সংস্কার ও সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার বিতর্ক
৬ মার্চ ২০২৫ ১২:৩৭
রাষ্ট্র, সরকার, জনগণ ও রাজনৈতিক দল যখন সক্রিয় থাকে, তখন স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতি ও রাজনৈতিক ময়দানও তৎপর থাকে। বাংলাদেশেও তাই রাষ্ট্র সরকার ও রাজনীতি খুবই সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক থেকে একটি বড় রাষ্ট্র; অপরদিকে ভৌগোলিক দিক থেকেও একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। তাই বাংলাদেশে সরকার ও রাজনীতি নিয়ে দেশের ভেতরে জনগণ যেমন সতর্ক ও সচেতন, তেমনিভাবে আন্তর্জাতিক মহলও গুরুত্ব দিয়ে নজর রাখছে। বাংলাদেশের জনগণ খুবই সচেতন ও তৎপর একটি জনগোষ্ঠী। তাই আজ থেকে দেড়শত বছর আগেই দক্ষিণ ভারতের প্রাজ্ঞ রাজনীতিক গোপালকৃঞ্চ গোখলে বলেছিলেন, “What Bengal thinks today, India thinks tomorrow.” অর্থাৎ ‘বেঙ্গল আজ যা ভাবে, ভারত তাই আগামীকাল ভাববে’। এটা তিনি বলেছিলেন এ কারণে যে, বাংলার জনগণ সবসময় খুবই রাজনীতি সচেতন ছিলেন। বিগত একশত বছরের রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামেও বাংলাদেশের জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রতিফলন দেখা যায়।
বিগত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশে এক ফ্যাসিবাদী শাসক ও ফাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটে। তারপর দেশপ্রেমিক জনগণের সমর্থনে একটি অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণ করে। গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন নিয়েই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। দায়িত্ব গ্রহণকালে এ সরকারের কোনো নির্দিষ্ট মেয়াদ ঘোষণা করা হয়নি। সরকার গঠনের পর তাদের ওপর একটার পর একটা দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। তার মধ্যে অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্র ও সরকারের সর্বস্তরের সংস্কার করা। আর রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে বিগত কয়েক দশক ধরেই বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয়েছে। কিন্তু বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারগুলো তাতে কোনো কর্ণপাত করেনি। সংস্কারের দাবিটি জোরালো হয়েছে। কারণ বাংলাদেশের জন্য ১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল, সে সংবিধান দিয়ে একটি আধুনিক রাষ্ট্র চলতে পারে না। দেশের রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবী মহল একমত যে, ১৯৭২ সালের সংবিধান দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চলতে পারে না। একটি আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনায় উপযোগী নয় এমন একটি সংবিধান দিয়ে বাংলাদেশ পরিচালনা করা হচ্ছে। তাই বার বার দেশে স্বৈরাচার সৃষ্টি হচ্ছে ও স্বৈরাচারী শাসন জাতির ওপর চেপে বসছে। তাই দেশ পরিচালনার জন্য ১৯৭২-এর পুরনো সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন আজ গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। নয়া সংবিধান প্রণয়নের পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং বিভাগেও সংস্কারের দাবি উঠেছে। তাই দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজসহ আপামর জনসাধারণের দাবি- নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও সংস্কার শেষেই নির্বাচন করা হোক।
কিন্তু দেশের অন্যতম বৃহত্তম দল সাধারণ জনগণের এ দাবির সাথে ভিন্নমত পোষণ করছে। তারা প্রতিনিয়তই বলে যাচ্ছে, কোনোরকম তথা নামমাত্র সংস্কার করেই নির্বাচন দেয়া হোক এবং তা জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অবশ্য অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি ও অন্তর্বর্তী সরকারও চাইছিছে আগে সংস্কার ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন, তারপর জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কিন্তু একটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকের গত ৪ মার্চের লিড নিউজের খবর হচ্ছে সংসদের আগে হচ্ছে না স্থানীয় নির্বাচন।
ফার্স্ট নাকি সেকেন্ড রিপাবলিক
নয়া সংবিধান প্রণয়ন ও সংস্কারের দাবির পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন এক বিতর্ক আসছে রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করা নিয়ে। কোন পর্যায়ের রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করা হবে, সেটা ফার্স্ট রিপাবলিক নাকি সেকেন্ড রিপাবলিক- এ নিয়ে বিতর্ক চলছে। বিশেষ করে অভ্যুত্থানের নায়ক তরুণদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি তাদের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার ঘোষণার পর এ বিতর্ক জোরালো হয়েছে। তাদের সেকেন্ড রিপাবলিক ঘোষণার একদিন পর বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের পক্ষ থেকে একটি প্রতিক্রিয়া দেয়া হয়েছে। তিনি বলেছেন, সেকেন্ড রিপাবলিক কী, এখনো বুঝি নাই। অপরদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহারও একটি অভিমত পেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, যেখানে দেশে এখনো ফার্স্ট রিপাবলিকই গঠন করা যায়নি, সেখানে সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার দাবি অযৌক্তিক।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের তরুণ নেতাদের উদ্যোগে গঠিত নয়া রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) তাদের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়েছে, তাদের লক্ষ্য হচ্ছে দেশে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা করা। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে এ ঘোষণা দিয়েছেন দলটির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম।
ঐদিনের সমাবেশে নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সূচনা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদের সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সব সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য।’
সেকেন্ড রিপাবলিক কেমন হবে, তার রূপরেখাও লিখিত বক্তব্যে তুলে ধরেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় গড়ে তোলা এবং সেগুলোর গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে তাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার। এর মধ্য দিয়েই একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়া যাবে বলে উল্লেখ করেন নাহিদ ইসলাম।
জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ বলেন, তারা এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ চান, যেখানে সমাজে ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বিভেদের বদলে ঐক্য, প্রতিশোধের বদলে ন্যায়বিচার এবং পরিবারতন্ত্রের বদলে মেধা ও যোগ্যতার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠিত হবে। তাদের রাজনীতিতে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কোনো স্থান হবে না।
সেকেন্ড রিপাবলিকে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরকে মূলধারায় তুলে আনা হবে বলে জানান নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমাদের রিপাবলিকে সাধারণ মানুষ, একমাত্র সাধারণ মানুষই হবে ক্ষমতার সর্বময় উৎস। তাদের সব ধরনের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকারের শক্তিশালী সুরক্ষাই হবে আমাদের রাজনীতির মূলমন্ত্র। আমরা রাষ্ট্রে বিদ্যমান জাতিগত, সামাজিক, লিঙ্গীয়, ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও বৈচিত্র্য রক্ষার মাধ্যমে একটি বহুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ করতে চাই। আমাদের রিপাবলিক সব নাগরিককে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে শক্তিশালী সুরক্ষা প্রদান করবে। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর কোনো অংশকেই অপরায়ন করা হবে না; বরং রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে সমান গুরুত্ব প্রদান ও সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।’
জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে বিপথে পরিচালিত করবেন না : ফরহাদ মজহার
সেকেন্ড রিপাবলিক নিয়ে মন্তব্য করে ফরহাদ মজহার তার ভেরিফায়েড ফেসবুকে এক পোস্টে বলেছেন, ‘দয়া করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে বিপথে পরিচালিত করবেন না।’ গত ২ মার্চ রোববার রাত ৮টা ৫৮ মিনিটে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে তিনি বলেন, “একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো গণপরিষদ নির্বাচন হয়নি। ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও অভ্যন্তরীণভাবে বাংলাদেশের জনগণ নিজেরা গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের জন্য একটি গঠনতন্ত্র (Constitution) প্রণয়ন ও রাষ্ট্র গঠন করতে পারেনি। ড. কামাল হোসেনের মুসাবিদা করা ও পদ্মশ্রী আনিসুজ্জামানের সংস্কৃত ও অর্ধতৎসম শব্দে ভারাক্রান্ত ইংরেজ সাহেব ও হিন্দু পণ্ডিতের তৈয়ারি অবোধ্য বাংলায় লেখা তথাকথিত বাহাত্তর সালের সংবিধান বাংলাদেশের জনগণের ওপর দিল্লি চাপিয়ে দিয়েছিল।
অর্থাৎ বাংলাদেশের ইতিহাসে বাংলাদেশের জনগণ কখনোই প্রথম বা ‘ফার্স্ট রিপাবলিক’ গঠন করতে পারেনি। যেখানে প্রথম রিপাবলিকই গঠন করা যায়নি, সেই ক্ষেত্রে জুলাই গণভ্যুত্থানের পর আকস্মিক ভাবে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ গঠনের দাবি অযৌক্তিক, অর্থহীন এবং অনৈতিহাসিক। তাছাড়া পাশ্চাত্যে; বিশেষত ফরাসি দেশের ইতিহাসে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’-এর ইতিহাস চরম ব্যর্থতার ইতিহাস। তারপরও সেকেন্ড রিপাবলিকের দাবি তোলার ওটাই কারণ: বাহাত্তরে দিল্লির চাপিয়ে দেওয়া সংবিধানকে বৈধতা দেওয়া, দিল্লির তাঁবেদারি করা।
তিনি আরও বলেন, ছাত্র-তরুণরা পরিষ্কারভাবে সবসময়ই বাংলাদেশের জনগণের জন্য নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধানের কথা বলেছেন। জনগণও নিজেরা নিজেদের জন্য নতুন গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র (Constitution) প্রণয়ন করতে চায়।
প্রজাতন্ত্র (Republic) ) আর গণতন্ত্র (Democracy) কি সমার্থক? না। ছাত্র-তরুণরা কি গণতন্ত্র চান না? তাই কি? তাহলে কথা নাই বার্তা নাই ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’-এর কথা বলা হচ্ছে কেন? তাও আবার ইংরেজিতে। আমরা কি ফরাসি নাকি ইংরেজ?
পোস্টের শেষে তিনি অনুরোধ রেখে বলেন, দয়া করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে বিপথে পরিচালিত করবেন না।”
সেকেন্ড রিপাবলিক কী, এখনো বুঝি নাই: মির্জা আব্বাস
‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ কী, তা বোঝেন না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বিএনপির এ নেতা বলেন, ‘এখন নতুন দল এসেছে, আপনারা সাবধান থাকবেন। আমি কিন্তু তাদের স্লোগান বুঝি না। আমি কিন্তু বুঝি নাই কাকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে। আমি এখনো বুঝি নাই সেকেন্ড রিপাবলিক কী। কী বোঝায়, আপনারা বুঝেছেন কি না, জানি না? অর্থাৎ একটা উছিলা ধরে জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে। দয়া করে খেয়াল রাখবেন।’
গত ২ মার্চ রোববার রাজধানীর লেডিস ক্লাবে বিএনপি আয়োজিত আলেম-ওলামা ও এতিম মাদরাসার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক ইফতার মাহফিলে মির্জা আব্বাস এ কথা বলেন।
নির্বাচন প্রসঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণে সহায়তা করবে। জাতীয় নির্বাচনে গণপরিষদ নির্বাচন ও সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে হতে পারে সেই দাবিটা আমরা জানাচ্ছি। এর মাধ্যমেই নতুন কাঠামো এবং নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।’ গত ৪ মার্চ মঙ্গলবার ঢাকার রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের কবর জিয়ারত করার পর এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এসব কথা বলেন।
সেকেন্ড রিপাবলিক কি
কিন্তু সেকেন্ড রিপাবলিক বলতে প্রকৃতপক্ষে তারা কী বোঝাতে চাইছেন, সেটি অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ধারণাটি ফ্রান্সের ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। পোল্যান্ড, কোস্টারিকাসহ আরও কয়েকটি দেশের ইতিহাসের সঙ্গেও মিশে আছে এটি। এটি এমন একটি রাজনৈতিক ধারণা, যা বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সার্বিকভাবে এমন ধারণায় কোনো দেশে পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থার বদল ঘটিয়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বা শাসনকাঠামো গ্রহণ করাকে বোঝায়। বিপ্লব, অভ্যুত্থানসহ নানাভাবেই আসতে পারে এমন পরিবর্তন।
উদাহরণ হিসেবে ইউরোপের দেশ ফ্রান্সের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যায়। এটি একসময় রাজতন্ত্রের অধীন ছিল। ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত ফরাসি বিপ্লব চলে। এর মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। তবে বিপ্লব চলার মধ্যেই ১৭৯২ সালে ফ্রান্সে প্রথম রিপাবলিক ঘোষণা করা হয়।
ফ্রান্সে ১৮০৪ সাল পর্যন্ত প্রথম রিপাবলিক টিকে ছিল। এরপর আবার রাজতন্ত্র শুরু হয়। এ পর্ব চলে ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত। ওই বছর ফ্রান্সে দ্বিতীয় রিপাবলিক ঘোষণা করা হয়। এটি টিকে ছিল ১৮৫২ সাল পর্যন্ত। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হলেও ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ফ্রান্সের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। দফায় দফায় শাসনব্যবস্থা বদলে ফ্রান্সে এখন চলছে পঞ্চম রিপাবলিক।
‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বলতে জাতীয় নাগরিক পার্টি আসলে কী বোঝাতে চাইছে, এ বিষয়ে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব জানান, এ ভূখণ্ডের মানুষের সব লড়াই একীভূত করে মানুষের আকাক্সক্ষার ভিত্তিতে সংবিধান ও রাষ্ট্র পুনর্গঠন ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বলতে এটিই বোঝাচ্ছেন তারা।
আরিফুল ইসলাম বলেন, “রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে নাগরিকরা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জনগণের রক্ষক হয়। এ পরিবর্তনগুলো করতে হলে সংবিধানে খুব র্যাডিকেল পরিবর্তন প্রয়োজন। এটিকেই আমরা ‘সেকেন্ড রিপাবলিক বলছি।”
অবশ্য ফরহাদ মজহার সেকেন্ড রিপাবলিকের সরাসরি দ্বিমত পোষণ করে কঠিন কথা বলেছেন। তিনি বলেন, বাহাত্তরের সংবিধান দিল্লি বাংলাদেশের জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। তিনি বলেন, ছাত্র-তরুণরা একটি নতুন সংবিধানের কথাই বলছেন। বাংলাদেশের জনগণও নিজেদের জন্য একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করতে চায়।
স্বৈরতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতির অবসানে সর্বাগ্রে প্রয়োজন নয়া সংবিধান
সর্বোপরি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত হচ্ছে একটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করতে হলে ফার্স্ট রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করি বা সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করি না কেন, নয়া সংবিধান প্রণয়ন করতেই হবে। কারণ বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান ও রাজনৈতিক যে বন্দোবস্ত রয়েছে, তা দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বর্তমানের সংবিধানের আওতায় রাষ্ট্র চললে দেশে বার বার স্বৈরাচার তৈরি হবে আর ঐ স্বৈরাচারদের মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদই চলবে। তাই তরুণ রাজনৈতিক নেতারা যে নয়া সংবিধান প্রণয়ন করে একটি নুতন রিপাবলিকের কথা বলছেন, তার সাথে দেশপ্রেমিক জনতা ও বুদ্ধিজীবীদের তেমন কোনো মতবিরোধ নেই। কেউ রাষ্ট্র ও সরকারের সংস্কার করার কথা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের নেতারা বলছেন সেকেন্ড রিপাবলিক, আর কেউ বলছেন ফার্স্ট রিপাবলিকই হয়নি, তাই সেকেন্ড রিপাবলিক নয় নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে ফার্স্ট রিপাবলিক আগে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবে ফ্যাসিস্ট ও ফ্যাসিস্টদের দোসর ব্যতীত সবাই একমত বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্মাণ করে এগিয়ে নিতে হলে নয়া সংবিধান প্রণয়ন করে রাষ্ট্র ও সরকারের আমূল সংস্কার করতে হবে। বাংলাদেশে আপামর জনগণের বিশ্বাস ও চেতনার ভিত্তিতেই প্রণয়ন করতে হবে নয়া সংবিধান। এছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।