তালেবানদের বিজয় : আফগানিস্তানে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা
১৭ এপ্রিল ২০২৫ ১৪:৩৫
॥ নূরুল আনাম (মিঠু) ॥
বিগত ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে আফগানিস্তানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে। আপাতদৃষ্টিতে সেখানে মার্কিনপন্থি সরকার উৎখাত হয়ে তালেবান নামক দলের শাসন কায়েম হয়েছে, যা আজো অব্যাহত। এখানে আমি আপাতদৃষ্টিতে শব্দটা ব্যবহার করছি। বাহ্যিকভাবে স্থূল দৃষ্টিতে দেখলে আফগানিস্তানে চার বছর আগে সংঘটিত ঘটনাটাকে হয়তো মনে হতে পারে সেখানে নিছকই মার্কিনপন্থি সরকারের স্থলে তালেবানপন্থি সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিক (নিকট অতীতের) প্রেক্ষাপটে গভীরে প্রবেশ করে সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে গোটা আফগান সাম্প্রতিক ঘটনা বিগত চার দশকের বেশি সময় ধরে চলমান বিশেষ পরিস্থিতির বিচারে যুগান্তকারী মোড় পরিবর্তন বলে স্বীকার করতেই হবে।
এ সূচনা হয়েছিল বিগত বিংশ শতাব্দীর ১৯৭৯ সালের শেষের দিকে তৎকালীন দুই পরাশক্তির একটি সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক আগ্রাসনের সময় থেকেই। যদিও অল্পবিস্তর সোভিয়েত আগ্রাসনে দেখা যাচ্ছিল। বিগত ১৯৭৩ সাল থেকে তৎকালীন ক্ষমতাসীন নূর মোহাম্মদ তারাকী সরকারকে গ্রাস করার মধ্য দিয়েই পরবর্তী ছয় বছরে তা পূর্ণতা পেয়েছিল। তৎকালীন আফ্রো-এশিয়ার প্রেক্ষাপটে সোভিয়েত ইউনিয়নের একটা ফর্মুলা ছিল এই যে, প্রথমে স্থানীয় নেতৃত্বকে পক্ষে টেনে আনা, তারপর ক্রমান্বয়ে নিজের খাস লোককে বসিয়ে দেওয়া। নূর মোহাম্মদ তারাকী হাফিজুল্লাহ আমিন এবং সর্বশেষ বারবাক কারমাল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে এ সোভিয়েত ফর্মুলার বাস্তবায়ন হয়েছিল। এমনতর ফর্মুলা সমকালে আমরা বাংলাদেশেও দেখতে পাই শেখ মুজিবের বাকশাল কায়েমের মধ্য দিয়ে। যদিও তা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি আফগানিস্তানের মতো। এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক কারণ ক্রিয়াশীল ছিল।
যা হোক এরপর অতিক্রান্ত হয়েছে চার দশকের বেশি সময়। দুর্ভাগ্য আফগান জনগণের এ সময়ের মধ্যে তাদের দু-দুটি আগ্রাসনের ধকল সইতে হয়েছে। এর মধ্যে ২০০১ সালের অক্টোবরের ৭ তারিখে সূচিত হয়েছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, যা প্রায় দুই দশক স্থায়ী হয়েছিল। এ আগ্রাসন পরবর্তী সোভিয়েত আগ্রাসন থেকে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর ছিল। শুধু সময়ের বিচারে নয়, তা শক্তি-সামর্থ্যরেও বিচারেও।
কেননা মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তিবর্গ ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলনায় বহুগুণ শক্তিশালী। এমনকি সীমান্তবর্তী সব রাষ্ট্রসহ প্রায় সমগ্র মুসলিম বিশ্বই ছিল মার্কিন সমর্থক, যা সোভিয়েত আগ্রাসনে দেখা যায়নি।
এরপর উপরে উল্লেখিত ২০২১ সালের ১৫ আগস্টের তালেবান বিপ্লব। এরপর অতিক্রান্ত হয়েছে সাড়ে তিন বছর। সামগ্রিক বিচারে আফগান পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এসেছে বলেই মনে হচ্ছে। এ সাড়ে তিন বছরের একটা বড় পরিবর্তন এই যে, বিগত দিনগুলোয় বিশেষত দুই আগ্রাসনের মধ্যবর্তীকালে দেখা গিয়েছিল বিভিন্ন দল ও জাতিগোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব-সংঘাত। যার ফলে রাজধানী কাবুল পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে।
সেই প্রেক্ষাপটে নব্বই দশকের দ্বিতীয়ার্ধে উত্থান ঘটেছিল তালেবানদের। সর্বশেষ প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী তালেবান ক্রমান্বয়ে বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনের কাজে এগিয়ে যাচ্ছে। অতীতের মতো আর দল ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব-সংঘাত নেই। মাঝে মধ্যে দু-একটা চোরাগুপ্তা হামলা হচ্ছে বটে। কিন্তু তা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। সমগ্র আফগানিস্তান এক তালেবান শাসনে শাসিত হচ্ছে। বিধায় প্রশাসনেও শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। স্বাভাবিক নিয়মেই জনজীবনও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে, তার মধ্যে অনেক পরস্পরবিরোধিতা থাকলে সুদীর্ঘকালের বিধ্বস্ত অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে পুনর্গঠনের পথে অগ্রসর হচ্ছে। পরস্পরবিরোধী কথাটা এই অর্থে বলতে হচ্ছে যে, সম্প্রতি পাশ্চত্যের মিডিয়ার পরিবেশিত একটা খবরে বলা হয়েছে, সেখানকার অধিকাংশ মানুষই নাকি শুধু রুটি ও চা খেয়ে দিন অতিবাহিত করছে।
তালেবান সরকার অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে তালেবান সরকারের একটা বড় সাফল্য এই যে, তারা আফগান মুদ্রার ন্যূনতম মান বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। সেখানে সীমান্তবর্তী ইরানের মুদ্রা নিছকই কাগজে পরিণত হয়েছে।
এবার আসা যাক সেখানকার বৈদেশিক সম্পর্কের প্রসঙ্গে। আফগানিস্তানের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা তা ভূখণ্ডে কোনো সাগর উপকূল নেই। পুরো দেশটাই স্থলপথে আবদ্ধ। আবার অন্যদিকে রয়েছে মহাদেশীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা। রাশিয়া আফগানিস্তানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অন্যদিকে চীনের সাথেও ক্রমান্বয়ে সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে। অন্যান্য সীমান্তবর্তী রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ইরান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তানের সাথে সীমান্ত নিয়ে তেমন জটিলতা নেই। অবশ্য কিছুকাল আগে হেলমন্দ নদীর পানি নিয়ে ইরানের সাথে সম্পর্কের খানিকটা টানাপড়েন দেখা গেলেও বর্তমানে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক উন্নতির দিকে।
এরপর আফগানিস্তান প্রসঙ্গে অনিবার্যভাবেই চলে আসে পাকিস্তানের নাম। শুধু যে তার সঙ্গে সীমান্ত তাই নয়। সেই সাথে সেখানে রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত খাইবার গিরিপথ, যা সমগ্র বিশ্বের মহাদেশীয় যোগাযোগের কেন্দ্র বটে। যার রয়েছে অন্তত চার হাজার বছরের ঐতিহ্য। সেই বৈদিক আর্য সভ্যতার যুগ থেকেই।
কয়েক শতাব্দী ধরেই পাকিস্তান-আফগানিস্তান সম্পর্ক খুব একটা স্বাভাবিক থাকেনি। বিশেষত এ অঞ্চলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়ে ওঠার সময় থেকেই। কেননা তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্য বর্তমান পাকিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। আফগানিস্তান অতি কষ্টে বাফার স্টেট হিসেবে তার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছিল। ফলে দুই রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব অনিবার্যই ছিল। যার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ১৯৭১ সালে।
অবশ্য পরবর্তীতে তালেবানদের উত্থানে দুই রাষ্ট্রের সম্পর্কের অনেক উন্নতি হয়েছিল। বিশেষত প্রথম তালেবান সরকারের ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল কালপর্বে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আগের সেই নিবিড় সম্পর্ক এখন আর দেখা যাচ্ছে না। বিশেষত সাম্প্রতিককালে বেশ কয়েক দফা আফগান সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলা এ সম্পর্ককে খানিকটা নাজুক করে তুলেছে।
এর পিছনে সম্ভবত পাশ্চাত্যপন্থি কোনো কোনো পাকিস্তানি কর্মকর্তার সামরিক-বেসামরিক যাই হোক না কেন, কালো হাত কাজ করছে। এছাড়া নেপথ্যে হয়তো আফগানিস্তানের তালেবানবিরোধী দলগুলোও কলকাঠি নাড়ছে। তবে আশার কথা এই যে, বর্তমান আফগানিস্তানে তালেবানরা একক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান সরকারও শীর্ষ পর্যায়ে সরাসরি কোনো দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়নি।
উভয় রাষ্ট্র ও সরকারকে এ কথা উপলব্ধি করতে হবে যে, এই দ্বন্দ্ব আপাতদৃষ্টিতে ক্ষীণ বলে মনে হলেও ভবিষ্যতে এ ক্ষুদ্র দ্বন্দ্বের চারা গাছই মহীরূহ হয়ে উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে অল্প কিছু ডলারখেকো অতি উৎসাহী মার্কিনপন্থি ছাড়া উভয়ই রাষ্ট্রেরই সরকার ও জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার ফিরে আসা যাক আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে।
বিশেষত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই মিডিয়াজগৎ; বিশেষত পাশ্চাত্যপন্থি তালেবান সরকারের বহুল আলোচিত নারী বিষয়ক নীতি নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছে। সব শেষ বহুল আলোচিত নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের কঠোর তালেবানবিরোধী বক্তব্য এক্ষেত্রে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। তালেবান সরকারের নারী বিষয়ক নীতি নিয়ে নানারকম বিতর্ক থাকলেও এ কথা বলা যায় যে, সব সরকার ও দলই তার নিজস্ব আদর্শে রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজায়।
তালেবান সরকারের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আবার এও লক্ষণীয় যে, আগের তালেবান ও বর্তমান তালেবান সরকারে মধ্যে বেশকিছু পার্থক্য লক্ষণীয়। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, প্রথম তালেবান সরকারের কর্মকাণ্ড ছিল মোল্লা ওমরের একক নেতৃত্বে কেন্দ্রীভূত। কিন্তু বর্তমান সরকারে সেরকম একক নেতৃত্ব নেই। নারী বিষয়ক নীতির ক্ষেত্রেও পার্থক্য লক্ষণীয়। বর্তমান তালেবান সরকার নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে খানিকটা অগ্রসর হয়েছে। বিশেষত প্রাথমিক স্তরে উচ্চতর ক্ষেত্রেও তারা নারী শিক্ষার গুরুত্ব তাত্ত্বিকভাবে স্বীকার করে নিয়েছে।
তারা এও স্বীকার করে নিয়েছে যে ইসলাম নারীদের যেটুকু অধিকার দেয়, তারাও সেটুকু অধিকার দেবে। এটা যদি সত্যিই বাস্তবায়িত হয়, তাহলে তালেবানের নারী নীতি নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকার কথা নয়। তবে স্থানীয় পর্যায়ে শরীয়া আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কোনো অতি উৎসাহী কর্মকর্তার বাড়াবাড়ি সমস্যা সৃষ্টি করছে। এক্ষেত্রে তালেবান সরকারকে সতর্ক থাকতে হবেÑ যেন প্রতিপক্ষ অপপ্রচার চালাতে না পারে।
আফগানিস্তান থেকে পাওয়া সর্বশেষ সুখবর হচ্ছে, তালেবান সরকারের একদল প্রতিনিধি জাপান সফরে গিয়ে আলোচনা করেছে এবং এ আলোচনা যথেষ্ট ফলপ্রসূ হয়েছে। অর্থাৎ মন্থরগতিতে হলেও তারা কূটনৈতিকভাবে, বিশেষত অমুসলিমজগতেও অগ্রসর হচ্ছে। চূড়ান্ত বিচারে তালেবান সরকারকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে আফগান জনগণ, মুসলিম উম্মাহর স্বার্থ এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নীতি অটুট রাখতেই হবে। এক্ষেত্রে ইরান, উত্তর কোরিয়া না হোক, অন্তত গণচীনের মতো অবস্থান ধরে রাখতে হবে। কথায় বলে, যে চরিত্র হারায়, সে সবকিছুই হারায়। তালেবান সরকারকেও এ কথা সর্বদা স্মরণে রাখতে হবে আফগান জনগণের সুন্দর ভবিষ্যতের স্বার্থে।