উৎসবের আমেজে রমজান
১৩ মার্চ ২০২৫ ১৫:৩০
॥ শহীদুল ইসলাম ॥
স্বাধীন বাংলাদেশে এমন দৃশ্য কখনো দেখেনি দেশের মানুষ। পবিত্র মাহে রমজানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেজেছে বর্ণিল সাজে, ইফতারে আনা হয়েছে উৎসবের আমেজ। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব পাল্টে দিয়েছে বিগত ৫৪ বছরের দৃশ্যপট। এবারই প্রথম এমন উৎসবের আমেজে পালিত হচ্ছে রহমত, বরকত, নাজাতের মাস মাহে রমজান। বিগত স্বৈরাচারী সরকার বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠনকে নির্বিঘ্নে রোজা পালন করতে দেয়নি; করতে দেয়নি সম্মিলিতভাবে ইফতারের আয়োজন বা ইফতার পার্টি। এবার কোনো বাধা নেই, কারো গোয়েন্দা নজরদারি নেই। আছে সর্বত্রই উৎসবের আমেজ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের অধিকাংশ পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এবার রমজানের বর্ণিল আয়োজন ছাত্রসমাজের মাঝে সৃষ্টি করেছে নতুন উদ্দীপনা। তাকওয়াভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় রমজান যে অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করতে পারে, সে ধারণা নতুন করে পাবে তরুণসমাজ এবং সাধারণ মানুষ।
পবিত্র রমজানে বর্ণিল সাজে সজ্জিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। রঙিন ব্যানার, আলোকসজ্জা ও আলোকিত গেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে তৈরি করেছে নতুন আবহ। উৎসবের আমেজে রোজা পালন করছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলই সাজানো হয়েছে রংবেরঙের ঝাড়বাতিতে। মূল ফটকের সামনে তৈরি করা হয়েছে রঙিন গেটÑ যেন রমজানকে বরণ করে নেওয়া হচ্ছে। প্রথম রমজান থেকেই এসব করা হয়েছে।
বিকাল হলেই প্রতিদিন ছোট-খাটো ইফতার বাজারে পরিণত হয় ঢাবির হলপাড়া। এসব অস্থায়ী দোকানে ভাজা-পোড়া, ফলমূল, শরবত, মিষ্টিসহ ইফতারের যাবতীয় পণ্য বিক্রি হয়। আগের তুলনায় এবার বিক্রিও ভালো বলে জানান বিক্রেতারা। ইফতারি কিনতে বিকাল থেকেই থাকে শিক্ষার্থীদের ভিড়। আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকেও টিএসসি অথবা মল চত্বরে এসে পরিবারসহ ইফতার করছেন অনেকে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলের ভেতরে দোকান, হাকিম চত্বর, গ্রন্থাগারসংলগ্ন দোকান, টিএসসিসহ একাধিক এলাকায়ও বিক্রি হয় ইফতারসামগ্রী।
ঢাবির জিয়া হলে ৩৬ বছর ধরে নিরাপত্তাকর্মীর চাকরি করা ফজলুল হক শিকদার একটি দৈনিককে বলেন, ‘আমি ৩৬ বছর ধরে হলে চাকরি করি। কিন্তু এত সুন্দর রমজান দেখার সৌভাগ্য হয়নি। এ বছর সাজানোটা অনেক ভালো হয়েছে।’ এ এফ রহমান হলের শিক্ষার্থী ইমরান বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রমজানের যে আমেজ, সেটা আমাদের মাঝে দেখা যায়নি। রমজানে ছাত্রলীগের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রোগ্রাম থাকায় একাডেমিক ক্লাস, ক্লাস শেষে প্রোগ্রাম করা কষ্টকর হয়ে যেত। এবার মোটামুটি সবার মাঝেই রমজানের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। হলের রুমে শিক্ষার্থীরা সুন্দরভাবে থাকতে পারছে। সব মিলিয়ে আগের থেকে ভিন্নতা এসেছে।’
ঢাবি শিক্ষার্থীরা জানান, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবারের রমজানে আলাদা একটা আমেজ পাওয়া যাচ্ছে, যেটা আগে ছিল না। জুলাই-পরবর্তী সময়ে পরিবর্তন এসেছে। আবাসিক হলগুলোয় শিক্ষার্থীরা দলবদ্ধ হয়ে ইফতার আয়োজন করছে। আনন্দ-অনুভূতি ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। আগে দেখা যেত ইফতার মাহফিলগুলোকেও রাজনৈতিক চাদরে আবৃত করা হতো। এবার রমজান উপলক্ষে হলগুলো সাজানো হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে। এছাড়া কিছু কিছু রাজনৈতিক সংগঠনও ইফতারের আয়োজন করছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে। কিন্তু ফ্যাসিবাদী আমলে রমজান মাসেও দিনে রাজনৈতিক প্রোগ্রামে ডেকে নিয়ে যাওয়া হতো, আবার রাতে ছিল গণরুম-গেস্টরুম, যা এখন নেই।’
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উদ্যোগে মাসব্যাপী ইফতার বিতরণ কর্মসূচি চলছে। এই কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা গেছে যা নতুন আমেজ তৈরি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি বিভিন্ন বিভাগ ও ফ্যাকাল্টির শিক্ষার্থীরা জমায়েত হন এই ইফতার বিতরণ অনুষ্ঠানে। আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতিদিনের এই ইফতার মাহফিল শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। যাতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভ্রাতৃত্ববোধ, সামাজিক বন্ধন এবং একাত্মতা আরো দৃঢ় হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) অধ্যয়নরত ১২ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ইফতারের আয়োজন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত ৩ মার্চ দ্বিতীয় রোজায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে এ আয়োজন করা হয়। আসরের নামাজের পর থেকেই শিক্ষার্থীরা দলে দলে কেন্দ্রীয় মসজিদে আসতে শুরু করেন। এ সময় মসজিদের ভেতরে এবং মসজিদসংলগ্ন বাগানে তারা ইফতারির জন্য সারিবদ্ধভাবে বসেন। এছাড়া নারীদের জন্য মসজিদের বাগানে আলাদাভাবে ইফতারির ব্যবস্থা করা হয়। এতে মসজিদ প্রাঙ্গণে তৈরি হয় এক উৎসবমুখর পরিবেশ।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ইফতারে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মাঈন উদ্দিন খান (প্রশাসন), উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মোহা. ফরিদ উদ্দিন খান (শিক্ষা), রেজিস্ট্রার ইফতেখারুল আলম মাসউদ, জনসংযোগ প্রশাসক অধ্যাপক আখতার হোসেন মজুমদার প্রমুখ।
সার্বিক বিষয়ে জনসংযোগ প্রশাসক অধ্যাপক আখতার হোসেন মজুমদার বলেন, ‘আমরা আজ প্রায় সাড়ে ১১ হাজার থেকে ১২ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ইফতার আয়োজন করেছি, যা গতকালের তুলনায় তিনগুণ। আমরা আশা করছি, আজ সব ঠিকঠাক মতো হবে। এজন্য সবার সাহায্য প্রয়োজনÑ যাতে কোনো উচ্ছৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি না হয়।’
প্রথমবারের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগে মাসব্যাপী ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। রোজার প্রথম দিন ২ মার্চ ৪ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ইফতারের আয়োজন করা হয়। কিন্তু আয়োজনের তুলনায় অধিক রোজাদার উপস্থিত হওয়ায় ইফতারে সঙ্কট দেখা দিলে শিক্ষার্থীদের ভাগাভাগি করে নিতে দেখা গেছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ইফতার আয়োজন চলবে রমজান মাসব্যাপী। এছাড়া হলগুলোসহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবন ও স্থাপনায় করা হয়েছে আলোকসজ্জা, লাগানো হয়েছে আহলান সাহলান মাহে রমজানসহ রমজানকে স্বাগত জানানোর ব্যানার, ফেস্টুন এবং রমজানকেন্দ্রিক কুরআনের আয়াত, হাদিস লেখা পোস্টার। এসব ব্যতিক্রম সহজেই চোখে পড়ার মতো, যা আগে কখনো দেখেনি শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের শের-ইবাংলা ছাত্রাবাস। শুধু ভারতবিরোধী পোস্ট দেওয়ার অপরাধে এ ছাত্রাবাসে শিবির ট্যাগ দিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে আবরার ফাহাদকে শহীদ করেছিল ছাত্রলীগের বর্বর সন্ত্রাসীরা। তারপর থেকে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও এখানে ধর্মচর্চা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। ছিল ট্যাগিংয়ের ঝুঁকি। অথচ এবার রমজানে রঙিন আলোয় অপরূপ সাজে সেজেছে শহীদ আবরার ফাহাদের সেই ছাত্রাবাস। টাঙানো হয়েছে বিভিন্ন আয়াত হাদিসের বাণীও। একইভাবে সেজেছে বুয়েটের অন্য ছাত্রাবাসগুলোও, যা নিয়ে বেশ উৎফুল্ল শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসজুড়েই দলবদ্ধভাবে শিক্ষার্থীদের ইফতারের আয়োজন করতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় মসজিদে প্রতিদিন চলছে ইফতারের আয়োজন। নেই কারো বাধা, নেই কারো রক্তচক্ষুর ভয়। তার পরিবর্তে আছে উৎসবের আমেজ।
সারা দেশের অধিকাংশ পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এবারের রমজানে হয়েছে এ বর্ণিল আয়োজন, যা ছাত্রসমাজের মাঝে সৃষ্টি করেছে নতুন উদ্দীপনা। রোজা যে উৎসবের মতো করেই পালন করতে হয়, তা অন্যান্য মুসলিম দেশ চর্চা করলেও বাংলাদেশ দেখছে এবারই প্রথম। আর এটা সম্ভব হয়েছে ছাত্র-জনতার ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদীদের পলায়নের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট নতুন বাংলাদেশে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সবাই এবার উৎসবের আমেজে একের পর এক ইফতার পার্টির আয়োজন করছে, যা বিগত ১৬ বছরে ছিল নানা প্রতিবন্ধকতায় ভরা। একত্রে ইফতারের আয়োজন করলে জঙ্গী নাটক সাজিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দিয়ে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হতো। এবার তার বিপরীত। এটা সম্ভব হয়েছে জুলাই বিপ্লবে বদলে যাওয়া বাংলাদেশে।
প্রতিবার রমজান আগমনকে কেন্দ্র করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি করা এদেশের ব্যবসায়ীদের একটা মজ্জাগত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যদিও অন্যান্য মুসলিম দেশে রমজান এলে অধিক সওয়াবের আশায় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। তবে এবারের রমজানে কিছু ব্যতিক্রম দেখা গেছে। ভোজ্যতেলসহ কয়েকটি পণ্যের সিন্ডিকেট সরকার ভাঙতে না পারায় কিছু অস্বস্তি থাকলেও এবার অধিকাংশ পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। বিগত বছরগুলোয় সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও অন্য নেতারা বাজার সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত থাকার কারণে দ্রব্যমূল্য রমজানে বাড়তো লাগামহীনভাবে। এবার তারা নেই। ফলে পাল্টে গেছে বাজার ব্যবস্থাপনা। আর তাতেই দ্রব্যমূল্যে ফিরে এসেছে স্বস্তি।