নির্বাচন নিয়ে গোঁজামিলের কোনো সুযোগ নেই

একেএম রফিকুন্নবী
২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৮:২৫

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে গেলে স্বাধীনতার শুরু থেকেই ২০২৪ সালের নির্বাচন পর্যন্ত আমাদের খুব ভালো অভিজ্ঞতা নেই। তাই সামনের নির্বাচন সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ, জনগণের অংশগ্রহণেই হবে, ইনশাআল্লাহ। কোনো ভাঁওতাবাজি বা ফাঁকিবাজি করে নির্বাচন বানচাল করা যাবে না।
দীর্ঘদিন জনগণ তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। ভোট ছাড়া, দিনের ভোট রাতে বা প্রশাসন দ্বারা ভোটের বাক্স ভরে আমরা-মামুরা দিনের বেলায় এমপি ঘোষণা দিয়ে দেশ চালিয়েছে নারী হিটলার স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা। দেশীয় দোসর ও বিদেশি প্রভুদের সাহায্যে জনগণকে ফাঁকি দিয়ে ফ্যাসিস্ট একদলীয় শাসন কায়েম করে রেখেছিল। লোকসমাজে একটি কথা চালু আছে, ‘চোরের দশ দিন ভালো লোকের এক দিন’। দীর্ঘদিন জনগণ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল কীভাবে হাসিনাকে তার কৃতকর্মের উচিত জবাব দেবে।
ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সেই সুযোগ এনে দেয় জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে। ছাত্ররা ৯ দফা দাবি আদায়ে মাঠে নামলেও পরবর্তীতে ১ দফার আন্দোলনে রূপ নেয়। শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ থেকে শুরু করে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র শাহবাগ থেকে হাসিনা তাড়ানোর অভিযান শুরু করে। যদিও গোটা জুলাই-২০২৪ থেকেই এ আন্দোলন দানাবাঁধে। চূড়ান্ত হয় ৫ আগস্ট।
ছাত্ররা বুদ্ধি করে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে ফ্রান্সে যোগাযোগ করে তাকে রাজি করাতে সক্ষম হয় আপৎকালে দেশের হাল ধরতে। হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায়ই তিনি ছাত্রদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশে চলে আসেন। ৫ আগস্টেই হাসিনাকে তাড়ানোর কাজ শেষ হয়ে যায় দেশদরদি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায়।
দেশের মানুষ দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করার জন্য মাঠে-ময়দানে নেমে আসে। যা হবার তাই হয়ে গেল নিমিষে। প্রধানমন্ত্রীর রাজকীয় বাসভবন, গণভবন মুহূর্তে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। মনে হলো যেন মহান আল্লাহর আবাবিল পাখির সদৃশ ছাত্র-জনতার দখলে চলে যায় এ ভবন এলাকা। দুপুরের পরপরই স্বৈরাচারী হাসিনা তার প্রিয় মোদির দেশে গিয়ে প্রাণ বাঁচায়।
৮ আগস্ট বর্তমানের ড. ইউনূস সরকারের যাত্রা শুরু হয়। ছাত্র-জনতার সমাবেশে শপথ না নিয়ে স্বৈরাচারের দোসরদের কাছে বঙ্গভবনে শপথ নেয়ায় বিপ্লবী সরকারের ভাবমর্যাদা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে বিপ্লবের সুফল আমরা ঘরে আনতে পারলাম না। দ্রুত দেশ ভালোর দিকে যাওয়ার সুযোগ আমরা হারালাম। তারপরও চলছে প্রায় ৯ মাস। দেশ অনেকদূর এগিয়েছে। যত ছিদ্র ছিল প্রায়ই বন্ধ হয়েছে। দীর্ঘদিনের অপচয়-অব্যবস্থাপনা, ব্যাংক লুট, টাকা পাচার, ঘরে ঘরে দুর্নীতির ছাপ এমনভাবে চলেছে, সহজে সঠিকভাবে লাইনে আনতে সময় লাগছে।
ইতোমধ্যেই দেশের বড় আর্থিক খাত রিজার্ভ একালের সর্বোচ্চ অর্জিত হয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম অনেকটাই নাগালের মধ্যে এসেছে। উপদেষ্টারা চুরি-চামারির সাথে জড়িত নেই বলেই দেশ রাহুমুক্তের কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। যারা দীর্ঘদিন দেশকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছিল, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, হাট-ঘাট খাওয়া সবই ৫ আগস্টের পর ২-৩ দিনের মধ্যেই নতুন রূপে না খাওয়া পার্টি হাজির হয়ে পূর্বের সব জায়গা দখল করে নেয়। লোকাল প্রশাসন পুলিশ কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। তাদের মনোবল পূর্বেই ভেঙে গেছে। কিছু রদবদল হলেও পূর্বের প্রেতাত্মারা সচিব থেকে ডিসি, এসপি, ওসি, ইউএনও এখনো বহাল তবিয়তে আছে। অতিসত্বর সব জায়গায় পরিবর্তন আনতে হবে।
লোকাল প্রশাসন কাজ করছে না। কারণ ইউপি সদস্য, চেয়ারম্যান, মেয়র, কমিশনার সবই পলাতক। অতিসত্বর লোকাল প্রশাসনের নির্বাচন জরুরি হয়ে পড়েছে। লোকাল নির্বাচন দিলে এলাকার লোকেরা সৎ, যোগ্য, দুর্নীতিমুক্ত লোকদের নির্বাচিত করে আনতে সক্ষম হবে। যে দলেরই হোক না কেন, তাদের জনগণের কাছে জবাবদিহির মানসিকতা নিয়ে নির্বাচিত হতে হবে। তাই অতিসত্বর ভোটার লিস্ট আপডেট করে স্থানীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হোক। স্থানীয় নির্বাচনে জাতীয় নির্বাচনের পরীক্ষাও হয়ে যাবে। এলাকার চাঁদাবাজ, দখলবাজদের তালিকা করার জন্য ইউএনও, ওসি স্থানীয় সব দলের লোক এক হয়ে কমিটি করে দিলে চাঁদাবাজদের ধরা খুবই সহজ হবে। সর্বোপরি জেলার ডিসিরা যদি তত্ত্বাবধান করেন, তবে এক মাসের মধ্যেই চাঁদাবাজ শনাক্ত করে পদক্ষেপ নেয়া খুবই সহজ হবে। উল্লেখ থাকে যে, ইতোমধ্যেই লুকাল গভমেন্ট সংস্কার কমিটি প্রধান উপদেষ্টাকে তাদের সুচিন্তিত সুপারিশ দিয়েছে। এ সুপারিশের আলোকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দ্রুত দেয়া যেতে পারে।
ইতোমধ্যেই নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন তাদের কাজ এগিয়ে নিয়েছে। আশা করা যায়, তারা ভালো একটি নির্বাচন দিতে পারবে।
সরকারের সংস্কার কমিটিগুলোও দ্রুত এগোচ্ছে। সংস্কার ঠিকমতো করে নির্বাচনের রোডম্যাপ দিলে ভালো নির্বাচনের আশা করা যায়।
মনে রাখতে হবে, আগস্ট বিপ্লবের শহীদ ও আহতদের রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। তাদের রক্তের সাথে বেঈমানী করলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। এবার ঈদের সময় দেশে গিয়ে বেশ কয়েকজন শহীদের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তাদের আর্তনাদ একটাই, শহীদের হত্যার সাথে জড়িত লোকদের বিচার দ্রুত হতে হবে। আইন-আদালতের কাজ দ্রুত এগোতে হবে। যারা প্রকৃতভাবেই এ অন্যায় কাজে জড়িত ছিল, সরাসরি গুলি করেছে, আগুন দিয়ে লাশ পুড়িয়েছে। গুম-খুন, আয়নাঘরের নির্যাতনের সাথে জড়িত, তাদের খুঁজে বের করতে সময় লাগার কথা নয়। তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মাধ্যমেই আমরা তাদের সর্বোচ্চ সাজা চাই। অধিকাংশ দোষীরা পলাতক। অনেকে জেলখানায় আছে। আবার পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল, সেনা সদরে যে ৬২৬ জন খুনি আশ্রয় নিয়েছিল, তাদেরও খোঁজ নিতে হবে। আইনের আওতায় আনতেই হবে।
শেখ হাসিনা ও তাদের দোসরদের বিচারের তদন্তের কাজ প্রায় শেষ। আইনের মাধ্যমেই তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। কারণ তারা জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা, শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও নির্বাহী পরিষদের সদস্য শহীদ মীর কাসেম আলীর ফাঁসির জন্য এরা দায়ী। আর জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে শহীদ-আহতদের জন্য এরা সরাসরি জড়িত। যেহেতু বেশিদিনের কথা নয়, তাই সাক্ষীর কোনো অসুবিধা হবে না। দুঃখের বিষয়, এখনো আগস্ট বিপ্লবের প্রায় শতাধিক শহীদের লাশ শনাক্ত করা যায়নি। কিছু এখনো মেডিকেলের মর্গে পড়ে আছে। আবার কিছু লাশ শনাক্ত ছাড়াই কবর দিয়েছে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম।
এবার আসি নির্বাচনের বিষয়ে। অধিকাংশ দলই সংস্কার, বিচারের পর এবং প্রশাসনের লোকদের বদলির পরই নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিলে কারো আপত্তি থাকবে না। যারা দ্রুত নির্বাচন চায়, তারা ক্ষমতার মোহে শহীদ-আহতদের বিচার, সংস্কার সবই ভুলে যেতে শুরু করেছে। এ কাজ করতে দেয়া যাবে না। শহীদ ও আহতরা এগিয়ে না এলে আমরা মুক্ত অবস্থায় কথাও বলতে পারতাম না।
দেশে ও বিদেশের লোকেরা প্রত্যক্ষ করেছে স্বৈরাচার হাসিনা কীভাবে জনগণকে দুঃশাসনের জাঁতাকলে জুলুম করেছে। মানুষকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেছে। গুম করেছে। আয়নাঘরে বছরের পর বছর রেখে অমানবিক নির্যাতন করেছে। তার বিচার দ্রুত করেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের মানুষ এতে সাড়া দেবে। সমস্যার সমাধান হবে।
নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব থাকবে কোনো দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজরা যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারে। নির্বাচনের প্রার্থীদের আয়ের উৎস, অতীতের ইতিহাস, ছাত্রজীবনের ইতিহাস, ব্যবসার ইতিহাস, আগস্ট বিপ্লবে তাদের ভূমিকা কি ছিল সবই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মাঠে বর্তমানে জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি ও নতুন দল এনসিপি নির্বাচনের কথা বলছে। আমরা বর্তমান সরকার বেশিদিন থাকুক, চাই না। তবে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে এ সরকারের দেশ ও বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা অনেকটাই ফিরে পেয়েছে এবং সামনে এগোচ্ছে। কয়েকদিন পূর্বে ৫০টি দেশের বিনিয়োগ সম্মেলন হয়ে গেল। এতে খরচের বাজেট ছিল আড়াই কোটি টাকা। খরচ হয়েছে ১.৪৫ কোটি টাকা। চোরতন্ত্রের হাত না থাকার কারণে টাকার অপচয় হয়নি।
মুহাম্মদ ইউনূস সাহেব এরই মধ্যে কয়েকটি দেশ সফর করেছেন। তিনি তো সরকারের বহর নিয়ে যাননি। চোর-বাটপার এমনকি মোসাহেব সাংবাদিকরা সফরসঙ্গী হতে পারেনি। তাই আমরা দেশের টাকা অপচয় রোধ করতে চাই। বিদেশি বিনিয়োগ আসার সব পথ খুলে দিতে হবে। ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে মুসলিম দেশগুলোসহ চীনের বড় বিনিয়োগ আমরা আনতে পারব। ইতোমধ্যে চীন ৩টি হাসপাতাল করার প্রস্তাব দিয়েছে। জায়গাও দেখা হচ্ছে। আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা স্বাবলম্বী করার ব্যাপারে এ উদ্যোগ বড় কাজে দেবে। আমাদের আর চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে হবে না। বিদেশিরাই আমাদের দেশে আসবে চিকিৎসা নিতে।
আবার ফিরে আসি নির্বাচনের ব্যাপারে। জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী দলগুলো ও ছোট দলগুলো সংখ্যাভিত্তিক এমপি নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছে। খুবই ভালো প্রস্তাব। কারণ কোনো দল একক ক্ষমতায় গেলে স্বৈরাচার হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। তাই সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সংসদ একদিকে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে! অন্যদিকে ভালো লোক সংসদে এসে দেশের উন্নতি-অগ্রগতিতে সঠিক ভূমিকা রাখতে পারবে।
অন্যদিকে টাকার ছড়াছড়ি থেকে দেশ মুক্ত হবে। ভোট কেনাবেচার পরিবেশ পাবে না। দলগুলো নমিনেশন বাণিজ্য করতেও পারবে না। আমরা এ পদ্ধতিতে প্রত্যাবর্তনের জোর দাবি করছি। কয়েকদিন পূর্বে দীর্ঘদিনের পাওনা, দেনাসহ মুসলিম দেশে একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানের সাথে দ্বিপাক্ষিক সচিব পর্যায়ে বৈঠক হয়ে গেল। দুই দেশই তাদের মধ্যকার দূরত্ব কমাতে উদ্যোগী হয়েছে। ভালো কথা। মুহাম্মদ ইউনূস সাহেব হেভিওয়েট ব্যক্তি হওয়ার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। আমরা এর আরো উন্নতি কামনা করি।
সর্বশেষ বলতে চাই, এদেশ আমাদের সবার। তাই দেশের ভালোর জন্য আমরা কাজ করব। বিদেশিদের প্রেসক্রিপশনে আমরা চলব না। আমাদের চিন্তাশক্তি, মেধা কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশ আমরাই গড়ব। মহান আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন, ইনশাআল্লাহ।
প্রশাসনে বসে থাকা স্বৈরাচারের দোসরদের অনতিবিলম্বে সরিয়ে সৎ, যোগ্য লোক বসিয়ে সংস্কারের যতটুকু করা সম্ভব আর বিচারের কাজ দ্রুত যথাযথভাবে শেষ করার তাগিদ দিয়ে নির্বাচনের দিকে এগোতে হবে। আমরাই পারব, ইনশাআল্লাহ। যারা ৫ আগস্ট ঘটাতে সক্ষম হয়েছে মহান আল্লাহর সরাসরি সাহায্যে, তারাই পারবে সৎ, যোগ্য, দুর্নীতিমুক্ত লোকের সংসদ নির্বাচন করে দেশ ও দেশের মানুষের ত্যাগ ও কুরবানি স্মরণ করে একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী দেশ উপহার দিতে। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন। জনগণের বিজয় সুনিশ্চিত।
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।