয়ায় তা কয়েকদিন স্থগিত থাকবে। তিনি দেশে আসার পর আশা করা যায় আগামী সপ্তাহে এটি আবার পূর্ণাঙ্গ শুনানির জন্য উচ্চ আদালতে উঠলে তার সমাধান হয়ে যাবে।
এদিকে গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে দীর্ঘ এতগুলো মাস পার হয়ে গেলেও নিবন্ধন মামলাটির সুরাহা নিয়ে হাইকোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ও ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য এডভোকেট পারভেজ হোসেন বলেন, একজন আইনজীবী হিসেবে আমি মনে করি, যেকোনো দলের জন্য নিবন্ধন বিষয়টি আসলে কোনো প্রয়োজনই নেই। ইউরোপ-আমেরিকায় কোনো দলের জন্য নিবন্ধনের কোনো সিস্টেমই নেই। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে যেকোনো ব্যক্তি দল জনগণের ম্যান্ডেটের জন্য নির্বাচনে আসতে পারে। এটি আসলে রাষ্ট্রযন্ত্র নির্ধারণের বিষয় নয়, এটি জনগণ নির্ধারণ করবে। এটি মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। আর জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলটি ছিল শেখ হাসিনা কর্তৃক দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করা এবং রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করার অপকৌশল। রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে নতজানু করে রাখার একটি কৌশল ছিল এটি। জামায়াতে ইসলামী সবগুলো বিষয় পূরণ করার পরও নিবন্ধন পেল না অথচ আমরা কী দেখলাম, ২০২৪-এর নির্বাচনের পূর্বে নামসর্বস্ব দুটি দলকে নিবন্ধন দেয়া হলো। এসব দলের রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ৫০ জনকে মিছিল করার জন্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ নিবন্ধনের শর্ত ছিল কমপক্ষে ১০০ উপজেলা এবং ২১টি জেলায় কমিটি থাকা লাগবে। তখন ১০-১২টি দলের একটি শর্ট তালিকা করা হয়েছিল, এর মাঝে তালিকার প্রথমে থাকা ২-৩টি দলকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ পিছনের সারির দলকে নিবন্ধন দেয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে।
এদিকে আইনজীবীরা আশা করছেন, আপিল বিভাগে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরে পাবে। একই সঙ্গে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে এটিএম আজহারুল ইসলামের মুক্তির ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তারা। তারা জানান, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত একটি ‘সার্টিফিকেট আপিল’ করেছে, যা সংবিধান সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আওতাভুক্ত হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ শুনানি প্রয়োজন। মামলার শুনানি শুরু হওয়ার পর অপর পক্ষের আইনজীবী দেশের বাইরে থাকায় তারা কিছুদিন সময় নেন। পরে শুনানি এগিয়ে এলে মামলায় নিযুক্ত বিচারপতি দুর্ঘটনায় পড়েন। এ কারণে তিনি প্রায় এক মাস আদালতে উপস্থিত থাকতে পারেননি। এতে দ্বিতীয় ধাপে মামলার শুনানি বিলম্বিত হয়। প্রতি সপ্তাহের মঙ্গল ও বুধবার এ মামলার শুনানি হয়। সেই হিসাবে ২২ এপ্রিল এ মামলার শুনানি শুরু হলে দ্রুত তা শেষ হবে বলে আশা করছি। কিন্তু ২৩ থেকে ৩০ এপ্রিল প্রধান বিচারপতি দেশের বাইরে থাকবেন। এরপর এ দুই মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে। তারা বলেন, জামায়াতের গঠনতন্ত্র কোনোভাবেই অসাংবিধানিক নয়। সংবিধান এবং গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ ১৯৭২-এর সঙ্গে জামায়াতের গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক বলে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছিল। অথচ জামায়াতে ইসলামী অতীতে সবগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। প্রায় সব জাতীয় সংসদেই জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব ছিল। জামায়াতের গঠনতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনোভাবেই অসাংবিধানিক নয়। কারণ অ্যাসোসিয়েশন করার অধিকার, দল গঠন করার অধিকার, এটা সব ব্যক্তির আছে। আর প্রতীক বরাদ্দের দায়িত্ব তো সুপ্রিম কোর্টের নয়। প্রতীক বরাদ্দ করেছে নির্বাচন কমিশন। কয়েক যুগ থেকে জামায়াতের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা। জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত দাঁড়িপাল্লাই দলটির প্রতীক। এই প্রতীক এখন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী রেজিস্ট্রেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
কি বলছেন জামায়াত নেতারা
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, আমরা চেয়েছিলাম অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বৈষম্যহীনতার উদাহরণ সৃষ্টি করবে। কিন্তু কাউকে মুক্তি দেবে, কাউকে মুক্তি দেবে না, সরকারের এমন কর্মকা-ে জাতি হতাশ হয়েছে। অনতিবিলম্বে এটিএম আজহারুল ইসলামকে মুক্তি দিতে হবে। জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ও প্রতীক ফেরত দিতে হবে। নতুবা জামায়াতে ইসলামী রাজপথে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করবে। মনে রাখতে হবে, ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে, ফ্যাসিবাদের জুলুম ধরে রাখা যাবে না। সকল জুলুমের কবর রচনা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষনেতাদের আওয়ামী লীগ বিচারিকভাবে হত্যা করেছে। যখন দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করছেন এটিএম আজহারুল ইসলাম, তখন আওয়ামী লীগ তাকে আটক করে মিথ্যা মামলা দিয়ে ১৩ বছর ধরে কারাগারে বন্দি করে রেখেছে। ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে তাকে এখনো আটক রাখায় জাতি বিস্মিত ও হতবাক। দেশবাসী স্বৈরাচারের কবল থেকে পরিপূর্ণভাবে মুক্তি চায়। অবিলম্বে আজহারুল ইসলামকে মুক্তি দেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘১৯৭৯ সাল থেকে শুরু করে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে এ পর্যন্ত জামায়াতের ৫৫ জন নেতা জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাদের মধ্যে ৫০ জন পুরুষ ও ৫ জন নারী।’ তিনি বলেন, ‘নিবন্ধন দ্রুত ফিরে না পাওয়া আমাদের জন্য দুঃখজনক। আশা করি, সাংবিধানিক ও আইনানুগ পন্থায় আমরা ন্যায়বিচার পাব।’