আহলান সাহলান মাহে রমজান


২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৩:৫০

সোনার বাংলা ডেস্ক: মুসলমানদের সংযম সাধনার মাস পবিত্র রমজান। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম ফরজ ইবাদত হলো সিয়াম বা রোজা। দীর্ঘ ১১ মাসের প্রতীক্ষার পর রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের সওগাত নিয়ে সারা বিশ্বে মুসলমানের কাছে সাম্য, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব, মানবিকতা, ত্যাগ, সংযম ও আত্মশুদ্ধির মাস এ পবিত্র মাহে রমজান ফিরে আসে। বছর ঘুরে আসা পবিত্র মাহে রমজান মাসের শুভাগমনকে আমরা স্বাগত জানাই।
বলার অপেক্ষা রাখে না, কুপ্রবৃত্তি দমন ও আত্মশুদ্ধির সর্বোত্তম মাস হলো পবিত্র রমজান মাস। পুণ্যময় এ মাস রহমত, বরকত ও মুক্তির বার্তা নিয়ে আসে, হৃদয়কে প্রশান্ত করে। এ মাস বিশ্ব মুসলিমকে সংযত ও সুন্দর জীবনযাপনের শিক্ষা দেয়। মুসলিম নর-নারীর কাছে রোজার মাস অত্যন্ত কাক্সিক্ষত। মহান আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের আশায় মুসলমানরা শ্রদ্ধা ও নির্মল ভালোবাসায় বরণ করে এ মাসকে। মহান আল্লাহ এ মাসের প্রতিটি দিন ও মুহূর্তকে নির্ধারিত করে দিয়েছেন সংযম সাধনার জন্য। পবিত্র এ মাসের মধ্যে নিহিত রয়েছে দুনিয়া ও পরকালের অশেষ কল্যাণ। আর এ পবিত্র মাসে শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকাই নয়, পাশাপাশি তাগিদ দেওয়া হয়েছে জাগতিক সব বিষয়ে সংযত জীবনাচারের জন্য। রমজানের শিক্ষা হলো সব ধরনের পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা এবং আত্মশুদ্ধি অর্জন করা। নিজের এবং অন্যের ওপর জুলুম করা, অপচয় করা থেকে বিরত থাকা।
তবে পরিতাপের বিষয় হলো পবিত্র রমজানে অনেকে বেখেয়াল থাকেন। এছাড়া রোজার মাস এলেই দেখা যায় জিনিসপত্রের দাম হু-হু করে বেড়ে যায়। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এ মাসে বেশি মুনাফার আশায় দাম বাড়িয়ে নিজেদের স্বার্থ আদায়ে মরিয়া হয়ে ওঠে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। বিশেষ করে রমজান মাস সামনে রেখে চাল, ডাল, আটা, তেল ও পেঁয়াজসহ ইফতারে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ানোর পাল্লায় নামেন ব্যবসায়ীরা, এমনটি এর আগে দেখা গেছে। এ প্রসঙ্গে এটাও বলা দরকার, বিভিন্ন ধরনের অজুহাত সামনে রেখে বাজার অস্থির হওয়ার বিষয়টি যেমন নতুন নয়; তেমনি কারসাজিসহ নানা কারণেই নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির বিষয় বার বারই আলোচনায় আসে। অথচ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে নিম্নআয়ের মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে।
আমরা বলতে চাই, পবিত্র রমজানে যদি খাদ্যপণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বৃদ্ধির ঘটনা ঘটে, তবে তা কোনোভাবেই এড়ানোর সুযোগ নেই- যা আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। খাদ্যপণ্যসহ নানামুখী পণ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যায়। ফলে সার্বিক বিষয়গুলো আমলে নিতে হবে। পবিত্র রমজানে যেন অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে না পারে, মানুষকে জিম্মি করতে না পারে, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এটা ভুলে যাওয়া যাবে না, রমজান মাসকে পুঁজি করে প্রতি বছর নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ফলে নিত্যপণ্যের মূল্য যেন অযৌক্তিভাবে বেড়ে না যায়, এ বিষয়টি কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে সংশ্লিষ্টদেরই। বাজার মনিটরিং করতে হবে।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘সংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ তথা তাকওয়ার মাস রমজান।’ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতিও; যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সূরা বাকারা : ১৮৩)।
রমজানের উদ্দেশ্য তাকওয়া। তাকওয়া অর্থ আল্লাহর ভয়। আল্লাহর ভয়ে সব মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা। সংযম অবলম্বন করা। এ সংযম সব শ্রেণির মানুষের জন্য। ব্যবসায়ী ও বিক্রেতারা অতি মুনাফার লোভ সংযত করবেন, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি থেকে বিরত থাকবেন। ভোক্তা ও ক্রেতারা অহেতুক অধিক পরিমাণে পণ্য ক্রয় থেকে বিরত থাকবেন। সরকার, প্রশাসন শুধু রাজস্ব বাড়ানোর পরিবর্তে জনকল্যাণে ব্রতী হবে। তবেই পবিত্র রমজানের উদ্দেশ্য সফল হবে। রহমতের অফুরন্ত ধারা প্রবাহিত হবে। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভ হবে।
রমজানে সিয়াম বা রোজার পূর্ণতার জন্য সহায়ক ও পরিপূরক আমল হলো নিয়মিত ২০ রাকাত তারাবির সালাত আদায় করা, সাহরি খাওয়া, ইফতার করা, কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত করা এবং পবিত্র রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করা। বিশেষত অপ্রয়োজনীয় বাক্যালাপ, বেহুদা-অযথা সংলাপ থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য।
সিয়াম সাধনার অন্যতম উদ্দেশ্য ধনীদের মধ্যে অভাবী মানুষের ক্ষুধার যন্ত্রণা উপলব্ধি জাগরুক করা। তাই পবিত্র রমজানকে ভোজের আয়োজনে পরিণত করা উচিত নয়। পানাহারের প্রতি এত বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত নয়, যাতে ইবাদতে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। সামর্থ্যবানরা এত বেশি পরিমাণে বাজার করা উচিত নয়Ñ যাতে গরিব মানুষ কেনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এসব রমজানের শিক্ষা ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী।
আমাদের আশপাশে প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজন যারা অভাবী আছেন, তাদের ইফতার ও সাহরির ব্যবস্থা করা আমাদের সবার নৈতিক ও ঈমানী দায়িত্ব। আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘সে ব্যক্তি পরিপূর্ণ ঈমানদার নয়, যে পেট পুরে আহার করে আর তার প্রতিবেশী অনাহারে থাকে।’ (মুসলিম)
রমজান মাসে আল্লাহর রহমত ব্যাপকভাবে বর্ষিত হয়ে থাকে। জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। ফলে রোজা, নামাজ, তিলাওয়াত, দান-সদকা, ফিতরা, যাকাত, জিকির-আজকার যাবতীয় ইবাদত অনুশীলন ও তাকওয়া অর্জন সহজ হয়।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন সব মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় দানশীল ব্যক্তি। যখন রমজান মাস আসত, জিবরাইল (আ.) প্রতি রাতে নবীজি (সা.)-এর কাছে আসতেন, কুরআনের তালিম করতেন, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রবাহিত বায়ু অপেক্ষা অধিক হারে দান-খয়রাত ও নেক আমল করতেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)। সংযমের মাস রমজানে রহমত পাওয়ার জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে সংযমী ও নিয়ন্ত্রিত আচরণ করতে হবে। সাওম বা রোজা পালনের পাশাপাশি তাকওয়া তথা খোদাভীতি সদা মনে জাগরুক রাখতে হবে।
রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষায় ইবাদতের ভাবগম্ভীর পরিবেশ বজায় রাখা সবার দায়িত্ব। যারা কোনো ওজরের কারণে রোজা রাখতে পারছেন না, তাদেরও দিনের বেলায় প্রকাশ্যে বা রোজাদারের সামনে পানাহার থেকে বিরত থাকা কর্তব্য। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে কারিমে বলেন, ‘যারা আল্লাহর নিদর্শনকে সম্মান করে, এটা তাদের অন্তরের তাকওয়ার পরিচয় বহন করে।’ (সূরা হজ : ৩২)।
রমজানের তাৎপর্য গভীরভাবে উপলব্ধি করা এবং সেই মোতাবেক আমল করা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, সিয়াম সাধনার শিক্ষা জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে হবে এবং এর মাধ্যমে অর্জিত শিক্ষা জীবনে প্রতিফলিত করতে হবে। তবেই ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে।