আসুন সত্য ও বাস্তবের মুখোমুখি হই
২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৮:২৮
দেশ, জাতি, রাষ্ট্র, সমাজ কোনোটাই এখন ইজি সেইলিংয়ে নেই। মনে হচ্ছিল পরিভ্রমণটা গতিমুখর হবে। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য, আমরা শৃঙ্খলার মধ্যে আসতে পারলাম না। দেশে নানা আদর্শ আছে, নানা মতবাদ আছে, নানা জাতি, উপজাতি ও সংস্কৃতি আছে। এটা তো আমরা সবাই জানি। আমাদের মধ্যে বিভেদ আছে, বিভক্তি আছে, হিংসা আছে, বিদ্বেষ আছেÑ সবকিছুই আমাদের বোধগম্যের মধ্যে। কিন্তু আমরা ভেবেছিলাম, গত ৫৩ বছরে আমরা তো অনেক শিখেছি, জেনেছি, বুঝেছি। মানুষ তো ঠেকে শেখে, আমরাও মনে করেছিলাম ভালো হোক, মন্দ হোক, আমরাও তো মানুষ। কিন্তু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রধান কবি রবিঠাকুর যে বলে গিয়েছিলেন, ‘রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি’Ñ এটা একদম আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। আমরা মনে করেছিলাম, এ উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশের তুলনায় আমরা বাংলাদেশিরা বিভিন্ন কারণে বেশি বেশি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আন্দোলন করেছি। অন্যরা মাত্র একবার স্বাধীনতা আন্দোলন করেছে, আমরা অন্তত দুবার স্বাধীনতা আন্দোলন করেছি। এ পটভূমি ও প্রেক্ষাপটে আমরা বাঙালিরা বা বাংলাদেশিরা যদি মানুষ না হই, তাহলে অন্যরা মনুষ্য পদবাচ্যে বিবেচিত হবে কেমন করে। আমরা তো লড়াই করে করে বেঁচে আছি। সুতরাং মনুষ্যত্বের বিকাশ ও মানবিকতার স্ফুরণ আমাদেরই তো বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু দুনিয়ায় বোধ হয় দুই আর এক যোগ করলে সবসময় তিন হয় না।
এত বড় একটা গণঅভ্যুত্থান হলো। গণবিপ্লব হলো। কিন্তু আমাদের চরিত্রে বা দৃষ্টিভঙ্গিতে সামান্যতম কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে দেখা তো যাচ্ছে না। আমরা যেন যা ছিলাম, তাই আছি। আমাদের কোনো পরিবর্তন নেই। এ অবস্থা এবং ব্যবস্থাকে অনেকেই মূল্যায়ন করে বলেন, এটা তো একটা জাতির জন্য সুলক্ষণ। সমাজচিন্তকরা এসবকেই বিবেচনা করে বলেন, ঐতিহ্য। কিন্তু আমাদের দাদা-দাদি, নানা-নানি, বাবা-মা, চাচা-চাচি, মামা-মামিরা তাদের যাপিত জীবনে ভালো-মন্দ যা কিছু করেছে, তার সবই কী ঐতিহ্য? উন্নত, মানবিক এবং টেকসই হওয়ার মতো গ্রহণযোগ্য চমকপ্রদ বিষয়কে ঐতিহ্য বলা হয়। যেটা বহুকাল ধরে চলে আসছে। অর্থাৎ চলমান বিষয়। এর আবার নানা রকম ব্যাখ্যা আছে। ব্রিটিশরা বলে, ‘লেগাসি অব দা পাস্ট’ অথবা আরো সুন্দর করে বলে, ‘হেরিটেজ’।
আমাদের প্রত্যন্ত অঞ্চল এখন আর পূর্বের মতো নেই। উপজেলা হওয়ার কারণে বাঙালি জীবনে আধুনিকতার পরশ বহু পূর্ব থেকেই প্রবিষ্ট হয়েছে। সে কারণে গ্রাম আর শহরের ব্যবধানও অনেকটা দূর হয়ে গেছে। যেমন বড় খানাপিনাকে আমরা বলতাম জিয়াফত, যা ছিল বাঙালি জীবনের মতো সহজ-সরল। হোগলাপাতা, পাটিপাতা, বাঁশের চাটাই ইত্যাদির ওপর কলাপাতার পাতে গোশতসহ ডাল-ভাতের ব্যবস্থা থাকতো। সাথে থাকতো দইসহ নানা ধরনের ক্ষীর-পায়েস ইত্যাদি। এখন তো আর গ্রামে-গঞ্জে সেসবের চিত্রপট খুঁজে পাওয়া যায় না। এখন শহরের মতোই চেয়ার-টেবিলে বসে খানাপিনা হয়। অনেক পটপরিবর্তন বা সোজা-সাপ্টা পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। আবার গ্রামের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখে পান্তাভাত আর ইলিশ আমদানি হয়েছে। আবার শহর থেকে গ্রামে রপ্তানি হয়েছে শাড়ি, ছায়া, ব্লাউজের পরিবর্তে সালোয়ার-কামিজ বা বর্তমানের থ্রিপিস। না, এ বিষয়ে আর বকবক করবো না। পরিবর্তন এসেছেÑ ভালোর দিকে আবার মন্দের দিকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভালোটা টিকে গেছে আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে খারাপটা টিকে গেছে। কারণ মানুষের প্রবণতা শুধু ভালোর দিকে নয়, খারাপের দিকেও। পূর্বে আমরা ভাবতাম, মূর্খ বা অল্প শিক্ষিত লোকেরা অভাবের কারণে দুর্নীতিপরায়ণ হয়। অথচ এখন আমরা দেখছি যার শিক্ষা-দীক্ষা বেশি, সে যেন তত বেশি দুর্বৃত্ত। আগে চুরি-ডাকাতি ও সিঁদ কাটতো দরিদ্র, গরিব, মূর্খ মানুষরা, এখনো হয়তো এসব দুর্বৃত্তপনার মধ্যে যোগসাজশ আছে অপেক্ষাকৃত মূর্খদের মধ্যে। কিন্তু বড় আকারে চুরি-ডাকাতি, লুটপাট, পরস্বহরণ, টাকা-পয়সা সম্পদ পাচার, ব্যাংক লুটপাট- এসব এখন কারা করছে? বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীরাও তো সহজে বলতে পারে। যেকোনো উপজেলার যেকোনো কিশোর-কিশোরী এক্ষেত্রে সাহসের সাথে বলবে, ক্ষমতাসীনরাই এসব আমাদের দেশে করে থাকে। শুধু কি ‘ক্ষমতাসীন’রা? অর্থাৎ রাজনীতিবিদরা? যদি এভাবে আমরা বলি, তাহলে অসত্য কথা বলা হবে। উচ্চশিক্ষা লাভকারী থেকে সমাজের ওপর কাঠামোয় খুব সামান্যসংখ্যক মানুষই এখন সুনীতির মধ্যে আছে। দুর্নীতি শেখার জন্য কোনো স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়-মাদরাসাসহ কোনো বিদ্যাপীঠ নেই। কিন্তু এ ব্যবসাটা এখন সবাই জানে। এর জন্য বিধিবদ্ধ সিলেবাস, কারিকুলাম কোথাও কিছু নেই। কিন্তু এটা এখন সবাই জানে, সবাই বুঝে এবং এ ব্যবসাকে কেন্দ্র করে পৃথিবী এখন দোল খাচ্ছে।
মাঝে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে উল্লম্ফন দিয়ে সেনাবাহিনী শাসিত সরকার নামে ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিনের যে তথাকথিত সরকার ছিল, তারাও পরিবর্তন বা সংস্কারের ডাক দিয়েছিল। তাদের কথা কোনো রাজনৈতিক দল গ্রহণ করেছিল বলে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। এর প্রধান কারণ বাঙালি বা বাংলাদেশিরা পরিবর্তন বা সংস্কারে ভয় পায়। এটা একটা আমাদের স্বাতন্ত্র্য বা বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এখানে অবশ্য বড় বিষয় ছিল- কোন ধরনের সরকার জাতির পিঠে জেঁকে বসেছিল, তার ওপর। তাদের কেউ সরকার হিসেবে মানতে রাজি ছিল না। কারণ তাদের ওপর জনগণের কোনো আস্থা ও বিশ^াস ছিল না। তারা নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল। সাময়িক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল একটি সুস্থ-সুন্দর ও নৈতিক নির্বাচন উপহার দেয়া। কিন্তু তারা ‘ডিরেইল্ড’ হয়ে গেল। তারা সামনে আনলো পরিবর্তন, সংস্কার, মাইনাস টু ইত্যাদি প্রসঙ্গ। আওয়ামী লীগের সঙ্গে এ তথাকথিত সরকারের যোগসাজশ ছিল। ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিন সরকারই নানা কৌশল ও শয়তানি করে আওয়ামী লীগ সরকারকে প্রতিষ্ঠা করল। সেই থেকেই আমরা আজাব ও গজবের মধ্যে নিপতিত হলাম। যার রেশ এখনো চলছে। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, তারা কিন্তু প্রকৃত অর্থে সংস্কার বা পরিবর্তন চায়নি। ঐ প্রসঙ্গে তারা ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চেয়েছে। সেই দীর্ঘায়ু করার বিষয়টি শেষ পর্যন্ত তাদের হাতে থাকেনি। ভারত ও রাজনীতির বাইরের একটি শক্তির চালে ক্ষমতা চলে যায় আওয়ামী লীগের হাতে।
এবারের পরিস্থিতিটা একটু ভিন্ন ধরনের। কারো চালে গুটি ঘুরছে বলে মনে হয় না। এখানে এখন স্টেকহোল্ডার অনেক। তাদের মধ্যে রয়েছে ভারত, পাশ্চাত্য জগৎ, চীন, খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর সাথে মাইনর স্টেক হোল্ডার রয়েছে। রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনী এবং অন্তর্বর্তী সরকার। গণঅভ্যুত্থানের পরপরই ঐতিহাসিক কারণে পরিবর্তন বা সংস্কারের কথা উঠেছে। হয়তো ভুল বললাম, আগেরবার চেঞ্জ তথা পরিবর্তনের কথা বুঁদবুঁদের মতো আসছিল। আর এবার পরিবর্তনের কথা উদ্ভাসিত হলেও তেমনভাবে সঞ্চারিত হয়নি। সঞ্চারিত বা সঞ্চালিত হয়েছে সংস্কারের কথা। আবারও পূর্বের মতোই দেখা গেল, সংস্কারের কথা প্রথম দিকে সামষ্টিকভাবে কেউ কানে তোলেনি। কিন্তু ধীরে ধীরে নাগরিক জীবনে তা ব্যাপকভাবে সঞ্চারিত হলো। সরকার ছাত্র-জনতা ও ইসলামী দলগুলো সংস্কারের দিকে ঝুঁকে পড়লো। ধীরে ধীরে এখন এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে- যাতে মনে হচ্ছে দেশবাসী নয়, দেশ নয়, বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও ভূ-রাজনীতি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে। ভারত ভালো করেই জানে এবং সেক্যুলার গোষ্ঠী রাজনীতি এখন সংস্কার চাচ্ছে না। তাদের সংস্কার কার্যকরী হলে সৎ, যোগ্যদের কদর বাড়বে। চাঁদাবাজি, দখলবাজি, দুর্নীতি বন্ধ হবে, রাজনীতি, দুর্বৃত্তমুক্ত হবে। ধান্দাবাজ রাজনীতি ব্যবসায়ীদের বিদায় ঘণ্টা বাজবে। এ কারণেই সংস্কারবিরোধীরা তড়িঘড়ি নির্বাচন চায়। পক্ষান্তরে সংস্কারপন্থীরা গত কয়েক মাসে ধীরে ধীরে এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, তারা এখন দাবি জানাচ্ছে আগে বিচার ও সংস্কার। তারপর নির্বাচন। সংস্কারবিরোধীরা শুধু ইসলামকে ভয় পাচ্ছে না, তারা ভয় পাচ্ছে বিচার-আচারকেও। এই পক্ষ নির্বাচনের আগে-পরে; বিশেষ করে ভারত, আওয়ামী লীগ ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চায়। তাই তারা ঝটপট বিচার চায় না। বিচার দীর্ঘায়িত হোক অথবা বিচারের নামে আসামি খালাস হোকÑ এটাই তারা বড় বেশি চায়।
তবে এতো পোলারাইজেশনের ভেতরেও সবার সাথে সবার কথাবার্তা হচ্ছে, যোগাযোগ হচ্ছে। কিছুটা হলেও সবার মধ্যে একরোখা ভাবটা কমে আসছে। এই প্রথমবারের মতো অনুভব করা যাচ্ছে যে, দেশ-বিদেশের সকল স্টেকহোল্ডার একপা এগোচ্ছে তো কিছুদিন পর আবার এক পা পিছাচ্ছে। ঘুরে ফিরে একই জায়গায় অবস্থান করে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে মুখ ফেরাচ্ছে। একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে অন্যদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী, তা অনুধাবন করার চেষ্টা করছে। যারা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাচ্ছিল, তাদের উচ্চকণ্ঠ এখন কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে। তারাও হয়তো ভাবছে, বড় কোনো ভুল করছি না তো।
আমরা এতক্ষণ নকল স্টেকহোল্ডারদের কথা নানামাত্র আলোচনা করলাম। দেশের আসল স্টেকহোল্ডার হলো দেশের নাগরিক। শুধু ভোটাররা নয়, ছাত্ররা যখন বিদ্যালয়ের রাজনীতি ছেড়ে, রাষ্ট্রের রাজনীতি ধরেছে, তখন বুঝতে হবে দেশের নাগরিকরা এখন ভীষণভাবে সচেতন। এ সচেতন নাগরিকদের মধ্যে জরিপ করলে দেখা যাবে, শতকরা অন্তত ৭০-৭৫ শতাংশ নাগরিক নির্বাচনের আগে সংস্কার ও বিচার চায় এবং পরিপূর্ণ সংস্কার চায়। আধা, চারআনা, দুআনা বা একআনা সংস্কার চায় না।
মনে হয়, সংস্কারপন্থীরা শক্তিশালী হচ্ছে। তারা সংহত হচ্ছে। তারা আন্তরিকভাবেই দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কল্যাণ চাচ্ছে।
ভারত তো নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছে। তারা বাংলাদেশের সাধারণ অধিকারগুলো কেড়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মধ্যে নাক গলাচ্ছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার মিথ্যা রটনা ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রকাশ্যে পঙ্গু করার চেষ্টা করছে। পানির বিষয়ে বাংলাদেশকে তারা চিরকালের মতো একদিকে খরা সৃষ্টি করছে; অপরদিকে অসময়ে বন্যা সৃষ্টি করছে। এছাড়া ভারতের মুসলমানদের ওপর জায়োনিস্টদের মতো ধ্বংসলীলার সৃষ্টি করছে। তারা নির্মম, নিষ্ঠুর ও অনৈতিকভাবে মসজিদ, মাদরাসা, মুসলমানদের ব্যবসা-বাণিজ্য, বাড়িঘর, সহায়-সম্পত্তি লুটতরাজ করছে। এসব করে তারা বাংলাদেশের মানুষের মনকে ধীরে ধীরে ভারতবিদ্বেষী বানাচ্ছে। এতে কারো লাভ নেই। সকল পক্ষকে সত্য ও বাস্তবতার দিকে অগ্রসর হতে হবে।