ক্যাপসিকামে দ্বিগুণ লাভের আশায় কুষ্টিয়ার কৃষকরা
১৩ মার্চ ২০২৫ ১৬:৩৬
কুদরতে খোদা সবুজ, কুষ্টিয়া : কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে উচ্চফলনশীল সবজি ক্যাপসিকাম চাষ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের নিয়ামতবাড়িয়া গ্রামের প্রায় ৩০ জন কৃষক চলতি মৌসুমে প্রায় দশ বিঘা জমিতে ‘ইন্দ্রা গোল্ড’ জাতের বিদেশি এ সবজি চাষ করেছেন। গত এক সপ্তাহে ১৫০ থেকে প্রকারভেদে ২০০ টাকা দরে প্রায় দুই হাজার কেজি ক্যাপসিকাম প্রায় তিন লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূল থাকলে ক্যাপসিকাম চাষ থেকে চলতি মৌসুমে খরচ বাদে প্রায় ১৪ লক্ষাধিক টাকা মুনাফা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। গাছে ভালো ফল ধরায় এবং লাভজনক চাষ হওয়ায় ক্যাপসিকামে স্বপ্ন বুনছেন অন্যান্য কৃষকরাও।
কথা হয় ক্যাপসিকাম চাষি লিখন আলীর সঙ্গে। লিখনের ভাষ্য, জমির ইজারা, চারা, সার, পরিচর্চাসহ দশ বিঘা জমিতে ক্যাপসিকাম চাষে তাদের খরচ হয়েছে প্রায় ১০ লাখ টাকা। গত সাতদিনে প্রায় দুই হাজার কেজি ক্যাপসিকাম তুলেছেন। প্রতি কেজি ক্যাপসিকাম পাইকারি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা দরে তিন লাখ টাকার মতো বিক্রি হয়েছে। জমিতে বর্তমানে যে পরিমাণ ক্যাপসিকাম হচ্ছে তাতে উৎপাদিত এ সবজি আগামী দুই মাসে আরো প্রায় ১৪ হাজার কেজির প্রত্যাশা রয়েছে। এতে অনায়াসেই ক্যাপসিকাম বিক্রি করে দ্বিগুণ লাভের বিষয়ে আশাবাদী।
জানা গেছে, চাঁদপুর ইউনিয়নে জংগলী আধুনিক কৃষি সমবায় সমিতি নামে কৃষকদের একটি সংগঠন রয়েছে। সমিতির সভাপতি ইলিয়াস হোসেন খসরু ২০২৪ সালে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে দুই বিঘা জমিতে ক্যাপসিকাম চাষ করেন। সে বছর এ চাষে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ করে তিনি প্রায় চার লাখ টাকা মুনাফা পান। এতে ক্যাপসিকাম চাষে আগ্রহ বাড়ায় সমিতির অন্যান্য সদস্যরাও। তাদের মধ্যে ৩০ জন নানা বয়সি শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত ও নিরক্ষর কৃষক যশোর অঞ্চলের টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় নিয়ামতবাড়িয়া মাঠপাড়া এলাকায় দশ বিঘা জমিতে নিরাপদ উচ্চফলনশীল সবজি ‘ইন্দ্রা গোল্ড’ জাতের ক্যাপসিকাম চাষ করেন। ১২০ দিন জীবনকালের এ সবজির চারা রোপণের ৬০ দিনের মাথায় ফল দেওয়া শুরু হয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, পাকা সড়ক ঘেঁষে নিয়ামতবাড়িয়া মাঠপাড়া এলাকা। সেখানে চারদিকে জাল দিয়ে ঘিরে মালচিং পদ্ধতিতে ক্যাপসিকাম চাষ করা হয়েছে। সবুজ গাছে ঝুলছে ফল। ৪-৫ জন করে কৃষকরা দল বেঁধে কেউ গাছ থেকে ফল তুলছেন, কেউ পরিষ্কার করছেন। কেউবা আবার আধুনিক যন্ত্রে পরিমাপ করে প্যাকেট করছেন বাজারে নেওয়ার জন্য।
এসময় ষাটোর্ধ্ব কৃষক মুন্সী মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, প্রথমবারের মতো ক্যাপসিকাম চাষ করা হয়েছে। গাছে প্রচুর ফল দেখে খুব ভাল লাগছে। বাজারে ভালো দাম থাকায় ব্যাপক লাভের আশা করছি।
ধান, পাট, পেঁয়াজসহ অন্যান্য চাষাবাদের পাশাপাশি এ বছর ৩০ জন মিলে ক্যাপসিকাম চাষ করেছি। গেল সাত দিন ধরে ফল তুলে কুষ্টিয়া, রাজশাহী, পাবনা, খুলনা ও ঢাকায় বিক্রি করা হচ্ছে বলে জানান কৃষক গোলাম মোস্তফা। তার ভাষ্য, ভালো ফলন হওয়ায় প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে কৃষকরা দেখতে আসেন। তাদের পরামর্শও দিচ্ছেন তারা।
সমিতির অন্যতম সদস্য নজরুল ইসলাম বলেন, আগামী দুই মাস ধরে ফল পাওয়া যাবে। এরপর ক্যাপসিকাম মেরে দিয়ে আধুনিক জাতের পেঁপের চারা রোপণ করা হবে।
ক্যাপসিকাম চাষ দেখতে এসেছেন নিয়ামতবাড়িয়া গ্রামের কৃষক রাজ্জাক বিশ্বাস। তিনি বলেন, এলাকায় প্রথমবারের মতো এ চাষ হয়েছে। ভালো ফলন ও লাভজনক হওয়ায় আগামী বছর এক বিঘা জমিতে ক্যাপসিকাম চাষ করব।
বিদেশি সবজি চাষের খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন কুষ্টিয়া ইবি থানার মৃত্তিকাপাড়া এলাকার কৃষক আতিয়ার রহমান। তিনি বলেন, গাছে রোগবালাই নেই, মালচিং পদ্ধতিতে বিষমুক্ত চাষাবাদ হয়েছে। দেখে শুনে খুব ভালো লাগছে। আগামীতে তিন বিঘা জমিতে এ চাষ করব।
জংগলী আধুনিক কৃষি সমবায় সমিতির সভাপতি ইলিয়াস হোসেন খসরু বলেন, কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে গত বছর দুই বিঘা জমিতে প্রথম ক্যাপসিকাম চাষ করেছিলাম। এতে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা খরচে প্রায় চার লাখ টাকা বিক্রি হয়েছিল। আমার দেখাদেখি সমিতির অন্য সদস্যদের আগ্রহ বাড়ে এ চাষে। সেজন্য এ বছর ৩০ জন মিলে ১০ বিঘা জমিতে চাষ করেছি। আগামী বছর ২৫ বিঘা জমিতে ক্যাপসিকাম চাষের পরিকল্পকনা রয়েছে।
স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, একদল কৃষক উচ্চমূল্যের সবজি ক্যাপসিকাম চাষ করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন। কৃষি অফিসের পরামর্শ, উপকরণ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকরা প্রায় ৮-১০ লাখ টাকা খরচ করে ২৪ লাখ টাকার ক্যাপসিকাম বিক্রির স্বপ্ন বুনছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রাইসুল ইসলাম বলেন, উচ্চমূল্যের সবজি ও ফসল চাষাবাদে যশোর টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের পরামর্শ, উপকরণ প্রদান ও প্রশিক্ষণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক রমেশ চন্দ্র ঘোষ জানান, কৃষকরা যাতে নিরাপদ উপায়ে ক্যাপসিকাম চাষ করতে পারে, এজন্য আমরা প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদান করছি। সেই সাথে মাঠপর্যায়ে আমরা ক্যাপসিকাম চাষের জন্য প্রদর্শনী বাস্তবায়ন ও মাঠ দিবস করছি। এছাড়া কৃষকরা যাতে সঠিক মূল্য পায় এজন্য আমরা সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও বাজার সংযোগের ব্যবস্থা করছি।
তিনি আরও জানান, আমরা বিভিন্ন সবজি ও ফসলের সংগ্রহ-উত্তর ক্ষতি কমিয়ে মূল্য সংযোজন করার জন্য কৃষক পর্যায়ে বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ ও উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে কাজ করছি।
কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুফি মো. রফিকুজ্জামান জানান, বর্তমানে কৃষকরা লাভজনক কৃষির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন ক্যাপসিকাম চাষের জন্য উপযুক্ত সময়। তাই কৃষকরা মাঠে জমি তৈরি ও চারা রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছে। কুষ্টিয়া জেলার জন্য ক্যাপসিকাম চাষ একটি সম্ভাবনাময় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।