আল্লাহ প্রদত্ত বিধান প্রতিষ্ঠায় নিহিত নারী সমাজের মুক্তি ও সমৃদ্ধি
১৩ মার্চ ২০২৫ ১৬:৩২
॥ নূরুন্নাহার নীরু ॥
প্রতি বছরই ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস এলেই যেন নারী শুভাকাক্সক্ষীরা নড়েচড়ে বসেন। শুরু হয়ে যায় সেমিনার-সিম্পোজিয়ামসহ নানা আয়োজন। সভা, সংগঠনগুলো মুখরিত হয়ে ওঠে বিভিন্ন প্রোগ্রাম নিয়ে। আন্তর্জাতিকভাবে একটা প্রতিপাদ্য বিষয়ও নির্ধারণ হয়ে যায়। এবারও হয়েছে ২০২৫ সালের জন্য- ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন, নারী ও কন্যার উন্নয়ন।’
নারীর ‘অধিকার’ সংক্রান্ত আলোচনা খুবই পুরনো, ‘সমতার’ বিষয়টিও চলমান। ইদানীং ‘ক্ষমতায়ন’ বিষয়টিকে খুব বেশি সামনে আনা হচ্ছে কয়েক বছর ধরেই। এবারে ২৫ এসে যুক্ত হয়েছে ‘উন্নয়ন’ শব্দটি। বিশেষভাবে নারী ও কন্যার জন্য আইন করে প্রতিষ্ঠা করা ‘উন্নয়ন’ শব্দটি খুবই অনভিপ্রেত। বেদনার সাথে বলতে হচ্ছে, প্রদত্ত প্রতিপাদ্যে যে বিশেষণগুলো বিশেষায়িত করা হয়েছে, তার আলোচনা-পর্যালোচনা প্রতিবারই নতুন করে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, কিন্তু কার্যত কিছুই হচ্ছে না। দিবস শেষ হলেই যেন সব শেষ।
অথচ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সেই কবে ১৫০০ বছর আগেই শেষ নবী মুহাম্মদ সা.-এর মাধ্যমে আল কুরআনে নারীদের অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন, উন্নয়ন সব কিছুরই একটা রূপরেখা দিয়ে রেখেছেন।
কোনো কোনো উচ্চশিক্ষিতা অত্যাধুনিক মহিলারাও এসব শব্দ নিয়ে ইদানীং আলোচনা-পর্যালোচনায় বিরক্তিবোধ করেন। তারা মনে করেন; এমনকি অনেকে বলেও থাকেন যে, এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা একটা বাতুলতা মাত্র। শুধুই প্রহসন। তাদের উক্তরূপ ধারণার পেছনে অবশ্যই একটা যুক্তি আছে। আজ আমরা আল কুরআনে ও আল হাদীসের আলোকে যদি সে কারণগুলো বের করে আনি, তাহলে দেখা যাবে সত্যিকার অর্থেই নারীর উন্নয়ন সংক্রান্ত নব নব সংস্করণ আসলেই বাতুলতা মাত্র। মহান রাব্বুল আলামিন দিয়েই রেখেছেন নারী ও পুরুষের সম্মিলিত জীবনাচারে যাবতীয় অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন, উন্নয়ন। মূলত একমাত্র ইসলামী বিধানে প্রদত্ত এটি এক মহান দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। যেমনÑ সামাজিক ও পারিবারিক অধিকার, জ্ঞান অর্জনের অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতা, মর্যাদা রক্ষা, সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মতৎপরতা, ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকার, মানবতার কল্যাণÑ সোজা কথা সমাজে চলতে গেলে তাঁর সার্বিক দিকে যেমন পুরুষের অংশগ্রহণ আছে, তেমনি নারীরও রয়েছে। চাই শুধু একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র। এখানে সামান্য কিছু উদাহরণ তুলে ধরলাম। মহান আল্লাহ বলছেন-
১. সৃষ্টিগতভাবে নারীর মর্যাদা : “আল্লাহর নিদর্শনাবলির মধ্যে এটি একটি যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জুড়ি, যেন তোমরা তাদের সাহায্যে সাহচর্যে পরিতৃপ্তি ও প্রশান্তি লাভ করতে পারো। এ উদ্দেশ্যেই তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া অনুকম্পা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। চিন্তাশীল লোকদের জন্য এতে বহু নিদর্শন রয়েছে।” (আর রূম : ২১)।
২. অধিকার ও দায়িত্বের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ভারসাম্য : “নারীদের জন্যও ঠিক তেমনি ন্যায় সংগত অধিকার আছে, যেমন আছে তাদের ওপর পুরুষদের অধিকার। কিন্তু উভয়ের মধ্যে নারীদের ওপর পুরুষদের একটি বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। স্বামী-স্ত্রী সবার ওপরই আল্লাহ হচ্ছেন মহাপরাক্রমশালী, বিজ্ঞ ও সুবিবেচক।” (সূরা আল বাকারা : ২২৮)।
৩. সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও অন্যায় প্রতিরোধে নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াস : “মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী পরস্পরের বন্ধু ও সাথী। তারা ভালো কাজের আদেশ দেয় ও মন্দ কাজে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, নামাজ কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। অবশ্যই আল্লাহ এসব লোকদের প্রতিই দয়াবান হবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী ও পরম জ্ঞানী।” (আত তাওবা : ৭১)।
৪. কঠিন যুগসন্ধিক্ষণেও নারী-পুরুষের যৌথ ভূমিকা : “যারা মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের বিনা অপরাধে নির্যাতন করে ও কষ্ট দেয়, তারা নিঃসন্দেহে বিরাট মিথ্যার দোষ ও গুনাহের বোঝা নিজের ওপর চাপিয়ে নিয়েছে।” (আল আহযাব : ৫৮)।
আরো বলেছেন, “তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা সেসব দুর্বল ও অসহায় নারী, পুরুষ ও শিশুদের জন্য আল্লাহর পথে লড়াই করছো না? যারা নিপীড়নের তাড়নায় অতিষ্ঠ হয়ে ফরিয়াদ করছে যে, হে আল্লাহ! আমাদেরে এ জনপদ হতে নাজাত দাও, যার অধিবাসীরা সীমাহীন অত্যাচারী এবং তোমার খাস রহমতে আমাদের জন্য কে নো বন্ধু ও কোনো দরদী সাহায্যকারী তৈরি করে দাও!” (আন নিসা : ৭৫)।
৫. অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা : “পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষদের জন্য যেমন নির্ধারিত অংশ রয়েছে, তেমনি তাতে তা যতই কম বা বেশি হোক নারীদেরও অংশ নির্ধারিত রয়েছে। আর এ নির্ধারণ আল্লাহর পক্ষ থেকে।” (আন নিসা : ৭)।
৬. হিযরত কালেও পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণের ক্ষমতা : “হে ঈমানদার লোকেরা! যখন তোমাদের সাথে মিলিত হবার উদ্দেশ্যে ঈমানদার মহিলারা হিযরত করে মদীনায় আসে তখন তোমরা তাদের ঈমানের ব্যাপারটা যাচাই করে নাও। (আল মুমতাহিনা : ১০)।
৭. সত্য যাচাইর জন্য বা অপরাধ দমনে পুরুষের পাশাপাশি নারীর ভূমিকা : “হে নবী বলে দাও, এসো আমরা আমাদের ও তোমাদের স্ত্রী-পরিবার, ছেলে-মেয়ে ও আপনজনকে ডেকে নেই। (এ আহ্বান হচ্ছে সত্যযাচাই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের।” (আলে ইমরান : ৫৯-৬১)।
“ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণী প্রত্যেককেই একশত করে বেত্রাঘাত কর। এদের ওপর আল্লাহর আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেন তোমরা দয়া পরবশ হয়ে না পড়। তোমরা যদি সত্যিই আল্লাহ ও পরকালের ওপর ঈমান এনে থাক তাহলে এসবের প্রশ্নই আসে না। আর এ বেত্রাঘাতের অনুষ্ঠান যেন জন সমক্ষে অনুষ্ঠিত হয় এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুমিন যেন তাদের উভয়ের এ সাজা প্রত্যক্ষ করে।” (সূরা নূর : ২)।
“চোর পুরুষ হোক বা নারী উভয়েরই হাতের কব্জি পর্যন্ত কেটে দাও। এটা তাদের কর্মের ফল এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট সাজা। আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী।” (আল মায়েদা : ৩৭)।
এরকম বহু আয়াত আছে আল কুরআনের ছত্রে ছত্রে যেখানে নারী-পুরুষ এর মধ্যে ভেদাভেদ নয় বরং একই সূত্রে গেঁথে দেয়া হয়েছে যা সমাজ গঠনে অনস্বীকার্য আবহ তৈরি করতে সহায়ক। আল হাদীসেও আমরা জানতে পারি নারীর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র রক্ষার কতিপয় উদাহারণ। যেমন-
১. নিশ্চয়ই নারীরা পুরুষদের সহোদর। (আবু দাউদ)।
২. হযরত ওমর রা. বলেন, “আল্লাহর শপথ! জাহেলি যুগে আমরা নারীদেরে কোনো মর্যাদাই দিতাম না। অবশেষে আল্লাহ কুরআনুল করীমে তাদের জন্য আয়াত নাজিল করলেন এবং তাদের প্রাপ্য বণ্টন করে দিলেন।” (বুখারী ও মুসলিম)। ৩. কন্যাসন্তানের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে রাসূল সা. বলে গেছেন- “নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য জ্ঞান অর্জন ফরজ হুকুম।” তিনি আরো বলেছেন, “বিবাহ শাদীতেও নারীর মতামত ব্যতীত বিবাহ অনুষ্ঠিত হতে পারে না।” “নারীকে ভোগের সামগ্রী মনে করে তার ওপর চেপে বসার মানসিকতা পরিহারের ব্যাপারেও তিনি সতর্ক করে গেছেন। এমনকি নারীর মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার উদাহারণও তিনি রেখে গেছেন দুনিয়ার বুকে।
মূলত স্বল্প পরিসরের এ কয়টি উদাহরণ থেকে যে বিষয়টি প্রচ্ছন্ন হয়ে আসে, তা হচ্ছে- একটি সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে নারী পুরুষ উভয়য়েরই সমান দায়িত্ব, কর্তব্য রয়েছে যা প্রতিষ্ঠায় অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন’ এমনকি উন্নয়নও অবধারিত তা হোক পুরুষ কি নারী। এর জন্য চাই সুষ্ঠু, আদর্শিক, আল্লাহর সার্বভৌমত্বে গড়া একটি রাষ্ট্র যেখানের আইনে নারী-পুরুষের জন্য প্রদত্ত প্রতিটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। পৃথক করে আর নারীদের জন্য ভাবতে হবে না। এমন একটি রাষ্ট্র গড়তে হলে প্রথমেই তার শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে, যেখানে নারী-পুরুষ উভয়ই জানতে পারবে যার যার দায়িত্ব কর্তব্যসহ স্বীয় উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে। দুর্ভাগ্য আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় একদল শুধুই বস্তুবাদী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদের অধিকার মর্যাদা সম্পর্কে যেমনি অজ্ঞ থেকে যাচ্ছে, তেমনি আরেক দল শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করে দুনিয়াবিমুখ হয়ে প্রচলিত রাষ্ট্রীয় আইন সম্পর্কেও থাকছে নিস্পৃহ। উপরন্তু জানতেও পারছে না রাষ্ট্রের প্রতি তার কী দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। বস্তুত ঘর থেকেই নারী পুরুষের শিক্ষার হাতেখড়ি। সুতরাং নারীর মতো পুরুষকেও জানতে হবে ইসলামের বিধানসমূহ। তাহলে সেও তার ঘরের নারীদের অধিকার, মর্যাদার প্রতি সচেতন হয়ে উঠতে পারবে। যে সমাজে পুরুষরাই পিছিয়ে, পুরুষরাই বৈষম্যের শিকার, নির্যাতিত সে সমাজে নারীর অগ্রগতি কোন পথে? কেন আসবে? আমরা প্রতি বছর যতই ঢাকঢোল পেটাই না কেন, তা নিতান্তই গলাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। মূলত আমাদের কাজের চেয়ে কথা বেশি- এ বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে অচিরেই। এজন্যই প্রয়োজন প্রদত্ত বিধানকে প্রতিষ্ঠার জন্য একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করা। যেখানে আর সুযোগ থাকবে না পৃথকভাবে নারী ইস্যুকে কেন্দ্র করে অন্য কোনো অভিসন্ধিকে সোচ্চার করার।