কুরআনের আলোকে মানুষ সৃষ্টি ও আধুনিক বিজ্ঞান


১৩ মার্চ ২০২৫ ১৬:২৮

॥ মনসুর আহমদ ॥
মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কে বিজ্ঞান যা বলেছে, তা মতবাদ বা অনুমান মাত্র, চূড়ান্ত সত্য নয়। শাশ্বত সত্তা আল্লাহ এ ব্যাপারে যা বলেছেন, তাই সন্দেহাতীত (অনংড়ষঁঃব) চরম সত্য। আল্লাহ বলেন, “আমি তো মানুষ সৃষ্টি করেছি ছাঁচে ঢালা শুষ্ক ঠনঠনে মাটি থেকে”। সূরা আল হিজর : ২৬।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, অতঃপর শুক্রবিন্দু থেকে। তারপর তোমাদের করেছেন যুগল; আল্লাহর অজ্ঞাতসারে কেনো নারী গর্ভধারণ করে না এবং প্রসবও করে না”।-সূরা ফাতির : ১১।
মানব সৃষ্টির স্তরসমূহ বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, “আমি তো মানুষ সৃষ্টি করেছি মৃত্তিকার উপাদান থেকে। অতপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে স্থাপন করি এক নিরাপদ আধারে। পরে আমি শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি ‘আলাকে’, অতপর ‘আলাককে’ পরিণত করি পিণ্ডে এবং পিণ্ডকে পরিণত করি অস্থিপঞ্জরে অপর অস্থিপঞ্জরকে ঢেকে দেই গোশ্ত দিয়ে। অবশেষে তা গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টি রূপে। অতএব সর্বশ্রেষ্ঠ স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা।”-সূরা মুমিনুন : ১২-১৪।
এভাবে কুরআনের বহু স্থানে মানুষের স্রষ্টা যে মহান আল্লাহ তা ঘোষিত হয়েছে।
আধুনিক বিজ্ঞানও এ ঘোষণার সত্যতা স্বীকার করেছে। কিন্তু কিছু বিজ্ঞানী ও দার্শনিক এ সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করেন। তারা মনে করেন ক্রমবিকাশ (ঊাড়ষঁঃরড়হ) ধারায় মানুষের সৃষ্টি ও বর্তমান রূপ।
বিবর্তনবাদীদের মতে, বিবর্তন হলো এমন একটি জীববৈজ্ঞানিক ধারণা, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জীবের গাঠনিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ক্রমপরিবর্তনকে বুঝায়। কোনো জীবের বংশধরদের মধ্যে যে ‘জিনরাশি’ ছড়িয়ে পড়ে তারাই বংশপ্রবাহে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে। জিনের ‘পরিব্যক্তি’র মাধ্যমে জীবের নির্দিষ্ট কোনো কোনো বংশধরের নতুন বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব হতে পারে বা পুরনো বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটতে পারে। যদিও একটি প্রজন্মে জীবের বৈশিষ্ট্যের যে পরিবর্তন সাধিত হয়, তা খুবই সামান্য। কিন্তু কালক্রমে জীবগোষ্ঠীতে সেই পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য হয়ে দেখা দেয় এবং এমনকি একসময় তা নতুন ‘প্রজাতির’ উদ্ভবেরও কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এখানে বিজ্ঞানীরা সম্ভবতার কথা বলেছেন কিন্তু এমন হবেই এমন দাবি করতে পারেননি। তারা মনে করেন যে, “স্তন্যপায়ী ও পাখির উদ্ভব হয়েছে সরীসৃপ থেকে, আবার স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে শিম্পাঞ্জী এবং শিম্পাঞ্জী থেকে মানুষের উদ্ভব হয়েছে। বস্তুত তারা বলেছেন যে, কোনো বস্তু আর এক বস্তুতে রূপান্তরিত হতে পারে, এক প্রজাতি অন্য এক প্রজাতিতে পরিণত হতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে তারা কোনো জীব বিজ্ঞানের সাক্ষ্য প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। কিছু পোকা-মাকড় নিয়ে ৫০ বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও তারা কোনো নতুন প্রজাতির জন্ম দিতে পারেনি। ঘোড়ার বংশ বিস্তারকারীরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ঘোড়ার নতুন প্রজাতির উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা চালিয়েছে। ফলে তারা বিভিন্ন আকার প্রকৃতি ও রং-এর ঘোড়া জন্মাতে পেরেছে, কিন্তু সব ঘোড়াই হয়েছে, গরু বা ভেড়া হয়নি। প্রতিটি প্রজাতির পরিবর্তনের জন্য একটি নির্দিষ্ট বংশানুগতির নিয়ন্ত্রক শক্তি রয়েছে। তা না হলে গরিলা, শিম্পাঞ্জী বা বানরকে মানুষে রূপান্তরিত হতে কিসে বাধা দান করল। এগুলো তো লাখ লাখ বছর ধরে একই প্রজাতি থাকল; কিন্তু আজও অন্য প্রজাতিতে পরিণত হলো না। তা হলে কি এটা বলা চলে না যে, কাল্পনিক বিবর্তনবাদী ধারণা স্থায়ী ও সর্বজনীন কোনো বিধান নয়? প্রাণিজগতের এ অবস্থা কি প্রমাণ করে না যে, মূলত প্রত্যেকটি প্রজাতি আলাদা আলাদাভাবে সৃষ্ট এবং প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। বলতে কি কচ্ছপকে দেওয়া হয়েছে শক্ত খোলস, শজারুর দেহকে সাজান হয়েছে সুঁচালু কাঁটা দিয়ে এবং মানুষকে দেওয়া হয়েছে প্রজ্ঞা। উত্তরকালীন সময় টিকে থাকার ও বংশ রক্ষার জন্য এগুলোর প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে, কিন্তু মৌলিকভাবে জীববৈশিষ্ট্যের কোনো পরিবর্তন আসেনি।” (ঐধলরধ ই অরংযধ খবসঁ)।
আসলে আল্লাহ পৃথিবীর সব সৃষ্টজীব আলাদা অলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। বিবর্তিত হয়ে একই প্রাণী থেকে ভিন্ন ভিন্ন জীব পয়দা হয়নি। যেমন ঘোড়া, গাধা, খচ্চর দেহগত দিক দিয়ে প্রায় একই রূপ। কিন্তু এগুলোকে আল্লাহ পৃথক পৃথকভাবে সৃষ্টি করেছেন। এরশাদ হচ্ছে, “তোমাদের আরোহণের জন্যও শোভার জন্য তিনি সৃষ্টি করেছেন অশ্ব, খচ্চর ও গর্দভ এবং তিনি সৃষ্টি করেন অনেক কিছু , যা তোমরা অবগত নও।”-সূরা আন নহল : ৮।
মানুষ যে বিবর্তনের ধারার কোনো এক স্তরে অন্য কোনো প্রজাতি থেকে সৃষ্টি হয়েছেন, তা অবিশ্বাস্য ও অসত্য। মানুষের মাঝে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান, যা বিবর্তনের কোনো স্তরের কোনো জীবের মধ্যে নেই।
“কুরআনের বর্ণনা মতে মানুষকে তার সৃষ্টির মুহূর্ত থেকে চারটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রদান করে সৃষ্টি করা হয়েছে।
প্রথম বৈশিষ্ট্যÑ প্রথমে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে ‘নামসমূহ’ শিক্ষা দিয়েছেন। এ নামসমূহের ব্যাপারে অধিকাংশ তাফসিরকারক এ দিয়ে মানুষের কল্পনাপ্রসূত চিন্তা করার ক্ষমতাকে বোঝাতে চেয়েছেন। অর্থাৎ কোনো জিনিসের অস্তিত্ব অথবা অনস্তিত্বকালে তাকে চিহ্নিত করতে পারে বা সে কল্পনা করতে পারে, যা অন্য কোনো পশু বা জীবের পক্ষে সম্ভব নয়। পশু শুধুমাত্র তার সামনে উপস্থিত বস্তু নিয়েই ভাবতে পারে। গায়েব ও অনস্তিত্বের জগৎ নিয়ে ভাবনার যোগ্যতা শুধু মানুষকে প্রদান করা হয়েছে এবং এ যোগ্যতা দিয়েই মানুষকে সব সৃষ্টির ওপরে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা হয়েছে।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য- দ্বিতীয় স্বতন্ত্র সূচক বৈশিষ্ট্য, যা মানুষকে দেওয়া হয়েছে। সে সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে যে, তা হলো মানুষর মনের বা আত্মার ভালোমন্দের পার্থক্যের সচেতনতা।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য- সচেতনতাবোধের সাথে রয়েছে মানুষের তৃতীয় অনপুম অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য সহজাত প্রবৃত্তির বন্ধন থেকে আংশিক মুক্তি। অর্থাৎ একটি বিশেষ সীমানায় বা পরিমাণে ভালোমন্দ গ্রহণের ইচ্ছার স্বাধীনতা ও দায়িত্ব। কুরআনে মানুষের এ বৈশিষ্ট্যকে অভিহিত করা হয়েছে ‘আমানত’ বা কার্যকর পরিভাষায়। কুরআনে এরশাদ হচ্ছে, “আমি জমিন, আসমান ও পর্বতমালাকে আমানত ভার প্রদানের ইচ্ছা করেছিলাম, কিন্তু এগুলো এরা বইতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলো এবং সে সম্পর্কে ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু মানুষ এই আমানত ভার গ্রহণে রাজি হলো; প্রকৃত পক্ষে সে যদৃচ্ছ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি ও বোকা।” (আল আহযাব : ৭২)।
এ ব্যাপারে সম্পর্কযুক্ত মানুষের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য এবং তা হলো মানুষের আদি কারণ তার পুণ্যাত্মা। এ ব্যাপারে কুরআনে এরশাদ হচ্ছে, “তিনি মানুষের মধ্যে তার রূহ থেকে কছুটা সঞ্চারিত করেছেন।” (হিজর : ২৯)। কোনো পশুর মধ্যে নয় একমাত্র মানুষের মধ্যেই তিনি এ সচেতনতাবোধ ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের ক্ষমতা প্রদান করেছেন। বস্তুত তিনি এ ভাবেই মানবসত্তা সৃষ্টি করেছেন, যা স্বেচ্ছায় আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিতে পারে এবং তাকে চেনার প্রচেষ্টা চালাতে পারে। এ দুটি গুণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে হাদিসে কুদ্সীতে বলা হয়েছে, “আমি ছিলাম এক গুপ্ত ধনভাণ্ডার, তাই আমি পরিচিত হতে চাইলাম, সে উদ্দেশ্যে আমি জগৎ সৃষ্টি করলাম।” দ্বিতীয় হাদিস, “আমার জমিন আসমান আমাকে ধারণ করতে পারে না, কিন্তু আমার মুমিনের হৃদয় আমাকে ধারণ করে।”
উল্লিখিত আয়াত ও হাদিস দুটি অত্যন্ত সঙ্গতিপূর্ণ। মানুষকে এত সব গুণে গুণান্বিত করার কারণ এবং মানুষ সুষ্টির উদ্দেশ্য এ বাণী স্পষ্ট করে তোলে। এসব মনবীয় গুণাবলি বিবর্তনের ফলে সৃষ্ট হতে পারে না। যে মানুষ এত সব বিশেষ বৈশিষ্ট্য ধারণ করে তার সম্ভাবতা উল্লুক থেকে মনুষ সুষ্টির ধারণার সাথে যুক্তিসঙ্গত ও সুসঙ্গত নয়। বরং মানুষ এতসব উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ার কারণ এ ধারণাই অধিক সুসঙ্গত যে, মানব সৃষ্টির সূচনালগ্নে তাকে এসব গুণ সহকারে সৃষ্টি করা হয়েছে।
হয়তো আদিতে মানুষের ভ্রু উঁচু কি নিচু ছিল, তার চিবুক বাইরে ঝুলে ছিল বা ভেতরে টানা ছিল তাতে কিছু আসে যায় না। আমরা কুরআন থেকে মানুষের বাহ্যিক আকার সম্পর্কে যে ধারণা পাই “তাতে হয়ত বা সামান্য পরিবর্তন ঘটতে পারে কিন্তু তার সূচনা থেকে দেওয়া মানবীয় গুণাবলিতে কোনো পরিবর্তন সাধিত হয়নি।” ((ঐধলরধ ই অরংযধ খবসঁ)।
মানুষ বিবর্তনের ফসল নয়। এ সত্য কিছু মানুষ বিশাস করতে না চাইলও স্বয়ং শয়তান বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। যেমন কুরআনে এসেছে, “ইবলিস বলল, আমি তার থেকে উত্তম, তুমি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছ, তাকে (আদম)-কে সৃষ্টি করেছ কাদামাটি থেকে”। (সূরা সোয়াদ : ৭৬)।
বর্তমানকালে কিছু মানুষ বিবর্তন ধারায় সৃষ্টি হয়েছে প্রমাণ করতে কুরআনের একটি আয়াত, “ওয়া খালাক্নাকুম আতওয়ারাÑআর তিনি বিভিন্ন পর্যায়ের (ক্রমবির্তন) মাধ্যমে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন” উল্লেখ করে থাকেন। তাফসির কারক আল্লামা ইউসূফ আলী ‘বিভন্ন পর্যায়’ (আতওযারা) এর ব্যাখ্যা করেছেন কুরআনের অন্য আয়াত থেকে। আল্লাহ বলেন, “আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি মাটি থেকে, তারপর শুক্র বিন্দু থেকে তারপর আলাক থেকে, তার পর পূর্ণাকৃতি মাংসপিণ্ড থেকে, তোমাদের নিকট ব্যক্ত করার জন্য আমি যা ইচ্ছা করি তা এক নির্দষ্ট কালের জন্য মাতৃগর্ভে স্থিত রাখি, তার পর আমি তোমাদেরকে শিশু-রূপে বের করি পরে যাতে তোমরা পরিণত বয়সে উপনীত হও।” (সূরা আল হজ : ৫)।
এখানে মানুষের বিবর্তনের কথা স্পষ্ট করা হয়েছে। যদি মানুষ জলজ উদ্ভিদ বা এককোষী জীব বা বানর থেকে সৃষ্টি হতো তাহলে সে সত্য প্রকাশে আল্লাহর বাধা ছিল কোথায়? মানুষের শারীরিক বিবর্তন হয়েছে সবসময়। একসময় মানুষের দেহ বিরাট ছিল, বিবর্তনের ধারা চালু আছে বলে মানুষের দৈহিক পরিবর্তিত হয়েছে; কিন্তু অন্য কোনো প্রাণী হয়ে যায়নি। বিজ্ঞান বলে প্রতি ত্রিশ বছরে মানব শরীরের সব কোষ বদলে যায়। তাতে কি মানুষটির সত্তা পরিবর্তিত হয়ে যায়? না, যায় না। আমরা যখন শিশু ছিলাম তখন আমাদের দৈহিক গঠন ছিল একরূপ, অবার বৃদ্ধ বয়সে সেই শরীরই অন্যরূপ ধারণ করে, তাতে তো ব্যক্তির পরিবর্তন হয় না।
এ পরিবর্তন ধারা চলতে থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। মানুষের সে সময়ের দেহ বর্তমান দেহ থেকে পরিবর্তিত হবে বটে, কিন্তু ব্যক্তির পরিবর্তন ঘটবে না। বেহেশত বাসীরা সকলেই যুবক থাকবে, তাহলে আমাদের সকলের দেহ যুবক রূপ ধারণ করবে; এরপর বিবর্তন ঘটবে না। তাই ভালো করে বুঝতে হবে জীববিজ্ঞানীদের বিবর্তনবাদ আর কুরআনের বিবর্তনবাদ এক নয়।