শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষা সংস্কার


১৭ এপ্রিল ২০২৫ ১৪:৫৫

॥ প্রিন্সিপাল সাব্বির উদ্দিন আহমেদ ॥
অধ্যাপক সি আর আবরার সম্প্রতি উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। তাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এতদিন বয়োবৃদ্ধ অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ পরিকল্পনাসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ দুটি দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। এখন তিনি কিছুটা ভারমুক্ত হলেন। এমনই তার বয়স অনেক বেশি আবার দুটি দায়িত্ব পালন করা খুবই কঠিনই বটে। সেজন্য তিনি শিক্ষা বিষয়ে তেমন কোনো যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে পারেননি। উপরন্তু তিনি বর্তমান শিক্ষাবর্ষে এখনো পর্যন্ত বই ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছাতে পারেননি। তারপর শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার সময়ে কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যা সত্যিকারভাবে শিক্ষাকে জঞ্জালমুক্ত করে জাতিকে একটি যুগোপযোগী ও সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা উপহার দেয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায়ই বলতে হবে। একটি শিক্ষা সংস্কার কমিশন করা যায়নি। এতে সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টাকে দায়ভার নিতে হবে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার শিক্ষাকে পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত ছিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করে জাতিকে একটি যুগোপযোগী ও সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা উপহার দেয়া। কিন্তু বর্তমান সরকার তা দিতে এখন পর্যন্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
নতুন শিক্ষা উপদেষ্টা জাতির আশা-আকাক্সক্ষা তথা একটি নৈতিকতাসম্পন্ন যুগোপযোগী আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা উপহার দিতে সক্ষম হবেন। সেজন্য একটি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করা এ মুহূর্তে খুবই জরুরি ও সময়ের দাবি। জাতির দাবি, মূলত এ শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকতার সাথে নৈতিকতার সম্মিলন ঘটাতে হবে। তার সাথে একটি প্র্যাকটিকাল শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এর ফলে এ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে জাতি একদিকে ভালো মানুষ পাবে; অন্যদিকে পাশাপাশি দক্ষ ও যোগ্য জনশক্তি তৈরি হয়ে উঠবে। ফলে আগামী দিনগুলোয় মেধাবী, যোগ্য ও নৈতিকভাবে উন্নত ব্যক্তিরাই দেশ শাসন করবে। স্বাভাবিকভাবে দেশ একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। জাতি এমন একটি দেশ কামনা করে। সুতরাং যোগ্য, নির্মোহ, দেশপ্রেমিক ও নৈতিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বদের নিয়ে একটি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করা উচিত। বাংলাদেশ টেক্সট বুক বোর্ডকে এ ধরনের লোকদের নিয়ে ঢেলে সাজাতে হবে। তাহলে আমরা ভালো কিছু আশা করতে পারি। নচেৎ আমরা যে তিমিরে সেই তিমিরে রয়েই যাবো। আমাদের দেশ ও জাতির কোনো গুণগত ও মানগত উন্নয়ন হবে না।
আমরা যারা শিক্ষক বা শিক্ষাবিদ আছি, আমরা দীর্ঘ বছর ধরে শিক্ষাকার্যক্রমের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছি, আমাদের থেকে ও তিনি শিক্ষা বিষয়ক গঠনমূলক সাজেশন নিতে পারেন, যা সমন্বিত ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নে বিরাট ভূমিকা রাখবে।
এককথায় সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষা উপদেষ্টা থেকে শিক্ষা সংস্কার কমিশনসহ দেশের আপামর জনগণের বিশ্বাস ও চিন্তাভাবনার ভিত্তিতে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ জাতি প্রত্যাশা করছে।
কে অধ্যাপক সি আর আবরার? : অধ্যাপক সি আর আবরার ব্যাপারে যতটুকু জানতে পারি, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি বর্তমানে মূলত শরণার্থী, অভিবাসন ও মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত। তার গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নাম হচ্ছে- Refugee And Migratory Movements Research Unit. তিনি এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সমন্বয়ক।
যেহেতু তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন, সেহেতু তিনি একজন শিক্ষাবিদও বটে। কিন্তু একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে তার এ বিষয়ে যে বিস্তর গবেষণা থাকা দরকার ছিল এ সম্পর্কে আমাদের কাছে জানা নেই।
কিন্তু তিনি ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন। এ প্রতিবেদনে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসংগতি তুলে ধরেন এবং শিক্ষাপ্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় তীব্র সমন্বয়ের অভাবের কথা বলেন। তিনি এ প্রতিবেদনে শিক্ষা সংস্কার সম্পর্কে কথা বলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে ব্যাপকভাবে গবেষণা করা প্রয়োজন, তিনি হয়তো সে ব্যাপারে করতে পারেননি।
তার জন্ম ১৯৫২ সালে ফরিদপুরে। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ভর্তি হন ১৯৭২ সালে। তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুনরায় গ্র্যাজুয়েশন ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করেন। তিনি অস্ট্রেলিয়ার একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এই হলো অধ্যাপক সি আর আবরারের সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
নতুন শিক্ষা উপদেষ্টা থেকে জাতির প্রত্যাশা
একজন শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে কতটুকু শিক্ষার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারবেন সেটা এখন দেখার বিষয়। তিনি ৭৩ বছর বয়সী বয়স্ক একজন গুণী মানুষ। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য তাকে যথেষ্ট সাহসিকতা, পরিশ্রমপ্রিয়তা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা দেখাতে হবে। জাতি গত ৫৪ বছরে কোনো সত্যিকারভাবে একটি সমন্বিত, যুগোপযোগী ও নৈতিকতাসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা পায়নি। শিক্ষকদের মর্যাদাসংবলিত একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা আজও তৈরি হয়নি। মেধাবী ও নৈতিকতাসম্পন্ন লোকজন শিক্ষকতা পেশায় আসতে অনিচ্ছুক। কেননা এক্ষেত্রে জীবনের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, নেই কোনো রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান ও মর্যাদা। প্রতিটি সরকারই এ ব্যাপারে চরম অবহেলা দেখিয়েছে। এর ফলে ভালোমানের ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষায় কমই আকৃষ্ট হচ্ছেন। এককথায় বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে জাতি গড়ার ক্ষেত্রে আমরা খুবই পিছিয়ে আছি। এর ফলে জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে করুণ চিত্র আজ বিরাজমান। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে ও আমাদের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য জুলাই-আগস্ট বিপ্লব করতে হয়েছে।
আজ সময় এসেছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের। আমরা সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরারকে অভিনন্দন জানাই। আমাদের বিশ্বাস, নতুন শিক্ষা উপদেষ্টা দ্রুত একটি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করে একদল নির্মোহ, নিরপেক্ষ ও প্রকৃত শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের দ্বারা একটি সমন্বিত, যুগোপযোগী ও নৈতিকতাসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করবেন এবং সেই সাথে শিক্ষাপ্রশাসন ও ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করবেন।
শিক্ষকদের মর্যাদা ও জীবনমান উন্নয়ন বর্তমানে মূল দাবি
শিক্ষকদের মর্যাদা ও তাদের জীবনমান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নতি করবেন। একটি কথা আমাদের সবাইকে মনে রাখা উচিত যে মেধাবী ও অত্যন্ত হাইপ্রোফাইল ডিগ্রিধারীগণ ভালো শিক্ষক হবেন এটা সঠিক নয়। শিক্ষা এমন একটা জিনিস, যা শুধুমাত্র মেধাবী বা উচ্চ ডিগ্রিধারী হলেই হবে না। শিক্ষাদানকে জীবনের সাথে মিশিয়ে ফেলে তারপর তাকে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদানে ব্রতী হতে হবে, তাহলে প্রকৃত শিক্ষাদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। সুতরাং একজন কম ক্যালিবারসম্পন্ন ব্যক্তি ও ছাত্রছাত্রীদের কাছে ভালো শিক্ষক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। শিক্ষার এথিক্সের সাথে যার সম্মিলন হবে সেই ভালো ও জণপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে বিবেচিত হন। এখানে উচ্চডিগ্রি বা হাইপ্রোফাইল ডিগ্রিধারী আবশ্যক নাও হতে পারে। কাজেই আমরা তার থেকে এ ব্যাপারে বাস্তবভিত্তিক ও যুগান্তকারী উদ্যোগ আশা করি।
সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বিদায়বেলায় বেসরকারি শিক্ষকদের জন্যে বিভিন্ন ভাতা দেয়ার কথা বলে গেছেন। তা আগামী ঈদুল আজহা থেকে কার্যকরের কথা আমাদেরকে জানিয়েছেন। এটি সত্যি একটি শুভ সংবাদ। সেজন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে উনাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। উনি শেষের দিকে শিক্ষকদের কষ্ট কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছেন।
আসলে এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে শিক্ষকদের রাষ্ট্র কর্তৃক যথাযথ সম্মান ও মর্যাদার আসনে বসাতে না পারলে সত্যিকারার্থে জাতি গড়ার কাজটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়, যা গত ৫৪ বছরে সম্ভব হয়নি।
একটি জাতিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে পৃথিবীর শীর্ষস্থানে সমাসীন করতে হলে অবশ্যই শিক্ষা ও শিক্ষকদের সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ কাজটি মূলত রাষ্ট্রকেই করতে হবে। রাষ্ট্র নিরূপণ করবে শিক্ষার জন্যে কত পরিমাণ বাজেট থেকে বরাদ্ধ রাখলে শিক্ষা, গবেষণা ও শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়াদি সুসম্পন্ন করা যাবে।
তাছাড়া শিক্ষকদের মর্যাদা কতটা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করলে শিক্ষকরা জাতি গড়ার কাজে তাদের মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা সবকিছু ছাত্রছাত্রীদের সুমানুষ তথা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আত্মনিয়োগ করতে পারবেন। আগামী প্রজন্মকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে নেতৃত্ব দেয়ার উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকবৃন্দ পুরোপুরিভাবে নিজেদের নিয়োজিত করতে সক্ষম হবেন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সরকার বিশেষভাবে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করবেন এবং সে আলোকে পরবর্তী কর্মকৌশল তৈরি করবেন।
একটি কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে যে আমরা যতই সংস্কারের কথা বলি না কেন, তা কখনোই সম্ভব হবে না, যতক্ষণ না শিক্ষায় আমূল পরিবর্তন ঘটানো না হয়। শিক্ষাব্যবস্থা তথা শিক্ষাপ্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার আমূল পরিবর্তন ছাড়া রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক সিস্টেম তথা অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো মোটেই সম্ভব নয়।
বিশ্বে উন্নত দেশগুলোর শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার
আমরা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখব তারা প্রথমে যে কাজকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল, তা হচ্ছে শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষকদের রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আসীন করা। এই ক্ষেত্রে আমেরিকা, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চীন, হংকং, যুক্তরাজ্য, সুইডেন এবং অতি সম্প্রতি মালয়শিয়া ও তুরস্ক অন্যতম। তারা শিক্ষার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করছে এবং শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা রাষ্ট্রের উচ্চ স্থানে স্থাপন করেছে। তাই সেই দেশগুলো আজ উন্নতি ও অগ্রগতির শীর্ষে গিয়ে পৌঁছেছে।
উল্লেখ্য, ফিনল্যান্ড তাদের গোটা বাজেটের শতকরা ৭-৮ ভাগ অর্থ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ রাখে। অথচ আমাদের বাজেটে তা শতকরা ১ ভাগ ও বরাদ্দ রাখা হয় না। তারপর বল্গাহীন দুর্নীতি, যা শিক্ষাকে আজ তলানিতে নিয়ে গেছে।
বর্তমানে আমাদেরকে এ বিষয়টি বেশি বেশি ফোকাস করতে হবে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং বিষয়গুলোর মধ্যে শিক্ষাটা সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার খাত হওয়া উচিত।
নতুন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার এ বিষয়টি সরকারের সামনে ফোকাস করবেন এবং একটি বাস্তবভিত্তিক ও কার্যকর কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। কেননা রাষ্ট্রকে সকল জঞ্জাল থেকে মুক্ত করতে হলে সর্বাঙ্গে হাত দিতে হবে শিক্ষা খাতে। এখানে নিঃসন্দেহে আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
শিক্ষকদের জন্যে একটি সম্পূর্ণ আলাদা নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। একটি আধুনিক, যুগোপযোগী ও নৈতিকতাসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থাপনা তৈরি করতে হবে। সেজন্য এ মুহূর্তে একটি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন খুবই জুরুরি। এ কমিশনে একদল নির্মোহ, নিরপেক্ষ, দেশপ্রেমিক, যোগ্য, দক্ষ, পরিশ্রমী ও নৈতিকতা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞবৃন্দকে স্থান দেওয়া উচিত। তারা জাতির ৫৪ বছরব্যাপী স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেয়ার লক্ষ্যে একটি উপরোল্লিখিত শিক্ষাব্যবস্থা জাতিকে উপহার দিবে। এটাই আমার নতুন শিক্ষা উপদেষ্টার নিকট প্রত্যাশা।
শিক্ষার সংস্কার সর্বাগ্রে কেন?
শিক্ষার সংস্কার সবার আগে হওয়া উচিত কারণ আফ্রিকার অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে একটি স্মরণীয় উক্তি অঙ্কিত আছে। স্মরণীয় উক্তিটি হচ্ছে এই রকম-
‘The destroying of a nation does not require the use of atomic bombs or the use of long range missiles. It only requires lowering the quality of education and allowing in the examinations by the students. The result is that the patients die at the hands of the doctors. The building collapses at the hands of the engineers. Money is lost at the hands of the economists and accountants. Humanity dies at the hands of the scholars. Justice is lost at the hands of the judges. Because the collapse of education is the collapse of a nation.’
(Main entrance of Ahmadu Bello University (ABU), Zaria, Nigeria)|।
এ স্মরণীয় উক্তিটি একটি সমন্বিত শিক্ষার অতীব গুরুত্ব ও সর্বোচ্চ মান নিশ্চিতকরণের ওপর অত্যন্ত জোরালোভাবে গুরুত্বারোপ করে। কেননা একটি জাতির শিক্ষাব্যবস্থার অবনতির অর্থ এর পতনকে যেমন বোঝায়, ঠিক তেমনি পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একটি জাতিকে ধ্বংস করে দেয়াকে বোঝায়।
অর্থাৎ পারমাণবিক বোমা একটি জাতিকে পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করতে পারে না। এটি একটি দেশের একটি বা দুটি অঞ্চল বা এলাকা ধ্বংস করে দিতে পারে। কিন্তু পুরো দেশ বা জাতিকে ধ্বংস করতে পারে না। কিন্তু একটি দেশের শিক্ষার পতন মানে পুরো দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করে ফেলা। তাহলে আমরা বুঝতে পারি যে শিক্ষার পতন বা ধ্বংস সে দেশ ও জাতিকে পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করে দেয়াকে বোঝায়।
কোনো দেশ বা জাতিকে চিরতরে পশ্চাৎপদ করে রাখার সর্বোত্তম উপায় হলো সেই দেশের জনগণকে প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে রাখা। শিক্ষাকে বহুধাবিভক্ত করে সেই জাতিকে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা দিলে সে জাতির মাঝে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেতনা এবং সর্বোপরি দেশপ্রেমের চেতনা কোনোভাবেই সৃষ্টি হবে না।
তার মানে তাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করে দিয়ে সেই দেশকে আরেকটি আগ্রাসী শক্তির গোলামি নিগড়ে আবদ্ধ করে ফেলা হয়। সেই জাতিকে অন্ধকার যুগে ঠেলে দেয়া হয়।
আজকে যারা পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তারা প্রথমে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল এবং এখনো দিয়ে যাচ্ছে বলে আজ তারা বিশ্ব নেতৃত্বে সমাসীন আছে। অন্যরা তাদের ধারের কাছে যেতে সক্ষম হচ্ছে না শুধু তাদের উন্নত শিক্ষা, ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা ও যুগোপযোগী ও বাস্তবভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থাপনার কারণে।
নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে পয়লা অগ্রাধিকার শিক্ষা
সুতরাং আজকে আমরা নতুন বাংলাদেশের স্লোগান দিচ্ছি ঐতিহাসিক জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর। কিন্তু আমরা সরকারের কেউ শিক্ষাকে নিয়ে তেমন সিরিয়াসলি ভাবছি না এই চিন্তা করে যে, যদি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করে বর্তমান শিক্ষাকে আমূল পরিবর্তন ঘটানোর উদ্যোগ নেয়া হয়, তাহলে কোনো মহল নাখোশ হতে পারে। সেজন্য হয়তো আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষাকে নিয়ে তেমন খুব বেশি মাথা ঘামাচ্ছে না।
কিন্তু আমরা যদি ঐতিহাসিক জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সুফল বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে চাই এবং শহীদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে চাই, তাহলে শিক্ষাকে সর্বাগ্রে সংস্কার করতে হবে। কেননা শিক্ষা সংস্কার ছাড়া অন্যান্য সংস্কারের কার্যকারিতা তেমন নেই বললে চলে। সোজাসাপ্টা কথা হলো যে, শিক্ষা সংস্কার ছাড়া অন্যান্য সংস্কার অর্থহীন বললে বেশি বলা হবে না।
ড. ইউনূসের ‘তিন শূন্যের পৃথিবীর দৃষ্টি’তে শিক্ষা
শান্তিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিঃসন্দেহে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। বিশ্বে জীবিত যে কয়জন লিজেন্ড আছে, যাদের বিশ্ববাসী শ্রদ্ধা করে তাদের মধ্যে ড. ইউনূস সর্বাগ্রে বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তার একটি বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ‘তিন শূন্যের পৃথিবী’ (A world of three zeros)। এই গ্রন্থে তিনি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে নিছক চাকরিকেন্দ্রিক বলে কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি এক্ষেত্রে তার অভিমত পেশ করেন, ‘Young people should not be trained to be mere jobseekers; rather, they should be equipped with the knowledge and confidence to create jobs.’
শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘We need an education system that nurtures creativity, encourages critical thinking, and instils social responsibility in students.’
শিক্ষাকে একটি শক্তিশালী অস্ত্র বলে অভিহিত করে তিনি বলেন, ‘Education should not be limited to preparing students for existing jobs; it should inspire them to be entrepreneurs, problem solvers and change-makers.’
নৈতিকতার উন্নয়নের কথা বলেছেন। শিক্ষায় সততা, নৈতিকতা, দেশপ্রেমের উজ্জীবনের কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে তিনি বলেন, ‘Education should not only teach us how to make a living but also how to live with purpose, integrity and compassion.’
তিনি এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘Ethical values must be at the heart of every institution whether it’s education business, or government so that we can create a just and sustainable future.’
তিনি আরো যোগ করেন, ‘The real power of education lies in producing job seekers but in shaping individuals who are morally responsible conscious.’
ছাত্রছাত্রীরা শুধুমাত্র চাকরির পিছনে না দৌড়িয়ে নিজেকে উদ্যোক্তা (Entrepreneurs) হিসেবে গড়ে তোলার কথা তিনি বলেছেন। তার মতে ছাত্রছাত্রীকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতির পাশাপাশি তাকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে বিশ্বে শান্তি ও কল্যাণ স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। মুখস্থনির্ভর শিক্ষার পরিবর্তে ব্যবহারিক শিক্ষা আধুনিক ও নৈতিকতার সাথে যুক্ত করা হলে সত্যিকারভাবে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষা লাভ করতে সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে তিনি সামাজিক ব্যবসা বিষয় শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত করার পক্ষে জোর দেন। তিনি বলেন, ‘Educational institutions should integrate social business concepts into their curriculum so that students understand how business can be a force for good.’
তিনি এক্ষেত্রে প্রযুক্তিনির্ভর সমন্বিত শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে বলেন, ‘By utilizing technology we can make quality education accessible to even the most marginalized communities, breaking the cycle of poverty.’
শুধুমাত্র কর্মমুখী শিক্ষাই যথেষ্ট নয় এর সাথে নৈতিক শিক্ষার সম্মিলন ঘটাতে হবে। তবেই কোমলমতি শিশুরা একজন যোগ্য, নৈতিকতাসম্পন্ন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।
ড. ইউনূসের বক্তব্য বিশ্ববাসীর কাছে সুস্পষ্ট ও স্বচ্ছ। তিনি সত্যিকার শিক্ষাদানের মাধ্যমে তিন শূন্যকে বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করতে চান। তিনি মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর ও স্বচালিত করতে চান। গোলামির দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে আগামী প্রজন্মকে দেশ ও জাতিকে বিশ্ব শাসনে প্রতিষ্ঠা করতে চান।
ড. ইউনূস শিক্ষা নিয়ে যে চমকপ্রদ বক্তব্য দিয়েছেন তার বাস্তবায়ন আমরা দেখতে চাই। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ড. ইউনূসের শিক্ষা বিষয়ক সরণীয় মতামত (ড়নংবৎাধঃরড়হ) দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত। সেজন্য শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করা সময়োচিত পদক্ষেপ হবে বলে আমরা মনে করি।
এক্ষেত্রে ড. ইউনূস নিজেই উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেন। ড. ইউনূস তার বিশ্ববিখ্যাত বই ‘তিন শূন্যের পৃথিবী’তে শিক্ষা সংস্কার নিয়ে কথা বলেছেন। অথচ দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা খুবই শোচনীয় বলা যায়। আর অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা নাই বললাম।
উপসংহার : উপসংহারে আমরা স্বয়ং ড. ইউনূস সাহেবের কাছ থেকে শিক্ষা ও শিক্ষা প্রশাসন বিষয়কে কেন্দ্র করে আমূল পরিবর্তন ঘটানোর লক্ষ্যে একটি দ্রুত পদক্ষেপ আশা করছি। এ ব্যাপারে অনতিবিলম্বে একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা জাতি এ মুহূর্তে আশা করছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক।