সম্পাদকীয়

বিপ্লবের সুফল পেতে সংবাদমাধ্যমের গুরুত্ব অনস্বীকার্য


৬ মার্চ ২০২৫ ১২:১৭

মানুষের চিন্তার রাজ্যে বিপ্লব ঘটিয়ে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও দেশ গড়তে গণমাধ্যমের ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত। এক্ষেত্রে অবহেলার ফলাফল তাৎক্ষণিক প্রত্যক্ষ করা যায় না। কিন্তু যখন বিরূপ ফল আসা শুরু হতে থাকে তা ঠেকানো সম্ভব হয় না। অনেকটা কিডনি রোগের মতো, ধরা পড়ে শেষ মুহূর্তে। তখন চিকিৎসা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষের ইতিহাস থেকে নিয়ে ২০২৪-এর গণআন্দোলন এবং এর ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মূলধারার জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকাগুলো ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। হাসিনা ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে প্রথম থেকেই পত্রিকাগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে। অনেক সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছে। সাংবাদিকদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে, অনেককে হত্যা করেছে, দেশছাড়া করেছে। জেল-জুলুম রিমান্ডের মাধ্যমে তার পক্ষে নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। এর উল্টোটাও ঘটেছে, অর্থাৎ দেশে-বিদেশ অনেক মিডিয়া ও সাংবাদিক হাসিনার নিকট থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে তার পক্ষে মিথ্যা, ভিত্তিহীন তথ্য পরিবেশন করে জনমতকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু সাহসী ও সৎ সাংবাদিকদের ভূমিকার কারণে তা ব্যর্থ হয়েছে। ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর হাসিনার দেশি-বিদেশি দোসররা; বিশেষ করে ভারতীয় মিডিয়া অপপ্রচারের যে বাণপ্রবাহ শুরু করেছিল, তা রীতিমতো আতঙ্কজনক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হালে পানি পায়নি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পক্ষের সাংবাদিক ও মিডিয়াকর্মীদের বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের মূলধারার রাজনৈতিক শক্তির মিডিয়াকর্মী ও সাংবাদিকরা এ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন শত প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে। সাংবাদিক ও মিডিয়াকর্মীদের কর্মক্ষেত্রে আর্থিক নিরাপত্তা, মর্যাদা ও পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনার অবস্থা খুবই করুণ। আদর্শ প্রচার ও প্রসারের ভূমিকা মূল্যায়নের চেয়ে অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো মনে করে। প্রকৃত-পেশাদার দক্ষ সাংবাদিকদের মূল্যায়ন না করার খেসারত হিসেবে মিডিয়াগুলো থেকে যথাযথ ফিডব্যাক না পাওয়ার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় দিন দিন অবস্থার অবনতি ঘটছে। অনেক বড় বড় রাজনৈতিক দল, যারা দীর্ঘসময় দেশ শাসন করেছে, তাদের অবস্থা অনেকটা ত্রাহি ত্রাহি। পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ মিডিয়া বিকাশে ভূমিকা পালন না করে, নিয়ন্ত্রণের ভুল পলিসি নেয়ার ফলাফল পেয়েছে দেড় দশক পর। অন্য আরেকটি রাজনৈতিক দল, যারা আওয়ামী লীগের আগে ক্ষমতায় ছিল তাদের ভবিষ্যৎও খুব ভালো বলে মনে করছেন না রাজনীতি বিশ্লেষকরা। কারণ মিডিয়ার সাথে দূরত্ব এবং অবহেলার কারণে মেধা বিকাশে দিন দিন পিছিয়ে পড়েছে দলটি। তাদের ভবিষ্যৎ সঙ্কট প্রকট হচ্ছে। ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে তারা সংবাদমাধ্যমকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। নেতাদের অনেকেই বলতেন, ‘ক্ষমতায় নেবে জনগণ সংবাদপত্র, টিভি, মিডিয়ার কী প্রয়োজন।’ তাদের অনেকে মনে করেন, ইন্টানেটের যুগে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব থাকলে পত্রিকার প্রয়োজন নেই। তবে বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপ বলছে অন্যকথা। তরুণরা অনলাইনে বেশি সময় কাটালেও, সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতার বিচারে আস্থা রাখেন কাগজে ছাপা সংবাদপত্রের ওপর। ‘ফ্যাক্টরস এফেক্টিং ট্রাস্ট ইন নিউজ মিডিয়া অ্যামাং ইয়াং পিপল ইন বাংলাদেশ’-এর জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করে আমরা বলতে পারিÑ ছাপানো পত্রিকা এবং তার অনলাইন ভার্সন আধুনিক দুনিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে খুবই জরুরি। তবে মেধা বিকাশ ও চিন্তার জগতে ছাপানো সংবাদের প্রভাব কোনোদিন শেষ হবে না।
তাই আমরা মনে করি, বিপ্লবের সুফল থেকে নিয়ে সব ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। নতুন বাংলাদেশ গড়ার নেতৃত্বে ভূমিকা পালনে এগিয়ে থাকতে চাইলে অবশ্যই সংবাদমাধ্যমকে শক্তিশালী করতে হবে। প্রিন্ট ও অনলাইন ভার্সন- দুই ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকতে হবে। সংবাদমাধ্যমের শ্রীবৃদ্ধির সাথে সাথে সাংবাদিকদের পেশাগত দক্ষতা বাড়াতে সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা ও পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।