পতিত স্বৈরাচারী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করছে


২৪ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:৪৮

॥ এডভোকেট সাবিকুন্নাহার মুন্নী ॥

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্যরা কি এদেশের অধিকাংশ নারী সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন? প্রস্তাবিত সংস্কার প্রস্তাব দেখে মনে হয়, তারা বাংলাদেশে নয়, পৃথিবী ছাড়িয়ে মঙ্গল গ্রহে বসে এ সংস্কার প্রস্তাবনা তৈরি করেছেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, এ কমিশনে সদস্য হিসেবে যারা আছেন, তারা প্রায় সবাই সেক্যুলারপন্থী নারী। যারা এদেশের অধিকাংশ নারী সমাজের চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করেন না, ধর্মীয় বিধিবিধান পালন ও লালন করেন না। এককভাবে শুধুমাত্র তাদের দ্বারা কি করে একটি সর্বজনীন, গ্রহণযোগ্য নারীবান্ধব ও নারী ক্ষমতায়নের ভারসাম্যমূলক সংস্কার প্রস্তাব পেশ করা সম্ভব? আমাদের দেশের নারীদের ৫% এরও কমসংখ্যকের প্রতিনিধিত্ব করেন এসব নারী।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে সংস্কারের উদ্দেশ্যে গঠিত ১০ সদস্য বিশিষ্ট নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে, তাদের দ্বারা প্রস্তাবিত প্রায় সাড়ে ৪শ’ সুপারিশ যেন পতিত স্বৈরাচারের দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিনিধিত্ব করছে। এসব প্রস্তাবনার অধিকাংশ ফ্যাসিবাদের আমলে গৃহীত নারীনীতির ইসলামবিদ্বেষী সুরের পুনঃপ্রতিধ্বনি মাত্র।
এ প্রস্তাবনায় মুসলিম উত্তরাধিকার আইন বাতিলসহ সকল ধর্মমতের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইনপ্রণয়ন, ধর্মীয় কৃষ্টি-কালচারবিরোধী জাতিসংঘ প্রণীত সিডো (ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ঃযব ঊষরসরহধঃরড়হ ড়ভ ধষষ ভড়ৎসং ড়ভ উরংপৎরসরহধঃরড়হ অমধরহংঃ ডড়সবহ. সংক্ষেপে ঈঊউঅড) সনদের বিতর্কিত ধারার আলোকে বিভিন্ন আইন বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। যেখানে পতিত স্বৈরাচার সরকার পর্যন্ত জাতিসংঘের নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডোর গুরুত্বপূর্ণ দুটি ধারা (২ ও ১৬.১.গ) থেকে আপত্তি তোলেনি, সেখানে নতুন বাংলাদেশে এসে আবারও সেই ধারার আলোকে আইনের প্রস্তাব দিয়ে স্মরণ করিয়ে দেয়- নতুন বোতলে পুরোনো মদের আমদানির কথা।
পূর্বে ফ্যাসিবাদী সরকার সিডো কমিটিকে জানিয়েছিল, ‘যেখানে দেশের ৯২ শতাংশ মানুষ মুসলমান। এদেশের প্রায় সকল মানুষের ধর্মীয় অনুশাসন মেনে তালাক ও সম্পত্তি বণ্টিত হয়, সেখানে শুধু বর্তমানেই নয়, ভবিষ্যতেও সরকারের পক্ষে এ দুটি ধারার ব্যাপারে আপত্তি তুলে নেওয়া সম্ভব হবে না।’
উল্লেখ্য, জাতিসংঘ ১৯৭৯ সালে সিডো সনদ বা দলিলটি গ্রহণ করে। ১৯৮১ সাল থেকে তা কার্যকর হয়। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সনদটি অনুসমর্থন করে। তবে কুরআন ও সুন্নাহবিরোধী বলে বাংলাদেশ সরকার দুটি ধারায় আপত্তি দিয়েছিল, যা এখনো বহাল আছে।
অথচ দেশের বিগত সকল সরকারের আমলে গণমানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টের কথা চিন্তা করে একবাক্যে যে ধারাগুলোকে প্রত্যাহার করেছিল, তার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে এসব অবাস্তব প্রস্তাবনা সুপারিশ করা হয়েছে, যা গৃহীত হলে শুধু ইসলাম নয়, সকল ধর্মের ধর্মীয় আইনের বিরুদ্ধে গিয়েও দাঁড়াবে। প্রস্তাবনায় ধর্মকে সরাসরি বৈষম্যের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনে ‘মুসলিম উত্তরাধিকার ও পারিবারিক’ আইনসহ সংবেদনশীল ইস্যুতে বিতর্কিত বেশকিছু প্রস্তাবনা রয়েছে, যা পবিত্র কুরআনের বিধানের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক এবং ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের অস্তিত্বের ওপর একটি সুপরিকল্পিত আঘাত।
আমার মনে হয়, নারীবিষয়ক সংস্কারের নামে এ ধরনের প্রস্তাবনা সরকারকে নতুন করে বিপদে ফেলার একটি সূক্ষ্ম পাঁয়তারা করা হয়েছে, যাতে করে জনগণের সেন্টিমেন্টের বাইরে গিয়ে সরকার জনসমর্থনহীন হয়ে পড়ে এবং এ প্রস্তাবনার বিরোধিতায় নতুন ইস্যু খুঁজে পায় এবং সেটাকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় সংগঠনগুলো মাঠে নেমে পড়ে। দেশে একটা অসহিষ্ণু পরিবেশ সৃষ্টির গভীর ষড়যন্ত্রেরই একটা অংশ এ গণবিরোধী নারীবিষয়ক সংস্কার প্রস্তাবনা। ফ্যাসিবাদের আমলেও উদ্যোগ নেয়া এ ধরনের গণবিরোধী পদক্ষেপ গণধিকৃত হয়েছে। ধর্মীয় আইনের বিরুদ্ধে ও সেক্যুলার আইনকে প্রাধান্য দিয়ে যেকোনো ধরনের পলিসির অপচেষ্টাকে দেশের মানুষ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে, ইনশাআল্লাহ।
আমরা আশা করবো, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণমানুষের সেন্টিমেন্টবিরোধী এ সংস্কার প্রস্তাবনা বাতিল করে গণআকাক্সক্ষার সাথে সংগতিপূর্ণ ও জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সদস্যদের নিয়ে কমিশন পুনর্গঠন করে এ দেশের অধিকাংশ মানুষের মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে নারীবান্ধব তথা ভারসাম্যমূলক সমাজবান্ধব সংস্কার প্রস্তাবনা গ্রহণ করবেন।