বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের অপপ্রচার গুজব : অস্থিরতা তৈরির ভয়ংকর ষড়যন্ত্র

কঠোর অবস্থানে অন্তর্বর্তী সরকার


১৩ মার্চ ২০২৫ ১৫:৪৩

হাসিনাকে আন্তর্জাতিক আদালতে দাঁড়াতেই হবে
॥ ফারাহ মাসুম ॥
রাখঢাক বাদ দিয়ে বাংলাদেশের সংবেদনশীল সেনা প্রতিষ্ঠান নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যম ও প্রোপাগান্ডাধর্মী মিডিয়ার পর এবার ভারতের মূলধারার গণমাধ্যমে ভিত্তিহীন গুজব ছড়ানো শুরু করেছে। ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর রিপাবলিক টিভি ও কলকাতা নিউজের মতো বিজেপিপন্থি মিডিয়া বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ও সেনা প্রতিষ্ঠান নিয়ে নানা ধরনের গুজবকে খবর হিসেবে প্রচার করে আসছিল। আর এর সূত্র হিসেবে বলা হতো গোয়েন্দা ও নির্ভরযোগ্য সূত্র। এবার ইকোনমিক টাইমস ও ইন্ডিয়া টুডের মতো মূলধারার গণমাধ্যমে প্রচার শুরু হয়েছে বাংলাদেশে সেনা অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা পরিচলিত হয়েছে বা আয়োজন হচ্ছে। প্রচারণার মাত্রা এমন এক অবস্থায় পৌঁছে যে, শেষ পর্যন্ত আইএসপিআরকে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রতিবাদ জানাতে হয়েছে। অন্যদিকে মৌলিক প্রতিষ্ঠানের সাথে সাথে পুরো বাংলাদেশকে সামাজিকভাবে অস্থির করে তোলার জন্য যেকোনো ইস্যুতে ইন্ধন দিয়ে তিলকে তাল বানানোর প্রবণতা সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত সামগ্রিক বিষয় নিয়ে অন্তর্বর্র্তী সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে মুখ খোলা শুরু হয়েছে।
সেনা প্রতিষ্ঠান নিয়ে মিথ্যাচার : ভারতের মূলধারার সংবাদপত্র ইকোনমিক টাইমসে পাকিস্তানপন্থি লেফটেন্যান্ট জেনারেলকে নজরদারিতে রাখায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানের চক্রান্ত ঘনীভূত হয়েছে বলে এক খবর প্রচার করা হয়েছে ১০ মার্চ সংখ্যায়। পত্রিকার সাংবাদিক দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী লিখেছেন, পাকিস্তানপন্থি লেফটেন্যান্ট জেনারেলকে নজরদারিতে রাখায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান চক্রান্ত ঘনীভূত হয়েছে।
বাংলাদেশের ডিসিপ্লিন ফোর্সকে উসকে দিতে পত্রিকাটি একজন শীর্ষ লেফটেন্যান্ট জেনারেলের নাম উল্লেখ করে বলেছে, তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল বর্তমান সেনাপ্রধানের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। এ শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা একটি অভ্যুত্থানের সমর্থনের পরিমাপ করার জন্য একটি সভা ডাকেন, কিন্তু সীমিত উপস্থিতি পান। সামরিক গোয়েন্দারা এখন তাকে পর্যবেক্ষণ করছে এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আরও খারাপ হতে পারে। ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েছেন বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা।
১১ মার্চ ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকায় বিষয়টি নিয়ে আরো রং ছড়িয়ে রিপোর্ট করে অভিষেক দে। পত্রিকাটিতে আগের পত্রিকার গুজবের পুনরাবৃত্তি করে বলা হয়, পাকিস্তানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত এক ঊর্ধ্বতন বাংলাদেশি সামরিক কর্মকর্তাকে সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার অভিযোগে নজরদারি করা হয়েছে। আজগুবি তথ্য দিয়ে এতে বলা হয়, কথিত সেনা কর্মকর্তা মার্চের প্রথম সপ্তাহে গুরুত্বপূর্ণ ডিভিশনাল কমান্ডারদের (জিওসি) বৈঠক ডেকেছিলেন। তবে সেনাপ্রধানের সচিবালয় বৈঠকের বিষয়টি জানতে পেরে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়। এরপর গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক থেকে সরে আসেন শীর্ষ কর্মকর্তারা। বলা হয় এ উন্নয়নটি এমন এক সময়ে ঘটে, যখন গত কয়েক মাস ধরে সহিংসতা, ভাঙচুর এবং দাঙ্গার মধ্যে বাংলাদেশ আবার অস্থিরতার সাক্ষী হচ্ছে।
উদ্বেগ সেনা প্রতিষ্ঠানের
ভারতের কিছু গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব প্রতিবেদন নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। গত ১১ মার্চ মঙ্গলবার রাতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক প্রতিবাদলিপিতে এ উদ্বেগের কথা জানিয়ে বলা হয়েছে, সেনাপ্রধানের দক্ষ নেতৃত্বের অধীন সেনাবাহিনী সুসংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ ও সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আইএসপিআরের প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে, দ্য ইকোনমিক টাইমস ও দ্য ইন্ডিয়া টুডেসহ ভারতের কিছু সংবাদমাধ্যমে সম্প্রতি প্রকাশিত একের পর এক ভিত্তিহীন ও মনগড়া প্রতিবেদন গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ওইসব প্রতিবেদনে সেনাবাহিনীর ভেতরে অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা এবং শৃঙ্খলা (চেইন অব কমান্ড) ভেঙে পড়ার কথা বলা হয়েছে। এসব প্রতিবেদন পুরোপুরি মিথ্যা এবং সেগুলো বাংলাদেশ ও এর সশস্ত্র বাহিনীর সুনাম ও স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন করার জন্য পরিকল্পিত অপপ্রচারের অংশ বলে প্রতীয়মান হয়।
প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা স্পষ্টভাবে বলছি যে, সেনাপ্রধানের দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ ও সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে। আমাদের চেইন অব কমান্ড শক্তিশালী রয়েছে এবং জ্যেষ্ঠ জেনারেলরাসহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সব সদস্য সংবিধান, চেইন অব কমান্ড ও বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আনুগত্যে অবিচল রয়েছেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে অনৈক্য বা আনুগত্যহীনতার যেকোনো অভিযোগ পুরোপুরি বানোয়াট ও বিদ্বেষপূর্ণ।’
আইএসপিআর আরো বলেছে, ‘এটা বিশেষভাবে উদ্বেগের যে, দ্য ইকোনমিক টাইমস বার বার এ ধরনের অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। সর্বশেষ এ প্রতিবেদনের মাত্র এক মাস আগেও ২০২৫ সালের ২৬ জানুয়ারি এ গণমাধ্যমে একই ধরনের মিথ্যা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। পেশাগত এ আচরণের কারণে এসব সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশ্য ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন ওঠে। এছাড়া বেশকিছু অনলাইন পোর্টাল ও কয়েকটি অখ্যাত টেলিভিশন চ্যানেল এসব মিথ্যা প্রচার করেছে, যাতে অপপ্রচার আরও তীব্র হয়েছে। মনে হচ্ছে, তারা দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার নীতি মেনে চলার পরিবর্তে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরির হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে।’
প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা এসব সংবাদমাধ্যম; বিশেষ করে ভারতভিত্তিক সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতি ভালো সাংবাদিকতার চর্চা করার এবং যাচাই না করে ও চটকদার সংবাদ প্রকাশ না করার আহ্বান জানাচ্ছি। আশা করা হচ্ছে, এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করার আগে তারা আইএসপিআরের কাছ থেকে মন্তব্য ও ব্যাখ্যা চাইবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়ে সঠিক ও আনুষ্ঠানিক তথ্য সরবরাহ করার জন্য আইএসপিআর সব সময় প্রস্তুত রয়েছে।’
আইএসপিআর বলেছে, ‘দেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা রক্ষার প্রতিশ্রুতিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অবিচল রয়েছে। আমরা সব সংবাদমাধ্যমকে দায়িত্বশীল আচরণ করার এবং মিথ্যা বয়ান প্রচার থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করছি। এসব মিথ্যা তথ্য শুধু অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।’
গৃহীত হচ্ছে না ভারতীয় বয়ান
ভারতীয় মিডিয়ার এ অপপ্রচার কূটনৈতিক মহলও বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করছে। সাধারণত কোনো কূটনীতিক এ ধরনের সংবেদনশীল বিষয়ে মুখ খোলেন না। সাবেক কূটনীতিকদের কেউ কেউ এ বিষয়ে তাদের অভিমত জানিয়েছেন। একসময় ঢাকায় দায়িত্ব পালনকারী আমেরিকান রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম এবং উপরাষ্ট্রদূত জন ডেনিলোভিজ এখন বাংলাদেশ সফর করছেন। তারা নাগরিক সমাজ, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলছেন।
জন ডেনিলোভিজ ভারতের গণমাধ্যমের এ অপপ্রচার প্রসঙ্গে তার এক্স প্রোফাইলে বলেছেন, ‘ভারতীয় ডিসইনফরমেশন ক্যাম্পেইন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে প্রায় অভূতপূর্ব অবনতিতে অবদান রাখছে। আমার ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশি কথোপকথনকারীদের সাথে কার্যত প্রতিটি বৈঠকেই এ বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এ প্রচারণার উদ্দেশ্য অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল করা, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে বিষাক্ত করা এবং হাসিনা সরকারের অপরাধ সংক্রান্ত প্রতিবেদন থেকে সরে আসা। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতির জন্য ভারত সরকার এবং সংস্থার কাউকে দায়ী করার নেই।
তিনি লেখেন, ‘ভারত যদি মনে করে যে তারা নির্বাচনের পরে কেবল মিথ্যা তথ্যের ট্যাপ বন্ধ করতে পারে এবং ভান করতে পারে যে কিছুই হয়নি, তাহলে বলতে হয়, তারা বুঝতে পারে না যে, ৫ আগস্টের পরে তাদের বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা তাদের সুনামকে কতটা ক্ষতি করেছে। পরবর্তী সরকারের পক্ষে এই স্লাইডটি এমন একটি জনসংখ্যার সাথে বিপরীত করা কঠিন হবে, যা ভারতীয় সংস্থার বেশিরভাগকে বন্ধুত্বহীন বলে মনে করে।’
এখন বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের বয়ানকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গ্রহণ করছে না। বাংলাদেশের দায়িত্ব পালনকারী সাবেক রাষ্ট্রদূত মাইলাম বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ঢাকায় দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদিকে উপরাষ্ট্রদূত জন ডেনিলোভিজ ওয়ান-ইলেভেন এবং এর পরের রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসা এবং এর পরের সময়ে দায়িত্ব পালন করেন। ওয়ান-ইলেভেনের পটপরিবর্তনে অন্যতম কুশীলব হিসেবেও অনেকে তাকে চিহ্নিত করেন। তারাই এখন প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন যে, ১৯৭১ সালের মতো ওয়ান ইলেভেনে-আমেরিকার ভূমিকা ভুল ছিল। এ সময়টাতে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের চশমা দিয়ে দেখতো বলে উল্লেখ করা হয়।
২০০৮ সালের পর ২০১৪ সালের নির্বাচন যখন আসে, তখনকার আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা চেয়েছিলেন বাংলাদেশে সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন হোক। তিনি এ ব্যাপারে দিল্লির কর্মকর্তাদের বোঝাতে সেখানে গেলেও তাতে কোনো ফল হয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও যুক্তরাষ্ট্র সেটি চেয়েও শেষ পর্যন্ত দিল্লির হাসিনাকে রাখার বিষয়ে অনমনীয়তার কারণে কিছু করতে পারেনি। ২০২৪ সালে একই চেষ্টা করেছিলেন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। সবার চেষ্টা দিল্লির অনমনীয়তায় ব্যর্থ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এর আগেই যুক্তরাষ্ট্র নিজের চশমাতে বাংলাদেশকে দেখার নীতিতে চলে যায়। এ পরিবর্তনের পর পতিত স্বৈরাচারকে ফেরানোর জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। তবে সংখ্যালঘু নির্যাতন থেকে শুরু করে, বিভিন্ন পেশাজীবীদের উসকে দেয়া, মৌলবাদ শক্তিশালী হওয়ার ধোঁয়া তোলা ইত্যাদি ধরনের বয়ান দিল্লি দেয়ার চেষ্টা করলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেটি গ্রহণ করছে না।
হাসিনাকে আন্তর্জাতিক আদালতে দাঁড়াতে হবে?
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রধান শেখ হাসিনার আমলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে বিস্তারিত প্রতিবেদন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সভায় পেশ করেছেন। ইউএনসিআরের এ সত্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে শেখ হাসিনা ও তার শীর্ষ সহযোগীদের জুলাই-আগস্ট আন্দোলন এবং এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের সুস্পষ্ট প্রমাণাদি লিপিবদ্ধ রয়েছে। জন ড্যানিলোভিজ এ প্রতিবেদন পেশের পরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক আদালতের নির্দেশে ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট দুতার্তেকে গ্রেফতারের পরে বলেছেন, ‘আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি যেদিন বাংলাদেশের সাবেক স্বৈরশাসককে তার শাসনের অপরাধের জন্য দায়ী করা হবে।’
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে রদ্রিগো দুতার্তেকে গ্রেফতার করেছে দেশটির জাতীয় পুলিশ। দুতার্তে মাদকের বিরুদ্ধে তার নৃশংস যুদ্ধে নিহত হাজার হাজার মানুষের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের তদন্তের বিষয় হন।
ড্যানিলোভিজ বলেন, এনফোর্সড ডিসপিয়ারেন্সের বিষয়ে বাংলাদেশের তদন্ত কমিশনের কাজটি দেশের ইতিহাসের অন্যতম অন্ধকার অধ্যায় সম্পর্কে জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার প্রচেষ্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ বিড়ম্বনা নিজ থেকে হারিয়ে যায়নি। এ নিয়ে গঠিত কমিশনটি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টার তৎকালীন বাসভবনে বসেছিলেন, যিনি বার বার বলপূর্বক গুমের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছিলেন এবং যিনি এখনো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তার ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাননি।
ড্যানিলোভিজ বলেন, বলপূর্বক গুমের শিকার এবং তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিশ্বাস করি যে, কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার সাথে সাথে এ কাজ শেষ হওয়া উচিত নয়। যারা বাংলাদেশের পরবর্তী সরকার গঠন করতে চান তাদের উচিত এ অপরাধের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সত্য অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়ার জন্য অগ্রিম প্রতিশ্রুতি দেওয়া।
বিকল্প শক্তির ওপর ভর
এদিকে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে ফেরানোর পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির ওপর ভর করার কৌশল নিয়েছে। আগস্টের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতা গ্রহণের আগেই ভারত হাসিনার বিকল্প হিসেবে দেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলকে বেছে নেয় এবং দলটিকে শর্ত দেয় যে, তারা যদি জামায়াতসহ সকল ধর্মীয় দল হতে নিজেকে আলাদা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ ক,ের তবে ভারত তাদেরকে সরকার গঠনে সবরকম সহযোগিতা করবে।
জানা যায়, এরপর দলটির উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল গোপনে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সাথে দেখা করে এবং কিছু গোপন চুক্তি করে। ফলে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সাথে মুহূর্তের মধ্যে তৈরি হয় দূরত্ব। হঠাৎ করেই ক্ষমতা পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে দলটি ভারতের ইশারায় হাসিনার নিয়োগকৃত রাষ্ট্রপতিকে পরিবর্তনে বাধা দেয়। সেই সুযোগে ৬২৬ আওয়ামী লীগের নেতা পালিয়ে যেতে সুযোগ পান।
এদিকে সংস্কার ইচ্ছুক ইউনূস সরকারকে ক্ষমতা নিয়েই অকার্যকর সরকার করার চক্রান্ত চলতে থাকে। প্রায় সকল দপ্তরই একটি পক্ষ সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত ছাত্রদের চিকিৎসা এবং নিহত ছাত্রদের ক্ষতিপূরণের সকল প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করলেও ড. ইউনূস তাদেরকে কোনো সাহায্যই করতে পারেননি। কিন্তু ড. ইউনূস অত্যন্ত সংযমি এবং কৌশলে সংস্কার কাজ চালিয়ে নিতে চেষ্টা করছেন।
জানা যাচ্ছে, ভারত এখন ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদল করছে। কখনো ধমক দিচ্ছে, কখনো বা নিজেকেই রাষ্ট্রের প্রধান নিয়ন্ত্রক ভাবছে। ঐ দিকে ভারত হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে আবারও প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। অনেকের ধারণা, বড় দলটি যদি ভারতের ফাঁদে পা না দিত তবে অন্য সকল দলকে নিয়ে একটা জাতীয় সরকার গঠন করতে পারতো এবং দেশও শক্তিশালী হতো বলে অনেক পর্যবেক্ষকের ধারণা।
এদিকে ছাত্রদের নতুন দলের সাথে বিএনপির দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। এ দলের বক্তব্য পছন্দ করছে না বিএনপি। জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘খুব পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, আপনারা বিচার ও সংস্কার পেছানোর রাজনীতি করবেন না। পাল্টা কথা আপনাদের বলতে চাই, বিচার ও সংস্কারের প্রতি ঐকমত্য পোষণ করুন, নির্বাচন আমরা আপনাদের করে দিতে সহায়তা করবো। সরকারকে বলবো দ্রুত বিচার ও সংস্কারের রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।’
নাহিদ ইসলাম বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো বলে রাজনৈতিক দল গঠন করেছি। জুলাই অভ্যুত্থানে সংবিধান ব্যর্থ হয়ে গেছে। গণপরিষদের মাধ্যমে নতুন সংবিধান করার ব্যাপারে অগ্রসর হতে হবে।
নাহিদ ইসলাম পরিষ্কার করে বলেন, ‘শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের খুনিদের আসামি করে শত শত মামলা হয়েছে। যদি এর বিচার ছাড়াই আরেকটি সরকার চলে আসে তবে কী নিশ্চয়তা আছে যে আওয়ামী লীগকে আবার পুনর্বাসিত করা হবে না এ বাংলাদেশে।’
আ’লীগ নেতাদের ভারতে আশ্রয়
সম্প্রতি ভারতের দিল্লির প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ার সভাপতি গৌতম লাহিড়ী এক বিদেশি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, আওয়ামী লীগের প্রায় ৪৫ হাজার নেতাকর্মী এখন ভারতে অবস্থান করছেন। তিনি দাবি করেছেন, ভারতে আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বেশিরভাগই কলকাতায় অবস্থান করছেন।
গৌতম লাহিড়ী দিল্লি প্রেস ক্লাবের সভাপতি হিসেবে ভুল তথ্য প্রদান করার কথা নয়। তাহলে কি এ কারণেই ভারত সরকার বাংলাদেশিদের সেদেশের ভিসা ইস্যু করা থেকে বিরত রয়েছে? কারণ ৪৫ হাজার তো কম সংখ্যা নয়। কলকাতা শহর ও আশপাশের এলাকায় অলিগলিতে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বিচরণ দেখতে পাওয়ার কথা। ভারত সরকারই কি তাদের সুরক্ষা দিতে চাইছে নাকি বাংলাদেশিরা সেদেশে গিয়ে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের দেখে বাংলাদেশে জানাতে না পারে?
প্রশ্ন উঠছেÑ বিজেপি সরকার, তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্গখ্যাত পশ্চিমবঙ্গে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে ইচ্ছাকৃতভাবে রাজ্যটির অর্থনীতি দুর্বল করছে কিনা? এটা নিশ্চিতভাবেই বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, প্রতি বছর ভারত সফরকারী ১৮-২০ লাখ বাংলাদেশির সিংহভাগের গন্তব্যই থাকে কলকাতা। আর এ রাজ্যের অর্থনীতিতেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
আওয়ামী লীগের নেতা নেত্রীদের ভারতে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস। তিনি স্কাই নিউজের সাথে সাক্ষাৎকারে পরিষ্কার বলেন, হাসিনাকে তার অপরাধের জন্য বিচারের মুখে দাঁড়াতেই হবে। ভারত তাকে সেখানে আশ্রয় দিয়ে যা খুশি বলার সুযোগ দেয়া কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত হচ্ছে না।