আমার পড়া বই

গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাত দশক : ইসলামপন্থী দলগুলোর ভূমিকা (১৯৫৪-২০২৪)


১৭ এপ্রিল ২০২৫ ১৪:৪৭

॥ শাহাদাৎ সরকার ॥
বাংলাদেশের ইতিহাসে নানাভাবে ইসলামপন্থীদের নাই করে দেয়ার প্রচেষ্টা দৃশ্যমান। এমনকি ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের ভূমিকাও মুছে ফেলতে তৎপর একশ্রেণির কলমজীবী। এতো নিকটতম বিপ্লবী ঘটনাকে যখন এদেশের সুশীল প্রগতিশীল নামধারীরা অস্বীকার করার নানা পাঁয়তারা করছে; তখন আমাদের মনের গহিনে প্রশ্ন উদিত হয় কিছু দূরের ইতিহাসের অবস্থা কতটা ভয়াবহতা! তা এ সময়ের সুশীলদের ইতিহাস বয়ানের ধারা থেকে অনুমান করা যায়। এমনকি ইতিহাস ছিনতাইয়ের ঘটনাও দেখা যায়। ইতিহাসের সেই নাই করে দেয়া তথ্যগুলো নিয়ে রচিত সরদার আবদুর রহমানের ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাত দশক: ইসলামপন্থী দলগুলোর ভূমিকা (১৯৫৪-২০২৪)’ শীর্ষক বইটি।
ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায় যে, ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ইসলামপন্থীদের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। কিন্তু ইতিহাস বিকৃতির কারণে সেই ইতিহাস বিপরীত স্রোতে ধাবিত হয়। এজন্য দায়ী মহলটি ‘দোষারোপ করার’ নীতি গ্রহণ করে। তারা অন্যের কৃতিত্ব চুরি করে নিজেদের ভাণ্ডার পূর্ণ করার কৌশল গ্রহণ করে। কিন্তু এ কৌশল খুব বেশিদিন টেকসই হয়নি। বাংলাদেশের দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এ কথাটা বেশি সত্য।
নতুন প্রজন্মের কাছে যে ইতিহাস আড়াল করে রাখার প্রচেষ্টা চলে তার একটা বড় অংশজুড়ে আছে দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ইসলামপন্থীদের অবদান। তাদের এ অবদান ও ভূমিকাকে সবসময় কালো পর্দায় ঢেকে একটা ‘ভয়ঙ্কর’ রূপ সামনে আনার তৎপরতা চলে।
ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম-লড়াইয়েও ইসলামপন্থীদের নেতৃত্বে দেখা গেছে। পাকিস্তানি শাসনামলে মানুষের অধিকার আদায় ও পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে দেখা গেছে সম্মুখসারিতে। স্বাধীন বাংলাদেশেও ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো এবং জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলো জোটবদ্ধভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলন করেছে।
বিপুল আদর্শিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ইসলামী রাজনৈতিক দলসমূহ কখনোই পিছপা হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশেও একদলীয় শাসনব্যবস্থার কবল থেকে বহুদলীয় ব্যবস্থায় উত্তরণ, স্বৈরাচারবিরোধী দীর্ঘ গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে, কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রভৃতি ক্ষেত্রে ইসলামপন্থী দল ও নেতৃবৃন্দকে নীতিনির্ধারণী এবং রাজপথের সংগ্রামেও রেখেছে অবদান। এর মধ্যে সর্বাধিক সংগঠিত ও অগ্রবর্তী ভূমিকায় ছিল জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু ইতিহাস থেকে ইসলামপন্থীদের নাম মুছে ফেলে তাকে অন্য বিশেষণে পরিচিত করার প্রক্রিয়া চলেছে। লেখক এ গ্রন্থে দীর্ঘ ইতিহাসের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
বাংলাদেশ বিভিন্ন পর্যায়ে মোটাদাগে তিন প্রকার রাজনীতি দেখা যায় বলে মনে করেন লেখক সরদার আবদুর রহমান। এর একটি হলো গণতান্ত্রিক ধারা, দ্বিতীয়টি স্বৈরশাসনের ধারা এবং তৃতীয়টি সন্ত্রাসের ধারা। কিন্তু শেষোক্ত দুটি ধারা সাধারণ মানুষের দ্বারা বরাবর প্রত্যাখ্যাত হয়ে এসেছে। মাত্রার কমবেশি হওয়া সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক ধারাকেই মানুষ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছে এবং এর স্থিতিশীলতার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে এসেছে।
এ ধারাটির সঙ্গে ইসলামপন্থী বলে বিবেচিত রাজনৈতিক দলগুলোর বরাবর সম্পৃক্ততা লক্ষ করা গেছে। রাজপথের আন্দোলন-কর্মসূচি, বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনসমূহে অংশগ্রহণ, সংসদ তথা পার্লামেন্টে ভূমিকা রাখা প্রভৃতিতে বিপুল মাত্রায় সক্রিয় থাকতে দেখা যায়। এগুলোই গণতান্ত্রিক রাজনীতির অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের ইসলামপন্থী রাজনীতির ইতিহাস ও খতিয়ান এবং এর সাফল্য-ব্যর্থতা ও ঐতিহ্যের পরিসর খুব স্বল্প নয়। এর বহুমুখী ও দীর্ঘ ধারার যে কোনো দিক নিয়েই বিস্তর গবেষণা হতে পারে। আর এ সুদীর্ঘ ইতিহাসের ধারায় রয়েছে একাধারে ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধ, একদলীয় শাসন থেকে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ইত্যাদি ঘটনা। আন্দোলন-সংগ্রামে সমৃদ্ধ ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সালের সময়কালটি ইসলামপন্থী রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু লেখক লক্ষ করেন ‘আলোচ্য সময়ে প্রাক-বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ-পরবর্তী সময়কালে ইসলামপন্থী অনেকগুলো সংগঠনের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তাদের কর্মতৎপরতার লিখিত পূর্ণাঙ্গ বিবরণ নেই। এসব সংগঠনের উত্থান-পতনের ওপর তত্ত্বগত বেশকিছু গবেষণা হয়েছে বটে, কিন্তু মাঠপর্যায়ে কর্মতৎপরতা, আন্দোলন-কর্মসূচি, নির্বাচনী কর্মকাণ্ড, সংসদীয় ভূমিকা প্রভৃতি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই-সংগ্রামের ওপর প্রামাণ্য তথ্য একত্রিত করা হয়নি। আর দীর্ঘ পাঁচ দশকের বিচ্ছিন্ন ও খণ্ডিত চিত্র উঠে এলেও একটি অখণ্ড চিত্র আমাদের সামনে নেই। এ রাজনীতির কৃতিত্ব ও ব্যর্থতাসহ সামগ্রিক কর্মকাণ্ড নিয়ে কিছু গবেষণার সন্ধান পাওয়া যায় বটে, তবে অখণ্ড ও একত্রিত কর্মতৎপরতার ওপর তেমন পূর্ণাঙ্গ কোনো গবেষণাকর্ম এখনো সম্পন্ন হতে দেখা যায়নি।
জনগণের দাবি আদায় ও অধিকার এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ইসলামপন্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও সে ইতিহাস এখন বহুলাংশেই অজ্ঞাত।’
এ ধারা নিয়ে গবেষকরা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এ কাজে এগিয়ে আসেননি। আর এ কারণেই ইসলামপন্থীদের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ওপর গবেষণা কর্মের শূন্যতা যথেষ্ট। এ শূন্যতা পূরণ করার লক্ষ্যে লেখক গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সাত দশক : ইসলামপন্থী দলগুলোর ভূমিকা (১৯৫৪-২০২৪)’ রচনার চেষ্টা করেছেন। আমাদের বিশ্বাস, অনুসন্ধিৎসু পাঠকের চাহিদা পূরণে সার্থক হবে এ কিতাব।
একনজরে গ্রন্থ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাত দশক:
ইসলামপন্থী দলগুলোর ভূমিকা
সরদার আবদুর রহমান
প্রচ্ছদ : সেলিম হোসেন সাজু
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২৫
প্রকাশক : ঐতিহ্য
মূল্য : ৮৫০ টাকা।