পাঠদানে শিক্ষকদের অনাগ্রহ : ভরসা পাচ্ছেন না অভিভাবকরা

সরকারি প্রাথমিকে শিক্ষার্থী কমছে


১৭ এপ্রিল ২০২৫ ১৪:২৬

॥ সৈয়দ খালিদ হোসেন ॥
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরগুলোয় অবস্থিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম। অনেক প্রতিষ্ঠানেই কাক্সিক্ষত পরিমাণ শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া যায় না। সম্পূর্ণ অবৈতনিক এ শিক্ষার সুযোগ থাকলেও প্রায় ৮০ শতাংশ অভিভাবক তার সন্তানকে সরকারি প্রাথমিকে ভর্তি না করিয়ে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করছেন। কিন্তু কেন? কয়েকজন অভিভাবক এবং শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিকভাবে প্রভাবশালী শিক্ষকরা নিয়মিত স্কুলে আসেন না এবং ক্লাস করতে চান না। অনেক শিক্ষক নিজে ক্লাসে না এসে অন্যদের দিয়ে বদলি ডিউটি করান, কিছু শিক্ষক নিজের বাচ্চাদের নিজের স্কুলে ভর্তি না করিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করান এবং নিজে তার কর্মস্থলে শিশুদের পাঠদানে সিরিয়াস না হলেও নিজের বাচ্চারা ঠিকভাবে ক্লাস করছে কিনা, তার তদারকিতে বেশি ব্যস্ত থাকছেন। কেউ কেউ নানা কারণে-অকারণে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকছেন, যাদের বাসা বিদ্যালয়ের কাছে, তারা নাশতা খাওয়া এবং দুপুরের খাবার খাওয়াসহ নানা কারণ দেখিয়ে ক্লাস সময়ে স্কুলের বাইরে অবস্থান করেন। ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় অধ্যয়নরত বেশিরভাগ শিক্ষার্থী পথশিশু ও ছিন্নমূল শিশু। শিক্ষকরা এসব শিশুকে লেখাপাড়ায় উদ্বুদ্ধ করে তোলেন, তারা ক্লাসে আসে। এ ছিন্নমূল্য ও পথশিশুদের সঙ্গে মিশে নিজের সন্তান পথহারাতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে অনেক সচ্ছল ও সচেতন অভিভাবক সরকারি প্রাথমিকে ভর্তি করান না। এসব কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতি সচেতন ও সচ্ছল অভিভাবকদের আগ্রহ নেই, নেই আস্থাও।
রাজধানীর মতিঝিলে অবস্থিত ‘টিএন্ডটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের’ শিক্ষক রেহানা আক্তারের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কম ভর্তি হওয়া ও শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ার বেশকিছু কারণ জানান। এ শিক্ষকের মতে, অনেক প্রভাবশালী রাজনীতিক এবং অনেক আমলার স্ত্রী বা নিকটাত্মীয় তদবির করে ঢাকার স্কুলে প্রবেশ করেন। কিন্তু তারা পাঠদান করেন না বললেই চলে। তিনি জানান, আওয়ামী লীগের শাসনামলে তার এক সহকর্মী টাঙ্গাইল থেকে তার স্কুলে বদলি হয়ে আসেন, কিন্তু তিনি ক্লাস করেননি। অন্য একজনকে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠানে হাজিরা চালিয়ে নিয়েছেন, আর মাস শেষে বিনা কাজে পয়সা নিয়েছেন। শেখ হাসিনার আমলে একই স্কুলের অন্য এক সহকর্মী ক্লাস নিতেন না, তার বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে গিয়ে উল্টো বিপদে পড়েন। ওই শিক্ষক তার অপরাধের জন্য ক্ষমা চাওয়া দূরের কথা, উল্টো তিনি তার বিসিএস ক্যাডার স্বামীর প্রভাব খাটিয়ে শিক্ষা কর্মকর্তার পেনশনের টাকা আটকের অপচেষ্টা চালান।
এ প্রতিবেদককে শিক্ষক রেহানা আক্তার জানান, ঢাকার বাইরে থেকে তদবির করে যারা ঢাকায় আসেন, তাদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী লেখাপড়া করানোর বিষয়ে অমনোযোগী। তিনি আরও জানান, ঢাকার প্রাথমিক স্কুলগুলোয় শিক্ষার্থী ভর্তি না হওয়ার পেছনে বেশি দায়ী শিক্ষকরা, তারা সঠিকভাবে পাঠদানে আগ্রহী নন। কিছু শিক্ষক পাঠদানে আগ্রহী হলেও এদের সংখ্যা খুবই কম। তিনি বলেন, এখানে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে- সরকারি প্রাথমিকে এখন এমন অনেক শিক্ষক নিয়োগ নিয়েছেন, যাদের প্রত্যাশা ছিল বিসিএস বা প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হওয়া, কিন্তু চাকরির বাজার খারাপ থাকায় এরা সরকারি প্রাথমিকে এসেছেন চাকরি করতে- এ ধরনের শিক্ষকরা কর্মস্থলে মনোযোগী হতে পারছেন না, হচ্ছেন না। ফলে শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার বেহাল দশা তৈরি হয়েছে।
টিএন্ডটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর গল্প শোনালেন শিক্ষক রেহানা। তিনি জানান, শিক্ষার্থী ময়না (ছদ্মনাম) ক্লাসে না আসার কারণে খুঁজতে গিয়ে জানতে পারেন ওই শিক্ষার্থী সড়কে বেলুন বিক্রি করে সংসারে আয়ের জোগান দেয়। রাস্তায় অন্যদের সঙ্গে মিশতে গিয়ে বিড়ি-সিগারেটেও আসক্ত হয়ে পড়ে ময়না। অন্য নেশায় জড়িয়ে থাকতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে। ময়নাকে নিয়মিত ক্লাসে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া হলেও অন্যরাও থাকেন টেনশনে। কারণ ওর সঙ্গে মিশে যদি অন্য ভালো বাচ্চারা পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে- এমন উদ্বেগ শিক্ষক এবং অভিভাবকদের মধ্যেও রয়েছে। এ শিক্ষকের ভাষ্যানুযায়ী, রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের নিকটাত্মীয়, উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে যারা সরকারি প্রাথমিকে চাকরি নিয়েছেন, তারা চাকরি করলেও ক্লাস নিতে চান না। শিক্ষকদের একটা বড় অংশ নিজের সন্তানের লেখাপড়ায় সিরিয়াস অথচ কর্মস্থলের শিশুদের লেখাপড়ার বিষয় (নতুন এ প্রজন্মকে শিক্ষিত জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে আন্তরিক নন) মোটেও আন্তরিক নন। আর এসব কারণে ঢাকায় বসবাসরত সচেতন ও সচ্ছল পরিবারের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিকে পাওয়া যায় না। আর এ শূন্যতা পূরণে শিক্ষার্থী সংগ্রহে যখন শিক্ষকরা অভিযান চালান, তখন ছিন্নমূল, বস্তিবাসী, পথশিশু ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায় না। এসব শিশুকে স্কুলে ভর্তি করানো হলেও তারা দীর্ঘদিন টেকসই হয় না। অল্প সময়েই ঝরে পড়ে।
একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মোশাররফ হোসেন। তিনি নিজে লেখাপড়া করেছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, কিন্তু তার সন্তানকে তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেননি। আরেক অভিভাবক মাহবুব আলম, তিনি নিজে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, তার বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলন, কিন্তু এ মাহাবুব আলমের তিন সন্তানের দুজনই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেছে, কিন্তু তারা (দুই সন্তান) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি, তারা পড়েছে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। ঢাকার অভিভাবক মোশাররফ হোসেনের ভাষ্য, ঢাকায় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা মানসম্মত নয়। শিক্ষক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর পাঠদানের ওপর আস্থা রাখতে না পারায় অতিরিক্ত খরচ করে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে পড়াতে হচ্ছে।
ভালো শিক্ষক ও ভালো পরিবেশ চান অভিভাবকরা
হারুন অর রশীদ নামে এক সচেতন অভিভাবক মনে করেন, ঢাকায় যারা পরিবার নিয়ে বসবাস করেন, তারা অনেকটাই সচেতন। তারা তাদের আদরের সন্তানকে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শক্তভাবে গড়ে তুলতে চান। ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ভালো শিক্ষক এবং শিক্ষার জন্য ভালো পরিবেশের বিকল্প তারা ভাবেন না, সেক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়। অন্যান্য বিভাগীয় শহরের চাইতে ঢাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা বেশি খারাপ। খবর নিয়ে জানা গেছে, কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জায়গা দখল করে বসানো হয়েছে ওয়াসার পানির পাম্প। কোনোটির সীমানার ভেতর নির্মাণ করা হয়েছে বাড়ি কিংবা দোকান। আছে শ্রেণিকক্ষের পাশে বাজারও। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এমন রয়েছে যে খুবই জরাজীর্ণ; এমনকি সরকারি সংস্থা ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণার পরও সংস্কার ছাড়াই পাঠদান চলছে। সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশিরভাগ বিদ্যালয়ের প্রায় সব শিক্ষার্থী নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। যারা প্রাইভেটে পাড়ানোর খরচ চালানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই। এ কারণে তারা অন্তত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানকে ভর্তি করিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে নিতে চান। শিক্ষার্থী কম হওয়ার আরেকটা বড় কারণ রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা, সেটি হচ্ছে- শিক্ষক এবং শিক্ষা কর্মকর্তারা যখন জানেন এবং বুঝেন যে, শহরের সরকারির এ প্রতিষ্ঠানগুলোয় দরিদ্র বা স্বল্প আয়ের মানুষের শিশুরা পড়ে তারা এত সচেতন নয়, ফলে পাঠদানে তারা সিরিয়াস থাকে না।
ঢাকার অনেক প্রতিষ্ঠান বেদখল এবং জরাজীর্ণ
জানা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৪২। এর মধ্যে বেদখল হয়ে আছে কমপক্ষে ৪০টির জমি কিংবা ভবন। ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্য বলছে, ডেমরা থানার ৭টি, মতিঝিলের ৭টি, সূত্রাপুরের ৬টি, কোতোয়ালির ৪টি, ধানমন্ডির ১টি, মিরপুরের ৫টি, মোহাম্মদপুরের ৩টি, গুলশানের ২টি, রমনার ২টি এবং তেজগাঁও থানার ১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জরাজীর্ণ ও বেদখলের তালিকায় রয়েছে। এর মধ্যে ৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাম্প বসিয়ে দখল করে রেখেছে ওয়াসা। ১২টিতে দখল করে রেখেছে পার্শ্ববর্তী উচ্চবিদ্যালয়। বাকিগুলো ধর্মীয় উপাসনালয়, বস্তি, দোকান, বাজার ইত্যাদির মাধ্যমে দখল করে রেখেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। আবার দুটি বিদ্যালয়ে বেদখল এবং জরাজীর্ণ দুই সমস্যাই আছে।
প্রাথমিকের শিক্ষকরা এবং সচেতন মহল মনে করেন, ঢাকার বেশিরভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো ভালো নয়। জরাজীর্ণ ও বেদখলের কারণেও উচ্চবিত্ত এবং ভালো আয়ের মানুষ এসব বিদ্যালয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। গ্রামে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বা কিন্ডারগার্টেন কম থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারি স্কুলই ভরসা। ফলে সেসব বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রেও থাকে প্রতিযোগিতা। কিন্তু ঢাকায় অভিভাবকদের বিকল্প চিন্তার সুযোগ অবারিত। সে কারণে উচ্চবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তরাও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানকে ভর্তির চিন্তা করেন না। ফলে শহরের সরকারি বিদ্যালয়ে পড়তে আসে নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা।
দেশজুড়ে প্রাথমিকের শিক্ষার্থী প্রায় দুই কোটি
প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিসংখ্যান (এপিএসসি) ২০২৩-এর তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রাথমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৯৭ লাখ ১৩ হাজার ৬৮৫। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে ১ কোটি ৯ লাখ ৮৫ হাজার ৮১৫ জন, যা মোট শিক্ষার্থীর ৫৫ দশমিক ৭ শতাংশ। বেসরকারি পর্যায়ের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে ৮৭ লাখ ২৭ হাজার ৮৭০ জন। সে অনুযায়ী নিজস্ব তথা পরিবারের অর্থায়নে পড়াশোনা করছে প্রাথমিক পর্যায়ের প্রায় ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এ শিক্ষার্থীদের অর্ধেকেরও বেশি পড়াশোনা করছে কিন্ডারগার্টেনে, যার সংখ্যা ৪৮ লাখ ৭৩ হাজার ৩৭৫। এর বাইরে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮ লাখ ৩৭ হাজার ৮৮৮ জন, উচ্চবিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮ লাখ ৪ হাজার ৩৫, ইবতেদায়ি মাদরাসায় ৬ লাখ ৮২ হাজার ৮৫৫, এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয়ে ৫ লাখ ৩৬ হাজার ১৬১, উচ্চ মাদরাসার সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক শাখায় ৪ লাখ ৮১ হাজার ১৯৯, এনজিও শিক্ষা কেন্দ্রে ২ লাখ ৭৬ হাজার ৫০৪, শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট বিদ্যালয়ে ৩০ হাজার ৩৪৬ ও অন্যান্য বিদ্যালয়ে ২ লাখ ৫ হাজার ৫০৭ জন প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছে। এ পরিসংখ্যানে ইংরেজি মাধ্যম ও কওমি মাদরাসার তথ্য উল্লেখ করা নেই। তবে মাদরাসা শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের তথ্যানুযায়ী, কওমি মাদরাসায় ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী শিক্ষার্থীর সংখ্যা অন্তত ১০ লাখ।
গ্রাম থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় অধ্যয়নরত বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই পড়েন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু ঢাকা শহর, অন্যান্য বিভাগীয় শহরেও প্রাথমিকে শিক্ষার্থী কম, কিন্তু সেখানে ঢাকার চেয়ে অনেকটা বেশি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিকের মাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী। বাকি ৮০ শতাংশই অধ্যয়ন করছে বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আর ঢাকার বাইরে প্রাইমারি পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামে ৫৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ, রাজশাহীতে ৬৪ দশমিক ১১, রংপুরে ৪৮ দশমিক ৯, খুলনায় ৬৪ দশমিক ১৯, ময়মনসিংহে ৫৭ দশমিক ২৪, সিলেটে ৬৭ দশমিক ২ ও বরিশালে ৭৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে সরকারি বিদ্যালয়ে।
প্রাথমিক শিক্ষা পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, ঢাকায় প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ লাখ ২২ হাজার ৯০৭। তাদের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে ৪৫ হাজার ৪১৮ জন, যা মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৫২ হাজার ৭২৩। তাদের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে মাত্র ২ লাখ ৯০ হাজার ৬০৩ জন, যা মোট শিক্ষার্থীর ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। সব মিলিয়ে এখানে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ২০ দশমিক ৬ শতাংশ পড়াশোনা করছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকায় সচ্ছল অভিভাবকদের অনীহা
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার অভাব, নিরাপত্তা ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আধিক্য এবং আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিদের অনীহার কারণেই ঢাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীরা কম ভর্তি হচ্ছে। সচেতন মহলের ভাষ্য, ‘শিক্ষকের সংখ্যা ও মান, স্কুলের অবস্থান, খেলার মাঠ আলাদাসহ পর্যাপ্ত জায়গা, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিবেচনা করলে দেশে যে গড়পড়তা প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে, তার চেয়েও খারাপ অবস্থা রাজধানীতে। এর কারণ হলো, একটি গোষ্ঠী চায় না, ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ভালো করুক। তারা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে সরকারি প্রাথমিকের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে না।’ তাছাড়া ‘নীতিনির্ধারকদের সন্তানরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে না। সচেতন মানুষ বেসরকারি গুটিকয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি আগ্রহী। ফলে প্রাথমিকের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়নি।
ঢাকা জেলার সহকারী শিক্ষা অফিসার জিয়াউদ্দিন আহাম্মদের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি জানান, ঢাকা মহানগর এবং ঢাকা জেলায় মোট ৯৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখানে ভর্তি রয়েছে ১৫ লাখ ৬৩ হাজার ৮৫৫ শিক্ষার্থী। কিন্তু কতজন অধ্যয়নরত রয়েছে, তার কোনো তথ্য নেই। গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ শিক্ষার্থী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়লেও ঢাকায় কেন পড়ছেন না- এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি শিক্ষা অফিসার জিয়াউদ্দিন আহাম্মদ।